ঘরের মধ্যে বাসন কোসন, বাক্স প্যাটরা। আলনায় স্তূপ করা জামাকাপড়, গ্যাস সিলিন্ডার। মাথার উপরে বনবন করে ঘুরছে পাখা। মেঝেয় পা ছড়িয়ে বসে এক মহিলা চুল শুকোচ্ছেন। আপাতদৃষ্টিতে যা গেরস্থালির চেহারা বলে মনে হয় আসলে তা একটি শ্রেণিকক্ষ। দেওয়ালে ঝোলা মনীষীদের ছবি সাক্ষী রেখেই ওই ঘরের মধ্যে চলছে বালুরঘাট হিন্দি প্রাথমিক স্কুলের পঠন পাঠন। গত দেড় মাস ধরে ওই স্কুলের একমাত্র শিক্ষিকা দীপ্তি আচার্যকে ওই ক্লাস ঘরে বসেই গুটি কয়েক পড়ুয়াকে পড়াশোনা শেখানোর চেষ্টা করতে হচ্ছে। এলাকার বাসিন্দাদের অভিযোগ, বর্ষার সময়ে আত্রেয়ী নদীতে জল বাড়ার পরে নিচু এলাকার বাসিন্দারা ওই স্কুলে আশ্রয় নেন। নদীর জল নেমে গিয়েছে। কিন্তু বাসিন্দারা স্কুলের দখল ছাড়েননি। স্কুলের ৩টি শ্রেণি কক্ষ এখনও বানভাসিদের দখলে রয়েছে। তার বাইরে স্কুলের মাঠে ত্রিপল খাঁটিয়ে রয়েছেন আরও কয়েকটি পরিবার। |
ওয়ার্ড কাউন্সিলরকে বলার পরেও সমস্যা মেটেনি। এলাকার অভিভাবকদের অভিযোগ, দীর্ঘদিন ধরেই এই সমস্যা চলছে। কর্তৃপক্ষকে সমস্যার কথা জানালেও ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। ওয়ার্ডের তৃণমূল কাউন্সিলর রাজেন শীল বলেন, “অগস্টের বন্যার সময়ে ঘরবাড়ি ডুবে যাওয়ায় বাসিন্দাদের স্কুলে ঠাঁই দেওয়া হয়। তাদের ফিরে যেতে বলা হয়েছে।” স্কুলে শিক্ষক নিয়োগ করে পরিকাঠামোর উন্নতির জন্য জেলা প্রাথমিক শিক্ষা সংসদে বলা হয়েছে বলেও দাবি করেন ওই কাউন্সিলর। জেলা প্রাথমিক শিক্ষা সংসদের চেয়ারম্যান বাচ্চু হাঁসদা বলেন, “শিক্ষক নিয়োগ করে স্কুলের পরিকাঠামোর উন্নতি করা হবে। পড়াশোনার পরিবেশ ফেরাতে দখলদারদের সরিয়ে দেওয়ার জন্য এলাকার কাউন্সিলরকে বলেছি।” বালুরঘাট শহরের ৭ নম্বর ওয়ার্ডে হিন্দিভাষি বাসিন্দার বসবাস বেশি বলে ১৯৫৫ সালে এই এলাকার একটি প্রাথমিক স্কুল চালু করা হয়। এলাকার বাসিন্দারা জানান, সেই সময়ে ২ জন হিন্দিভাষি-সহ মোট ৪ জন শিক্ষক নিয়োগ করে স্কুলে পঠন পাঠন শুরু হয়। বাংলা ও হিন্দি মাধ্যমে স্কুলে পড়াশোনা করানো হত। পরে আর স্কুলে শিক্ষক নিয়োগ করা হয়। পরিকাঠামোর উন্নতি না-হওয়ায় স্কুলটি বেহাল হয়ে পড়ে। শেষ পর্যন্ত এলাকার এক যুবক গোবিন্দ শর্মা স্বেচ্ছায় স্কুলে ছাত্র পড়ানোর দায়িত্ব নেন। গোবিন্দবাবু চাকরি পেয়ে অন্য ব্লকে চলে গেলে ফের সমস্যা তৈরি হয়। দীপ্তি দেবীই স্কুলের একমাত্র শিক্ষিকা। অভিভাবকদের অভিযোগ, স্কুলে শৌচাগার নেই। রান্নাঘর তৈরির টাকা মেলেনি। পুঁতিগন্ধময় পরিবেশে চলছে মিড ডে মিল তৈরি। সীমানার পাঁচিল না-থাকায় বানভাসি প্রতি বছর স্কুলে ঢুকে পড়েন। পুজো পর্যন্ত স্কুলেই কাটিয়ে যান। স্কুলের মাছ দখল নিয়েছেন ঠেলাচালকেরা। রাতে স্কুলের বিদ্যুতের লাইন থেকেই চলে টিভি দেখা, গান শোনা। এই অবস্থায় অভিভাবকেরাও ছেলেমেয়েদের এই স্কুলে পাঠাতে ভরসা পান না। ফলে পড়ুয়ার সংখ্যা কমে দাঁড়িয়েছে মাত্র ২৯। শিক্ষিকা দীপ্তি দেবী বলেন, “এমন ভাবে স্কুল চালানো সত্যিই কঠিন। তবু স্কুল খোলা রেখেছি। না-হলে যে কয়েকজন পড়ুয়া রয়েছে তাঁরাও হয়তো অন্যত্র চলে যাবে।” |