ভূমি অধিগ্রহণ বিলটি লইয়া দেশের অধিকাংশ বণিকসভাই দুশ্চিন্তায় পড়িয়াছে। কনফেডারেশন অব ইন্ডিয়ান ইন্ডাস্ট্রি বলিয়াছে, জমির মালিকদের যথাযথ ক্ষতিপূরণ দেওয়া হইবে, তাহা খুবই ভাল কথা কিন্তু তাহার ফলে শিল্পের খরচ যে বিপুল পরিমাণে বাড়িবে, তাহাও স্মরণে রাখা উচিত। অ্যাসোসিয়েটেড চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি অব ইন্ডিয়া দাবি করিয়াছে, বিলটি পুনর্বিবেচনা করা হউক। ফেডারেশন অব ইন্ডিয়ান চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি বিলটিকে শিল্পের উপর ‘বোঝা’ আখ্যা দিয়াছে। প্রতিক্রিয়াটি অপ্রত্যাশিত নহে। তবে, অন্যায্য। জমি শিল্পের একটি উপাদান। কাঁচামাল বা শ্রমিকের মতোই। সিমেন্টের দাম বাড়িলে শিল্পপতিরা যেমন সরকারের উপর অসন্তুষ্ট হন না, পেট্রোলিয়ামের মূল্যবৃদ্ধিতে আরব দেশের সরকারের নিকট দাম কমাইবার আবেদন করেন না, জমির মূল্যবৃদ্ধির ক্ষেত্রেও একই ভাবে পরিস্থিতির সম্মুখীন হওয়া বিধেয়। মুশকিল হইল, অন্য কাঁচামালের ক্ষেত্রে বাজারের নিয়মই প্রচলিত, ফলে সেই নিয়মে দামের ওঠা-পড়াকে ‘স্বাভাবিক’ বলিয়া মানিয়া লওয়া সহজ। জমির বাজারটি এত দিন বিবিধ কারণে ‘অচল’ ছিল। জমি অধিগ্রহণ বিল সেই বাজারটিকে কার্যকর করিতে সচেষ্ট হইয়াছে। সেই বাজারের নিয়ম মানিয়া লওয়াই বিধেয়। শিল্পমহল বলিতে পারে, জমির দাম বাড়িলে পণ্যের উৎপাদন ব্যয় বাড়িবে, ফলে আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতিযোগিতায় সমস্যা হইবে। সমাধান কঠিন নহে। ভারতীয় শিল্প আরও কুশলী হইয়া উঠিতে যত্ন করুক। আর যদি দেখা যায়, কুশলতার শীর্ষে পৌঁছাইয়াও ভারতীয় শিল্প আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতার সহিত আঁটিয়া উঠিতে পারিতেছে না, তখন শিল্পমহল সরকারের নিকট প্রত্যক্ষ ভর্তুকির আবেদন করিয়া দেখিতে পারে। কিন্তু, জমির দাম চাপিয়া রাখিয়া প্রতিযোগিতায় টিকিয়া থাকিবার মানসিকতাটি বাজার অর্থনীতির নৈতিক ধর্মের বিরোধী, অতএব পরিত্যাজ্য। এখনও পর্যন্ত জমির দাম নির্ধারিত হয় ঐতিহাসিক মূল্যের ভিত্তিতে। অর্থাৎ, কোনও নির্দিষ্ট অঞ্চলে এযাবৎকাল যে দামে জমি বিক্রয় হইয়াছে, তাহার উপর ভিত্তি করিয়া অধিগ্রহণের মূল্য ধার্য করা হইত। প্রক্রিয়াটির গোড়ায় গলদ। কারণ, জমি কোন কাজে ব্যবহৃত হইতেছে, তাহার উপর জমির দাম নির্ভর করে। কৃষিজমির যাহা দাম, শিল্পের জমির দাম স্বভাবতই তাহার বহু বেশি, কারণ কৃষি এবং শিল্পে সমপরিমাণ জমি ব্যবহৃত হইলে শিল্পে লাভের পরিমাণ বিসদৃশ রকম বেশি হয়। আবার, শিল্পের জমির যত দাম, শিল্প গড়িয়া উঠিবার পর তাহার পরিপার্শ্বে থাকা জমির দাম আরও বেশি, কারণ সেই জমির মালিক একটি প্রতিষ্ঠিত শিল্পের সুবিধা ভোগ করিবেন। অতএব, জমির দাম তাহার চরিত্রানুযায়ী হওয়াই বাঞ্ছনীয়। শিল্পের প্রয়োজনে কৃষিজমি অধিগ্রহণের অর্থ সেই জমির চরিত্র পরিবর্তন। তাহা আর কৃষিজমি থাকিল না, ফলে কৃষিজমির দরে তাহার কেনাবেচা চলিতে পারে না। যে দামে বাজারে শিল্পের জমি বিক্রয় হয়, তাহাও অধিগৃহীত কৃষি জমির ক্ষেত্রে ন্যায্য দর নহে। তাহার কারণ, যাঁহারা এই কৃষিজমির মালিক, জমি বিক্রয় করিবার পর সেই জমির বর্ধিত উৎপাদনশীলতার সুবিধার কণামাত্রও তাঁহারা আর পাইবেন না। সেই লাভ সম্পূর্ণতই বিনিয়োগকারীর। অতএব, অধিগ্রহণের সময় জমির দর স্থির করিতে হইলে ভবিষ্যতের লাভের অংশ হিসাবে রাখা বাঞ্ছনীয়। তাহাই সুষম ব্যবস্থা। এই ব্যবস্থাটি মানিয়া লওয়া ভিন্ন বিনিয়োগকারীদের উপায় নাই। তাঁহাদের স্থির করিতে হইবে, অধিক দামে জমি কিনিয়াও কী উপায়ে প্রতিযোগিতাযোগ্যতা এবং লাভযোগ্যতা বজায় রাখা যায়। |