|
|
|
|
কয়লার অভাবে ইউনিট পঙ্গু, বিপর্যয়ের ছায়া বিদ্যুতে |
নিজস্ব সংবাদদাতা • কলকাতা |
লোডশেডিং বুঝি দাপটে ফিরতে চলেছে পশ্চিমবঙ্গে।
এ আশঙ্কা বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোর অযোগ্যতা কিংবা সংবহন-পরিবহণে ত্রুটির জন্য নয়। এ বার ‘ভিলেন’ কয়লা। কয়লার অভাবে মঙ্গলবারই বসিয়ে দেওয়া হয়েছে কোলাঘাট তাপবিদ্যুতের দু’টো ইউনিট। উপরন্তু সাগরদিঘি, বক্রেশ্বর, ব্যান্ডেল, সাঁওতালডিহি সর্বত্র কোনও না কোনও ইউনিট বন্ধ হয়ে যাচ্ছে।
আর বিদ্যুৎ দফতরের এ দিনের হিসেব বলছে, রাজ্য বিদ্যুৎ উন্নয়ন নিগমের কুড়িটি ইউনিটের মধ্যে মঙ্গলবার চলেছে ১৪টি। এবং কয়লার টানাটানিতে অধিকাংশই পূর্ণ ক্ষমতায় উৎপাদন করতে পারছে না।
ফলশ্রুতি: রাজ্যে এ দিন বিদ্যুৎ ঘাটতি আড়াইশো মেগাওয়াট! কিন্তু কলকাতায় তো সেটা তেমন মালুম হল না?
বিদ্যুৎ দফতরের ব্যাখ্যা: কলকাতা ও আশপাশে উৎপাদন স্বাভাবিক রেখে আপাতত পরিস্থিতি সামাল দিচ্ছে সিইএসসি। তবে তারা একা কত দিন লড়তে পারবে, সে সম্পর্কে বিদ্যুৎ-কর্তারা সন্দিহান। কারণ, কলকাতায় নিরবিচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহের জন্য সিইএসসি-কে এখনও নিগমের উপরে নির্ভর করতে হয়।নিগমের উৎপাদন মার খেলে পরবর্তীকালে মহানগরে তার প্রভাব পড়তে বাধ্য।
এ বার দেখা যাক, নিগমের বিভিন্ন বিদ্যুৎকেন্দ্রে ‘কয়লা-পরিস্থিতি’ ঠিক কী রকম।
এ দিন সকালে কোলাঘাটে কয়লার মজুত এসে ঠেকেছে মাত্র সাড়ে ১১ হাজার টনে। এ দিকে কোলাঘাটের মোট ছ’টা ইউনিট চালাতে রোজ অন্তত ২০ হাজার টন কয়লা দরকার। অতএব বাধ্য হয়ে দু’টো ইউনিট বসিয়ে দিতে হয়েছে। বাকি চারটেতেও উৎপাদনমাত্রা কমিয়ে রাখা হয়েছে। সেগুলো পুরোদমে চললে ৮৪০ মেগাওয়াট পাওয়া যেত। এখন আসছে ৩৪৮ মেগাওয়াট। |
|
সঙ্কট-চিত্র
• রোজ দরকার ৫০ হাজার টন
• দাম ১০ কোটি টাকা
• দাম বকেয়া ৫৯০ কোটি টাকা
• রোজ আসছে ৩০ হাজার টন
• মোট ইউনিট ২০টি
• কয়লার অভাবে বন্ধ ৬টি
• বিদ্যুৎ ঘাটতি ২৫০ মেগাওয়াট
* সূত্র: বিদ্যুৎ উন্নয়ন নিগম |
|
অর্থাৎ স্রেফ কয়লার অভাবে ১০৬০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎকেন্দ্রের উৎপাদনক্ষমতা নেমে এল এক তৃতীয়াংশে!
