আপনারা, মধ্যস্থতাকারীরা তো এই মুহূর্তে বাঘের পিঠে সওয়ার? অন্তত, সে রকমই তো শোনা যাচ্ছে!
আমাদের কাজ আপাতগ্রাহ্য বিভিন্ন বোঝাপড়ার মাধ্যমে সরকার, মাওবাদী ও অন্যদের আলোচনার টেবিলে আনা। গোটা পরিস্থিতিই অবাস্তব, এটা ভাবা ঠিক নয়। দু’পক্ষই যাতে অস্ত্র সংবরণ করে আলাপ-আলোচনার পথে আসে তার চেষ্টা চালাচ্ছি।
অস্ত্র সংবরণ? সমর্পণ নয়?
মাওবাদীদের রাজনৈতিক মতাদর্শে সশস্ত্র আন্দোলনের কথা বলা আছে। তাঁদের অস্ত্র সমর্পণের কথা বলাটা অবাস্তব। যাঁরা রাষ্ট্র ব্যবস্থা পাল্টানোর পক্ষে, তাঁদের সঙ্গে সরকার যদি কথা বলতে চায় তা হলে সম্মানের সঙ্গেই বলতে হবে। সম্মানের প্রাথমিক শর্তই হল, সে তার অস্ত্র সংবরণ করবে এবং সরকারও তার বিরুদ্ধে দমন অভিযান চালাবে না। দমনের বদলে আলোচনার রাস্তায় যেতে হবে।
দেশে-বিদেশে সশস্ত্র বিপ্লবের প্রেক্ষাপটের কথাটা বিবেচনায় রাখাটা কি এই মুহূর্তের জরুরি কাজ নয়?
ভীষণ জরুরি। অস্ত্র হাতে নেওয়ার যে প্রেক্ষাপট তা বুঝতে হবে। এই হিংসার নিরসনেরও চেষ্টা করতে হবে। সরকারকে বুঝতে হবে, অসাম্য, বৈষম্যের সঙ্গে হিংসার গভীর যোগাযোগ আছে।
কিন্তু নির্বিচার হত্যার লাইন সম্পর্কে মাওবাদীরাও কি সচেতন হবেন না?
তাঁদের রাজনৈতিক পদ্ধতি নিয়ে প্রশ্ন তোলাই যায়। কিন্তু, তার মোকাবিলাই বা কোন পথে হবে? দমনের মাধ্যমে? আপনার প্রশ্নের মধ্যে হিংসার রাজনীতির ‘এফেক্ট’টাই গুরুত্ব পাচ্ছে বেশি, তার মূল কারণটা পাচ্ছে না। কেন গণতান্ত্রিক কাঠামোগুলো ব্যর্থ? কেন উন্নয়নের সুফল জায়গা মতো পৌঁছচ্ছে না? কেন আইনরক্ষকেরা অন্যায় করেও পার পেয়ে যাচ্ছে? |
আপনার উত্তরের মধ্যেও মনে হচ্ছে আপনি এই হিংসার পথে সায় দিচ্ছেন!
না, সায় দিচ্ছি না। পরিস্থিতির বিশ্লেষণ করছি। রাষ্ট্রকে কিন্তু ওই সব প্রশ্নের উত্তর দিতে হবে।
আমেরিকার তৈরি ৩৫টি জঙ্গি সংগঠনের তালিকায় ঢুকে পড়েছে এ দেশের সিপিআই (মাওবাদী)-র নামও। রাষ্ট্র ও মাওবাদী হিংসার বাতাবরণের মধ্যে শান্তি আলোচনার পথটা কি কঠিন নয়?
