দু’বছর আগে সংখ্যাটা ছিল ১৭।
গত বছর কিছুটা বেড়েছিল। আর এ বার? এক লাফে দ্বিগুণ!
বর্ধমান মেডিক্যাল কলেজের এই পরিসংখ্যান সাধারণ অসুখে এইচআইভি পজিটিভ রোগীর মৃত্যুর। ওঁদের কেউ ডায়েরিয়া নিয়ে ভর্তি হয়েছিলেন, কারও হয়েছিল যক্ষ্মা বা ম্যালেরিয়া। সময়ে চিকিৎসা হলে যার কোনওটাতেই মৃত্যু হওয়ার কথা নয়।
অথচ ওঁরা সময়মতো হাসপাতালে ভর্তি হয়েও প্রাণে বাঁচেননি! এবং অভিযোগ: এইচআইভি আক্রান্ত বলেই ওঁদের ছুঁয়েও দেখেননি সরকারি হাসপাতালের চিকিৎসক-চিকিৎসাকর্মীরা। বরং অনেককে ‘জবরদস্তি’ ছুটি দিয়ে বাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছেন!
বর্ধমান মেডিক্যাল কলেজের বিরুদ্ধে ওঠা এই গুরুতর অভিযোগের তদন্তে নেমে রাজ্য এড্স নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধ সংস্থা (স্যাক্স)-র কর্তাদের চোখ কপালে উঠেছে। তথ্য বলছে, গত এক বছরে (২০১০-১১) হাসপাতালে এসেও এমন ৪৬ জন রোগীর মৃত্যু হয়েছে। গত বছরে (২০০৯-১০) সংখ্যাটি ছিল ২৩, তার আগের বছরে (২০০৮-০৯) ১৭। স্রেফ এক বছরে এটা দ্বিগুণ হয়ে গেল! কেন?
জবাবে হাসপাতালের চিকিৎসকদের কয়েক জন জানান, এইচআইভি আক্রান্তদের প্রতি এক শ্রেণির চিকিৎসক ও চিকিৎসাকর্মীর মনোভাবই এর কারণ। তাঁদের চাপেই উপযুক্ত চিকিৎসা না-দিয়ে তড়িঘড়ি ওই সব রোগীকে বাড়ি পাঠানো হয়েছে বলে অভিযোগ। |
মামুলি অসুখ নিয়ে হাসপাতালে এসে কেমন ব্যবহার পেয়েছেন ওই রোগীরা? কাটোয়ার অনিমা দেবনাথের (পরিবর্তিত নাম) স্বামী বলেন, “আমার স্ত্রীর মাথায় যন্ত্রণা হচ্ছিল। ডাক্তাররা ছুঁয়েও দেখলেন না! প্রায় তাড়িয়েই দিলেন। স্থানীয় ডাক্তার পরীক্ষা করে জানালেন, এনসেফেলাইটিস হয়েছিল। হাসপাতালে ঠিকঠাক চিকিৎসা হলে বেঁচে যেত।”
একই অভিজ্ঞতা কালনার সোমা হাজরার (পরিবর্তিত নাম) পরিজনের। সোমার ডায়েরিয়া হয়েছিল। তাঁর বাবার অভিযোগ, “ডাক্তারেরা স্যালাইন পর্যন্ত চালাতে চাইলেন না! বললেন, সূঁচ ফুটে গেলে নাকি তাঁদেরও রোগ হয়ে যাবে! এক বেলা হাসপাতালে রেখে জবরদস্তি ছুটি করে দিলেন! বাড়িতে বিনা চিকিৎসায় মরে গেল মেয়েটা।”
এইচআইভি আক্রান্তদের জোর করে ছুটি দেওয়ার কথা স্বীকার করেছেন বর্ধমান মেডিক্যাল কলেজের সুপার সুবোধ ভট্টাচার্যও। তবে এর জন্য তিনি মেডিসিন বিভাগে শয্যার অভাব এবং বিপুল রোগীর চাপকেই দায়ী করেছেন। তাঁর ব্যাখ্যা, “রোজ দেড়শো জন ভর্তি হতে লাইন দিচ্ছে! ভর্তি রোগীদের তাড়াতাড়ি না-ছাড়লে হাসপাতাল চলবে কী ভাবে? বেড না-বাড়ালে কিছু করার নেই।” ‘শয্যার সঙ্কট’ ও ‘রোগীর চাপের’ যুক্তি দিয়ে কর্তৃপক্ষ দায় এড়ালেও এইচআইভি আক্রান্তদের চিকিৎসায় যে গাফিলতি হচ্ছে, তা স্বাস্থ্যভবনে চিঠি দিয়ে জানিয়েছেন বর্ধমান মেডিক্যাল কলেজের এইচআইভি সংক্রান্ত চিকিৎসার নোডাল অফিসার প্রদীপকুমার দাস। তাঁর আক্ষেপ, “এইচআইভি আক্রান্তদের চিকিৎসায় মারাত্মক গাফিলতি হচ্ছে। চোখের সামনে এ সব দেখে বিবেক দংশনে ভুগছি। হাসপাতাল-কর্তৃপক্ষ যেন এঁদের তাড়াতে পারলেই বাঁচেন! বর্ধমানে আর কোনও ভাল সরকারি হাসপাতালও নেই। গরিবেরা কার্যত বিনা চিকিৎসায় মারা যাচ্ছেন।” বর্ধমান মেডিক্যাল কলেজের বিরুদ্ধে ওঠা এই অভিযোগের তদন্তের দায়িত্বে রয়েছেন স্যাক্সের যুগ্ম অধিকর্তা (কেয়ার অ্যান্ড সাপোর্ট) দীপ্তেন্দ্রনারায়ণ গোস্বামী। তিনি বলেন, “আমরা জানতে পেরেছি, বর্ধমান মেডিক্যালে এইচআইভি আক্রান্তদের তড়িঘড়ি বাড়ি পাঠানো বা অন্যত্র রেফারের প্রবণতা খুবই বেশি। বেশ ক’বার সতর্ক করেও কাজ হয়নি।” |