অন্যত্রও অবস্থা তথৈবচ। যেমন, সাগরদিঘির দু’টো ইউনিটের একটা দিন পনেরো বন্ধ ছিল বলে ৫০ হাজার টন কয়লা রয়ে গিয়েছে বটে, কিন্তু ওই দু’টির পিছনে রোজ ৯ হাজার টন কয়লা পোড়ে। তাই কয়লার মজুত না-বাড়লে ক’দিনের মধ্যে সাগরদিঘিও খোঁড়া হয়ে যেতে পারে। বক্রেশ্বরে রোজ দরকার ১৫ হাজার টন, মজুত মাত্র ৩৯ হাজার। যা দিয়ে তিন দিনও চলবে না। ৫১০ মেগাওয়াট ক্ষমতার ব্যান্ডেলে এ দিন উৎপাদন হয়েছে সাকুল্যে ৭০ মেগাওয়াট। কারণ, এখানে পাঁচটা ইউনিটের তিনটিকেই বসিয়ে রাখতে হয়েছে কয়লার অভাবে। একই কারণে সাঁওতালডিহিতে দু’টো ইউনিটের একটা অকেজো।
এমতাবস্থায় নিগমের পাঁচটি বিদ্যুৎকেন্দ্রের জেনারেল ম্যানেজারদের প্রতি কর্তৃপক্ষের নির্দেশ: কয়লার অভাবে বিভিন্ন ইউনিট বন্ধ রাখা জরুরি। এই ফাঁকে সেগুলোর রক্ষণাবেক্ষণের কাজ সেরে নিতে হবে। কোন কেন্দ্রের কোন ইউনিট কবে বন্ধ হবে, বিদ্যুৎ দফতরকে তা জানাতে বলা হয়েছে। এতে লোডশেডিংয়ের আগাম একটা আঁচ মিলবে।
কর্তারা আশঙ্কায় ভুগলেও রাজ্যের বিদ্যুৎমন্ত্রী মনীশ গুপ্ত অবশ্য এ দিন বিদ্যুৎ ঘাটতির কথা অস্বীকার করেছেন। কয়লা মজুত না-থাকার কথাও মানতে চাননি তিনি। বরং মনীশবাবুর দাবি, “সব কেন্দ্রে ১০-১৫ দিনের কয়লা মজুত রয়েছে। কোনও দিন রেক না-এলে কিছুটা সমস্যা হয়। পর দিনই রেক চলে আসে। আমাদের সুবিধে, কয়লা আসে পাশের রাজ্য থেকে।”
মন্ত্রী ভরসা দিলেও তাঁর দফতরের হিসেবে সঙ্কটের ছবিটা পরিষ্কার। কয়লার জোগান এত কমল কেন?
বিদ্যুৎ-কর্তাদের বক্তব্য, কয়লার মূল্যবৃদ্ধির ফলে অর্থসঙ্কটে জর্জরিত বিদ্যুৎ সংস্থাগুলো মুশকিলে পড়েছে। বকেয়া না-মেটালে ধারে আর কয়লা মিলছে না। তাঁদের হিসেবে, রাজ্যে দৈনিক তিন হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে রোজ ১৬-১৭ মালগাড়ি কয়লা চাই। সে জায়গায় সোমবার এসেছিল মাত্র সাতটা। ইসিএল থেকে যেখানে মাসে একশো মালগাড়ি কয়লা পাওয়ার কথা, সেখানে অগস্টে মিলেছে মাত্র ১২ মালগাড়ি! যদিও বিদ্যুৎমন্ত্রীর মন্তব্য, “সব সময়েই বকেয়া থাকে। তার জন্য উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে না।”
বিদ্যুৎ-কর্তারা অবশ্য মহাকরণকে জানিয়ে দিয়েছেন, বকেয়া মেটানোর মতো টাকার জোগাড় না-হলে পরিস্থিতি আরও খারাপ হবে। অন্য সময়ে ব্যাঙ্ক থেকে স্বল্পমেয়াদে টাকা ধার করে সঙ্কট সামলানো হয়। কিন্তু এখন ব্যাঙ্কও বেঁকে বসেছে। এক বিদ্যুৎ-কর্তার কথায়, “কয়লার মূল্যবৃদ্ধির প্রেক্ষিতে বিদ্যুৎ সংস্থাগুলো জ্বালানি-সারচার্জ বাড়ানোর প্রস্তাব দিলেও রাজ্য রাজি হয়নি। মাসুল বাড়াতে দেওয়া হচ্ছে না। ভর্তুকিও নেই। তাই ব্যাঙ্ক ঋণ দিতে ভরসা পাচ্ছে না।”
সব মিলিয়ে অকূল পাথারে পড়েছেন বিদ্যুৎ-কর্তারা। তাঁদের ভরসা আপাতত আবহাওয়া। মেঘ এবং মাঝে-মধ্যে বৃষ্টির দরুণ দক্ষিণবঙ্গের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা এখন কিছুটা নিয়ন্ত্রণে। বিদ্যুৎমন্ত্রীও বলছেন, “তাপমাত্রা কম থাকলে এমনিতেই বিদ্যুতের চাহিদা কম থাকে। ঠিক যেমন এখন চলছে।”
তবে তাপমাত্রা বাড়লে লোডশেডিং যে মহানগরেও থাবা বসাবে, তা নিয়ে বিদ্যুৎ-কর্তাদের সংশয় নেই। |
|
|
|
|
|