মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশই সার, তিন হাসপাতাল ঘুরে মৃত্যু রোগিণীর
স্বাস্থ্যের হাল ফেরাতে মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশ কি স্রেফ কথার কথা? অসহ্য পেটের যন্ত্রণায় কাতরানো এক মহিলাকে নিয়ে এসএসকেএম থেকে শম্ভুনাথ, সেখান থেকে ন্যাশনাল মেডিক্যাল কলেজ দৌড়োদৌড়ি এবং শেষ পর্যন্ত ন্যাশনালে ভর্তির ১০ মিনিটের মধ্যে তাঁর মৃত্যু এই গুরুতর প্রশ্নকেই ফের সামনে আনছে।
পেটের অসহ্য যন্ত্রণায় কাতরাতে থাকা ব্যারাকপুরের মঞ্জু চক্রবর্তীকে তাঁর পরিবারের লোকেরা প্রথমে এসএসকেএম হাসপাতালে নিয়ে গিয়েছিলেন। অভিযোগ, সেখানে তাঁকে দু’ঘণ্টা বিনা চিকিৎসায় ফেলে রাখার পরে পরামর্শ দেওয়া হয় রাতটুকু শম্ভুনাথ পণ্ডিত হাসপাতালে ভর্তি থেকে পরদিন আউটডোরে এসে দেখাতে। আরও অভিযোগ, শম্ভুনাথে যাওয়ার পরে সেখানকার চিকিৎসকেরা চূড়ান্ত বিরক্তি নিয়ে জানান, নিজেদের দায় এড়াতেই আগের হাসপাতাল রেফার করেছে। রোগিণীকে পাঠানো হয় ন্যাশনাল মেডিক্যাল কলেজে। সেখানে পৌঁছলে প্রৌঢ়া মঞ্জুদেবীকে তিনতলার মেডিসিন ওয়ার্ডে নিয়ে যেতে বলা হয়। এ দিকে, লিফ্ট খারাপ। অগত্যা পাঁজাকোলা করে তিনতলায় পৌঁছে পরিজনেরা জানতে পারলেন, ওই বিভাগের চিকিৎসক পাঁচতলায় রয়েছেন। ফের রোগিণীকে পাঁজাকোলা করে নিয়ে যাওয়া হল পাঁচতলায়। সেখানে কর্তব্যরত চিকিৎসক তখন ঘুমোচ্ছিলেন। অভিযোগ, তিনিও প্রবল বিরক্তি নিয়ে কিছুক্ষণ পরে ঘুম থেকে উঠে তিনি ভর্তির কাগজপত্র তৈরি করেন। এবং জানান তিনতলার ওয়ার্ডে শয্যার ব্যবস্থা হয়েছে। আবারও মঞ্জুদেবীকে পাঁজাকোলা করে নিয়ে যেতে হল তিনতলার ওয়ার্ডে। ততক্ষণে অবশ্য চিকিৎসার বিশেষ কিছু বাকি ছিল না। শয্যা পাওয়ার পরে ওষুধ শরীরে ভাল ভাবে কাজ করার সুযোগ পাওয়ার আগেই মৃত্যু হয় ওই রোগিণীর।
ক্ষমতায় এসে হাসপাতালকে মানবিক হতে বলেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। বলেছিলেন, কোনও রোগীকে স্থিতিশীল না করে অন্যত্র পাঠিয়ে দেওয়া চলবে না। কিন্তু তাঁর ওই নির্দেশ যে অধিকাংশ চিকিৎসকেরই কানে ঢোকেনি এই ঘটনায় ফের তার নজির তৈরি হল কলকাতার ওই তিন হাসপাতালে, যে ‘অমানবিকতা’র বলি হলেন ৫৫ বছরের মঞ্জুদেবী। তিন হাসপাতালের এই বিরুদ্ধে ওই অভিযোগ নিয়ে মুখ্যমন্ত্রী তথা স্বাস্থ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এবং স্বাস্থ্যসচিব সঞ্জয় মিত্রের দ্বারস্থ হয়েছেন পরিবারের লোকেরা। মঞ্জুদেবীর ছেলে শুভঙ্করের প্রশ্ন, বেসরকারি হাসপাতালে প্রচুর টাকা খরচ করে চিকিৎসা করানোর সামর্থ্য নেই বলেই কি তাঁর মায়ের এমন অসহায় মৃত্যু হল?
