ঘাটে ঘাটে বেহুলার ভেলা ভেসে যায়। লখীন্দরকে জড়িয়ে ধরে বেহুলার কাতর আর্তির, “শোন মাগো বিষহরি নমি তব পদে/ তোমার শরণ লই মাগো লখীন্দরের লাগি।” তাঁর আর্তি পাড় ছাপানো ভিড়ের মধ্যে ছড়িয়ে পড়েছে। মহিলারা আঁচল দিয়ে চোখের জল মুছছেন।
মঙ্গলবার বিকেলে পুঞ্চার কুলডি গ্রামের দৃশ্য। বিরাট পুকুর। কাঠ, বাঁশ দিয়ে তৈরি হয়েছে দশটি ঘাট। পুকুরের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে রঙিন কাগজের ঝালর ঝুলছে। বিশাল ভেলার উপরে মনসা মঙ্গলের কুশীলব ও বাদ্যযন্ত্রীরা। পুকুরের জলে ঘুরছে কুমীর, রঙীন মাছ, সাপ ইত্যাদি। সবই অবশ্য প্লাস্টিকের।
মাথায় পরচুলা চাপিয়ে বেহুলা সেজেছিলেন বছর পঁচিশের মহম্মদ। তিনি বলেন, “ছ’বছর ধরে মনসা মঙ্গলের বেহুলা সাজছি। লোকে আমার পালা দেখে প্রশংসা করে। খুব ভালো লাগে।” এই জলনাটিকায় অভিনয় করেন স্থানীয় জামবাদ পঞ্চায়েতের প্রধান মানিক রজক। তিনি অবশ্য, এবার বাবার মৃত্যুর জন্য পালা করতে পারেন নি। তিনি বলেন, “এ তো লোক সংস্কৃতির অঙ্গ। সব ধর্মের মানুষ এখানে আসেন। গ্রামের পুরুষরাই অভিনয় করেন।” তাঁর আক্ষেপ, “গত বছর বৃষ্টি না হওয়ায় পুকুর শুকিয়ে ছিল। তাই, পালা করা যায়নি।”
এই জলনাটিকার মূল ভাবনা রাবণ মাহাতোর। তিনি বলেন, “চাষই এই এলাকার মানুশের মূল জীবিকা। কুলডি গ্রামে এত দিন তেমন কোনও উৎসব হত না। তাই সবাই মিলে এই জলনাটিকার পরিকল্পনা নিই। পদ্মপুরাণ থেকে সংলাপ লেখা হয়েছে।” পালার এক মহিলা চরিত্রের ভূমিকায় অভিনয় করেন আসগর। তিনি বলেন, “আমাদের এই পালাকে ঘিরে গ্রামে উৎসব শুরু হয়ে যায়। আত্মীয়েরাও পালা দেখার জন্য আসেন।” পালার মহড়া শুরু হয় শ্রাবণ মাস থেকে। শ্রাবণ সংক্রান্তিতে মনসা পূজো হলেও প্রতিমা বিসর্জন হয় না। ১৯ ভাদ্র নির্ধারিত দিনে পালা হয়। পরের দিন প্রতিমা বিসর্জন হয়। কুলডি, জয়পুর, বানসা গ্রামের অবোধ মাহাতো, শর্মিলা মাহাতো, পূর্ণ সিং বলেন, সকাল থেকে আমরা পালা দেখতে চলে আসি।” পুকুরের পাড় ঘিরে লোকের ভিড়, নানা পসরা নিয়ে ভিড় করেছিলেন দোকানিরাও। রূপ নিয়ে মেলা। এক কথায়, বেহুলার ভাসান পালাকে ঘিরে সব ধর্ম মিলেমিশে একাকার। বেহুলার করুন আর্তিতে ফতেমা বিবিরও চোখ জলে ভরে ওঠে। ধর্মের সীমানা পেরিয়ে জয়ী হয় লোক সংস্কৃতির। |