জলবণ্টন-বৃত্তান্ত রাতারাতি যেন ‘তিস্তাপারের কইন্যা’ করে তুলেছে কালীঘাটের মেয়েকে।
মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে নিয়ে উত্তরবঙ্গের বাতাসে ভাসছে ভাওয়াইয়া গান। জলচুক্তি ‘বাতিল’ হওয়ার খবর পেয়ে রাত জেগে ভাওয়াইয়া-শিল্পী সঞ্জীব মজুমদারের বাঁধা সে গানের শুরুটা হল: ‘শুধু কালীঘাটের নও গো তুমি/নও গো শুধুই পরিবর্তনের বন্যা। জল ধরিয়া প্রাণ জুড়াইলে/তুমি যেন মোদের তিস্তা পাড়ের কইন্যা রে....।
সব মিলিয়ে ১৭ লাইনের গান। তার শিল্প-মূল্য কতটা, সে বিতর্ক তোলা থাকুক কলারসিকদের জন্য। যা নিয়ে প্রায় কোনও মহলেই বিতর্কের অবকাশ নেই তা হল, কেন্দ্রকে কার্যত জল-চুক্তি ‘বাতিলে’ বাধ্য করিয়ে উত্তরবঙ্গে ‘কর্তৃত্ব’ আরও ‘শক্তপোক্ত’ করে ফেলেছেন তৃণমূল নেত্রী। তারই বার্তা যেন মিলছে ওই ভাওয়াইয়ার কথা ও সুরে।
লোকসঙ্গীত গবেষকেরা জানাচ্ছেন, সাধারণত সাম্প্রতিক ঘটনাবলীর প্রেক্ষাপটে ভাওয়াইয়া গান রচিত হয়। যেমন--১৯৩১ সালে রংপুরের আকাশে প্রথম বিমান ওড়ার কিংবা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে লালমণিরহাটে সেনাঘাঁটি তৈরি, কুড়িগ্রামে রেললাইন পাতার মতো ঘটনা নিয়ে ভাওয়াইয়া গান রয়েছে। কখনও কোনও ব্যক্তি বিশেষের জয়গাথা হিসেবে ভাওয়াইয়া গান বাঁধার রেওয়াজ প্রায় নেই। বিশেষত, রূপকার্থে হলেও নারী চরিত্রকে মাথায় রেখে ভাওয়াইয়া গান বাঁধার দৃষ্টান্ত মেলা দুষ্কর বলেই উত্তরবঙ্গের গায়ক তথা লোকসঙ্গীত গবেষক তারকনাথ ভট্টাচার্য মনে করেন। অথচ, জলবণ্টন চুক্তি নিয়ে মুখ্যমন্ত্রীর ‘অবস্থান’ সেই প্রথাতেও এনেছে ‘পরিবর্তন’। প্রায় ৬০০ কিলোমিটার দূরের বাসিন্দা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় হয়ে উঠেছেন তিস্তা পাড়ের আমজনতার ‘ঘরের মেয়ে’! |
এই ‘পরিস্থিতি’ ভাবাচ্ছে উত্তরবঙ্গের প্রবীণ বাম নেতাদের অনেককেই। গত বিধানসভা ভোটে উত্তরবঙ্গের ৫৪টি আসনের মধ্যে বামেরা মাত্র ১৬টি (২০০৬-এ ৪৯টি আসনের মধ্যে বামেদেরই ছিল ৩৭টি) পেয়েছেন। তৃণমূল ও কংগ্রেস জোট পেয়েছে ৩৩। কিন্তু দক্ষিণবঙ্গের তুলনায় উত্তরে মমতার ‘প্রভাব’ তেমন ‘সর্বময়’ হয়নি ভেবে কিছুটা স্বস্তিতেই ছিলেন বামেরা। এখন স্রেফ তিস্তা জল চুক্তি ‘বাতিল’ হওয়ায় দক্ষিণবঙ্গের পাশাপাশি, উত্তরবঙ্গের জনমানসেও মমতার জনপ্রিয়তা যে অতি দ্রুত ঊর্ধ্বগামী, তা কার্যত মেনে নিচ্ছেন অনেক বাম নেতাই। প্রাক্তন পুরমন্ত্রী অশোক ভট্টাচার্যের ‘সতর্ক’ প্রতিক্রিয়া, “উত্তরবঙ্গ তথা রাজ্যের স্বার্থকে প্রাধান্য দেওয়ার জন্য আমাদের সময়েও কেন্দ্র জলবণ্টন চুক্তি নিয়ে এগোতে পারেনি। আমরা যে কারণে তা করতে দিইনি, সে পথেই হেঁটেছেন মমতা। কিন্তু, আমরা রাজনৈতিক কর্তৃত্ব সুদৃঢ় করতে ওই ঘটনাকে ব্যবহার করতে পারিনি।” এ দিনও অশোকবাবু দাবি করেছেন, “মমতা তিস্তা নিয়ে উত্তরবঙ্গের মানুষের সংবেদনশীলতার ব্যাপারটা হাতিয়ার করে রাজনৈতিক লাভ ঘরে তুলতে চাইছেন” বা “জলবণ্টন চুক্তির চূড়ান্ত খসড়া না দেখেই মুখ্যমন্ত্রী প্রথমে বাংলাদেশে যাওয়ার কথা ঘোষণা করেছিলেন বলে ভাবতে পারছি না”। কিন্তু পাশাপাশি, মেনেও নিয়েছেন, “তিস্তা ও উত্তরের মানুষের যে গভীর সম্পর্ক, সে কথা মাথায় রেখেই এখন কোনও সমালোচনা করা ঠিক নয়।”
বস্তুত, তিস্তা ও উত্তরের বিস্তীর্ণ এলাকার মানুষের যে ‘প্রগাঢ় সম্পর্ক’ তাই-ই তাঁকে রাত জেগে গান লিখতে ‘বাধ্য’ করেছে বলে দাবি পঞ্চাশ ছুঁই ছুঁই আদতে কোচবিহারের ভাওয়াইয়া-শিল্পী সঞ্জীব মজুমদারের। প্রতিবাদী গানের নেশায় চাকরি খুইয়ে শিলিগুড়ির ইস্টার্ন বাইপাসের ঠাকুরনগর মোড়ে এখন পান-বিড়ির দোকান চালান তিনি। সঞ্জীব বললেন, “দিদি (মমতা) যে দিন বললেন, বাংলাদেশে যাবেন না, সে দিনই বুঝেছি কিছু একটা হবে। পরদিন বিকেলে খবরে শুনলাম, চুক্তিই বাতিল। রাতে ঘুমোতে পারিনি। আমার প্রাণের তিস্তাকে যে বাঁচাল, সে আমার ঘরের মেয়ে ছাড়া কী! এটা ভেবেই গান লিখে জনে জনে শোনাচ্ছি।”
সঞ্জীব একা নন, দিনহাটার ভাওয়াইয়া-শিল্পী আয়েষা সরকারের স্বামী মনিরুল ইসলাম লিখেছেন, ‘তিস্তা পাড়ের কন্যারে/মহাকরণে আছেন বসি/উত্তরবাংলা নিয়া ভাবেন তোমরা/তাই আমরা বেজায় খুশি...। আয়েষা বলেন, “তিস্তা নিয়ে গানের রেকর্ড আমারও আছে। কিন্তু মুখ্যমন্ত্রী যা করলেন, তাতে তিনিও যে তিস্তা পাড়ের কন্যা হয়ে উঠেছেন, তা নিয়ে সন্দেহ নেই।”
উত্তরবঙ্গের ক্ষেত্রে ভোটের স্লোগানের চেয়েও সুদূরপ্রসারী প্রভাব ভাওয়াইয়া গানের। ‘ফান্দে পড়িয়া বগা কান্দে’ থেকে ‘মৈষাল বন্ধু রে’--এখনও মুখে-মুখে ফেরে মাঠেঘাটে। এ কথা জানিয়ে কোচবিহারের লোকসংস্কৃতি গবেষক চন্দন পাল বলেন, “তিস্তা আমাদের উত্তরের সংস্কৃতির ধারক ও বাহক। সেই নদীর জল ভাগাভাগি হতে দেননি বলেই তিনি হয়ে উঠেছেন তিস্তাপারে র কন্যা। রাজনীতির কথা জানি না। এটুকু বলতে পারি, উত্তরের তিস্তা-নির্ভর মানুষের মনেপ্রাণ দখল করে নিয়েছেন মমতা।” একটু অন্য সুরও শোনা যাচ্ছে। যেমন ‘পশ্চিমবঙ্গ গণতান্ত্রিক লেখক শিল্পী সঙ্ঘ’-এর দার্জিলিং জেলার সম্পাদক পল্লবকান্তি রাজগুরু বলেছেন, “বাম-আমলেও তো রাজ্যের বাধায় তিস্তার জল-চুক্তি হয়নি। কিন্তু তা প্রচারের শিরোনামে আসেনি, এই যা।” পক্ষান্তরে, সিপিএমেরই দার্জিলিং জেলার এক প্রবীণ নেতা বলেছেন, “প্রচারমাধ্যমকে দোষ দিয়ে লাভ নেই। আমাদের দলের লেখক-শিল্পী সংগঠনের পক্ষ থেকে তখন রাজ্য সরকারের ভূমিকা নিয়ে প্রচারের কথা ভাবা হয়নি কেন? এখন স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে লোকে মুখ্যমন্ত্রীকে নিয়ে ভাওয়াইয়া গান বাঁধছে দেখে চটলে হবে?” |