মঞ্জু চক্রবর্তী
ঘটনাটি যে মর্মান্তিক তা স্বীকার করে নিয়ে স্বাস্থ্যসচিব জানান, অবিলম্বে অভিযোগ খতিয়ে দেখে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তাঁর কথায়, “অভিযোগ প্রমাণিত হলে এতটা অমানবিকতা কোনও ভাবেই বরদাস্ত করা হবে না।”
মাস কয়েক ধরে লিভার ও কিডনির জটিল অসুখে ভুগছিলেন মঞ্জুদেবী। এসএসকেএমের আউটডোরে গিয়েই তিনি নিয়মিত ডাক্তার দেখাতেন। গত বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা থেকে তাঁর পেটে প্রবল ব্যথা শুরু হয়। অবস্থা ক্রমশ খারাপ হচ্ছে দেখে বাড়ির লোকেরা তাঁকে নিয়ে যান এসএসকেএমে। অভিযোগ, সেখানে রাত সাড়ে ১১টা থেকে ঘণ্টা দুয়েক তাঁকে কার্যত বিনা চিকিৎসায় ফেলে রাখা হয়। মঞ্জুদেবীর ছেলে শুভঙ্করের অভিযোগ, “প্রথমে ইমার্জেন্সি মেডিক্যাল অফিসার মাকে দেখে বললেন, গ্যাস্ট্রোএন্টেরোলজিস্টকে দেখাতে হবে। এক ঘণ্টা পরে এক জন গ্যাস্ট্রোএন্টেরোলজিস্ট মাকে পরীক্ষা করে জানালেন, লিভারের কোনও সমস্যা নেই, সমস্যাটা কিডনির। সেই অনুযায়ী খবর দেওয়া হল নেফ্রোলজিস্টকে। তিনি এলেন আরও এক ঘণ্টা পরে এবং দেখে মত দিলেন, লিভারেই সমস্যা। মা তখন যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছেন, আমরা হতভম্বের মতো দাঁড়িয়ে। তখন ইমার্জেন্সির ডাক্তার মাকে রাতটুকু শম্ভুনাথ পণ্ডিত হাসপাতালে রেখে পরদিন এসে গ্যাস্ট্রো আউটডোরে দেখাতে বললেন।”
পরিজনদের অভিযোগ, শম্ভুনাথ পণ্ডিত হাসপাতালে পৌঁছনোর পরে সেখানকার চিকিৎসকেরা জানান, নানা অজুহাতে এসএসকেএম এ ভাবে রোগী রেফার করে। শম্ভুনাথে প্রসূতি ও মেডিসিনের রোগী ছাড়া অন্য রোগী নেওয়া যাবে না বলে তাঁরা জানিয়ে দেওয়ায় মঞ্জুদেবীকে নিয়ে যাওয়া হয় ন্যাশনাল মেডিক্যাল কলেজে।
তার পরে কী হল? ওই প্রৌঢ়ার জামাই অনির্বাণ নিয়োগীর অভিযোগ, ন্যাশনালে যাওয়ার পরে তিনতলার মেডিসিন বিভাগে যেতে বলা হয়। কিন্তু তাঁরা দেখেন লিফ্ট খারাপ এবং কোনও হুইল চেয়ারও নেই। তাঁর কথায়, “বাড়ির লোকেরাই আমার শাশুড়িকে পাঁজাকোলা করে তিনতলায় নিয়ে যান। সেখানে বলা হয়, চিকিৎসক পাঁচতলায় রয়েছেন। তখন ওই ভাবেই আমরা পাঁচতলায় যাই। সেখানে কর্তব্যরত চিকিৎসক তখন ঘুমোচ্ছিলেন। তাঁকে ডাকলে তিনি অত্যন্ত বিরক্ত হন। তার পরে ভর্তির কাগজপত্র লিখে আমাদের ফের তিনতলার ওয়ার্ডে নিয়ে যেতে বলেন। আবার ওখানে যাওয়ার অল্প সময়ের মধ্যেই আমার শাশুড়ি মারা যান।”
কী বলছে সংশ্লিষ্ট হাসপাতালগুলি? এসএসকেএম এবং শম্ভুনাথ হাসপাতালের কর্তৃপক্ষ জানান, এমন কিছু হয়েছে কি না তাঁদের জানা নেই। স্বাস্থ্যভবন জানতে চাইলে তাঁরা খোঁজ নিয়ে দেখবেন। আর ন্যাশনালের সুপার পার্থ প্রধান বলেন, “মেরামতির জন্য লিফ্ট খারাপ থাকবে, সে কথা পূর্ত দফতর আগে জানিয়েছিল। তবে এমনিতেও সন্ধ্যার পরে লিফ্টচালককে খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। পূর্ত দফতরকে বারবার চিঠি লিখেও ফল হচ্ছে না।” এই চাপান-উতোরের মধ্যে স্বাস্থ্যভবন ও মহাকরণের দরজায় ঘুরছেন শুভঙ্কর। ‘বিনা চিকিৎসা’য় মায়ের মৃত্যুর প্রতিকারের আশায়।



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.