কঠিন, তবে অসম্ভব নয়। অসমে আলফার সঙ্গে শান্তি চুক্তি সম্পাদিত হল। নাগাল্যান্ডে হয়েছে, মিজোরামে লালডেঙার সঙ্গে চুক্তি করেছিলেন খোদ রাজীব গাঁধী। তবে, এই শান্তি আলোচনার পথ কখনওই মসৃণ হয় না। এগোনো-পিছোনো আছে। ওঠা-নামা আছে। দীর্ঘ সময়ের ব্যাপার।
সিয়েরা লিওন-এও তো রিভলিউশনারি ইউনাইটেড ফ্রন্টের সঙ্গে দীর্ঘ ১১ বছরের গৃহযুদ্ধের অবসানের জন্য শান্তি চুক্তির পথ মসৃণ ছিল না।
হ্যাঁ, ওখানে অনেক সময় লেগেছে, লাইবেরিয়ায় লেগেছে, সুদানের ডারফুরে লেগেছে, আয়ার্ল্যান্ডে ব্রিটেনের সঙ্গে শান্তি চুক্তিতে বহু সময় লেগেছে। সিয়েরা লিওনে শান্তি প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল ১৯৮৯-তে। শেষ হয় ২০০৩ সালে। লাইবেরিয়ায় কথাবার্তা শুরু হয়েছিল ১৯৯৬ সালে, শেষ হয় ২০০৩-এ। নেপালে প্রচন্ডর সঙ্গে কথাবার্তাও তো মসৃণ ছিল না, সেখানেও আলোচনা এক পা এগোলে দু’পা পিছিয়েছে। এ রকম হয়।
শান্তি আলোচনা তো এই রাজ্যের জঙ্গলমহলে শান্তি ফেরানোর লক্ষ্যে? অন্যান্য রাজ্যের ক্ষেত্রে কী হবে? সিপিআই (মাওবাদী)-এর মতো একটা দল পশ্চিমবঙ্গের ক্ষেত্রে এক রকম আর অন্য রাজ্যে অন্য রকম অবস্থান নেবে?
আসলে লালগড় সমস্যা এই সরকারের উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া। বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের সরকার আলোচনায় বসেনি। এ বার যদি কোনও ভাবে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকারের সঙ্গে মাওবাদীদের শান্তি আলোচনা সফল হয়, তা হলে দেশের অনেক রাজ্যই এ ব্যাপারে উৎসাহিত হতে পারে। এ প্রসঙ্গে একটা কথা বলা দরকার। ২০০৯-এর ১৮ জুন থেকে যৌথ বাহিনীর অভিযান শুরু হয়েছে। আমিও মনে করি, যৌথ বাহিনীর প্রত্যাহারের দাবি সঠিক। কিন্তু, সরকারের দাবি অনুসারে, এই ২০১১-য় এসে কোনও রাজ্য সরকারের পক্ষে যৌথ বাহিনী তুলে নেওয়া নাকি সম্ভব নয়। কিন্তু, সরকারের সেই দাবির বিরোধিতায় অনড় থাকলে আবার আলোচনার পথ খুলবে না। সে ক্ষেত্রে অভিযান বন্ধ রেখে যদি আলোচনার পথ খোলা যায় তা হলে সেই পথেই তো এগোনো উচিত।
আলোচনার টেবিলে কথাটা তা হলে কী নিয়ে হবে?
আমার মনে হয়, বিভিন্ন উন্নয়নমূলক প্রকল্প ঠিকঠাক হচ্ছে কি না, দরিদ্রদের মধ্যে দরিদ্রতমের কী হবে? উন্নয়নের সুফল একেবারে তৃণমূল স্তরে পৌঁছতে গেলে কী কী করা উচিত, আলোচনায় সে সব প্রসঙ্গ আসবে। এটা তো মাওবাদীদের শুধু সুরক্ষার প্রশ্ন নয়, প্রশ্নটা প্রকৃত উন্নয়নের। দেখা গিয়েছে, ওড়িশায় মাওবাদী অধ্যুষিত এলাকায় উন্নয়নের কাজ তুলনায় ভাল হয়েছে।
তা হলে কি বলতে চান, মাওবাদী অধ্যুষিত এলাকাগুলিতেই কাজ ভাল হয়?
ওটা আপনার ব্যাখ্যা, আমার নয়। তবে নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিদের সঙ্গে গত ৭ জুলাই এই সরকারের যে চুক্তি স্বাক্ষরিত হয় তাতে সাত দফা দাবির অন্যতম হল, জঙ্গলমহলে খাদ্য-বস্ত্র-বাসস্থানের অধিকার সুনিশ্চিত করা। গত সরকারের আমলে পুলিশ ও যৌথ বাহিনীর অত্যাচারের তদন্ত হবে। চুক্তিতে বলা হয়েছে, সব পক্ষই অস্ত্র সংবরণ করবে।
কিন্তু আবার তো জঙ্গলমহলে হিংসাত্মক ঘটনা ঘটেছে। মুখ্যমন্ত্রী বলেছেন, এ রকম চললে কড়া ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
এ সব উদ্বেগজনক বাধা থাকেই। এ সব অতিক্রম করেই শান্তি আলোচনা চলবে। পৃথিবীর কোথাও শান্তি আলোচনা সরলরেখায় চলেনি। চুক্তিভঙ্গের অভিযোগও আছে।
এই রাজ্যে রাজনৈতিক বন্দিদের মুক্তি নিয়েও তো নানা জটিলতা আছে। সরকারের শীর্ষস্তরে নেওয়া সিদ্ধান্ত, অথচ, অনেক ক্ষেত্রে আদালতে সরকারি কৌঁসুলি অভিযুক্তদের রাজনৈতিক বন্দির মর্যাদা দেওয়ার আবেদনের বিরোধিতা করছেন।
হ্যাঁ, এ রকমও হচ্ছে। তবে, শান্তি আলোচনায় স্বচ্ছতা আরও বাড়বে যদি মাওবাদী সন্দেহে ধৃতদের মুক্তি ত্বরান্বিত করা যায়। বন্দিমুক্তির ব্যাপারে গঠিত রিভিউ কমিটি প্রথম দফায় ৭৮ জনের মুক্তির ব্যাপারে সুপারিশ করেছে। এর মধ্যে ২৪ জন মাওবাদী সন্দেহে ধৃত। ৭৮ জনের মধ্যে এখনও পর্যন্ত মুক্তি পেয়েছেন ১৩ জন।
ইতিমধ্যেই নানা মহলে একটা সন্দেহ দেখা দিয়েছে, শান্তি আলোচনায় শামিল হয়ে মাওবাদীরা আসলে সময় নিতে চান। যৌথ বাহিনীর অভিযানে কোণঠাসা মাওবাদীরা নিজেদের আরও গুছিয়ে নিতে চান।
হতে পারে। এটাও তো যুদ্ধকালীন সংঘর্ষ বিরতি। হতে পারে, এটাও কৌশল। সরকারেরও কৌশল আছে, ওদেরও আছে। তবে, শুধু গোয়েন্দা রিপোর্টের উপরে ভিত্তি করে সরকার যদি কোনও সিদ্ধান্ত নেয়, তবে তা হবে আত্মঘাতী। ‘গাজর ও লাঠি’র কথা বার বার বলাটা শান্তি আলোচনাকে ব্যাহত করে। এই আলোচনা পর্বে দু’পক্ষেরই প্রচুর ধৈর্য ও প্রজ্ঞা দরকার।
কিন্তু ইতিমধ্যেই ইতিউতি প্রশ্ন উঠছে, আপনারা, এই মধ্যস্থতাকারীরা কারা? আপনারাই কি নাগরিক সমাজের যথার্থ প্রতিনিধি?
এই মুহূর্তে আমরা যে ছ’জন মধ্যস্থতাকারী আছি, তাঁরা দীর্ঘ দিন সামাজিক আন্দোলনের কর্মী। নাগরিক সমাজ বস্তুত, অবয়বহীন। প্রত্যেকেই নাগরিক। প্রশ্নটা হল, শান্তি আলোচনায় তা হলে শুধু কুলীনরাই যাবেন? সংগঠনের প্রতিনিধিরাই যাবেন? অসমে শান্তি আলোচনায় প্রতিনিধিত্ব করেছেন ইন্দিরা গোস্বামী, কাশ্মীরে রাধা কুমার ও অন্যরা, অন্ধ্রপ্রদেশে হরগোপাল ও ভারা ভারা রাও। আসলে, শুভবুদ্ধিসম্পন্ন যে কেউই আলোচনা-পর্বের সূচনা বা তাতে অংশগ্রহণ করতে পারেন। বাস্তব হল, সরকার-নিযুক্ত এই ছ’জনকে নিয়ে মাওবাদী-সহ অন্যরা কোনও প্রশ্ন তোলেনি। এখন শান্তি আলোচনা শুরু হলেই আমরা খুশি। |