বন্দুক নয়, তার বদলে ক্রিকেট ব্যাট।
গ্রেনেড ছোড়াছুড়ি নয়, বরং গুগলির রহস্যভেদে আকুল আগ্রহ।
মাইনের বদলে সবুজ মাঠে শুয়ে বিস্কুট রঙের বাইশ গজ। যেখানে দিন-ভর চলবে ব্যাট-বলের ঠুকঠুক।
টুকরো টুকরো ছবি। জঙ্গলমহলের। কারও বয়স সতেরো। কারও আঠেরো। কেউ জামবনির। কেউ শিলদার। কারও ঠিকানা শালবনি। কারও লালগড়। অধিকাংশই স্কুলপড়ুয়া। মঙ্গলবার দুপুরের জঙ্গলমহলের অন্দরমহল, যেখানে ক্রিকেটের ‘মাইন’ পুঁতে ফেলল সিএবি। |
ঝাড়গ্রাম রাজবাড়ির মাঠে সকাল থেকে থিকথিকে ভিড়। অন্তত সাড়ে তিনশো স্কুলপড়ুয়ার জমায়েত। উদ্দেশ্য, ক্রিকেট। আর প্র্যাক্টিসের মহড়াতেও তো ভারী ভারী নাম। জাতীয় ক্রিকেট অ্যাকাডেমির ডিরেক্টর সন্দীপ পাটিল। নাইট রাইডার্স কোচ ডাভ হোয়াটমোর। সিএবি কর্তারা প্রথমে আঁচ পাননি যে, উৎসাহের পারদ কোথায় চড়তে পারে। ঠিক ছিল, আপাতত দিন সাতেকের একটা শিবির হবে। তার পর জানুয়ারি মাসে হবে আন্তঃস্কুল টুর্নামেন্ট। কিন্তু এখন বদলে গিয়ে শিবিরের মেয়াদ দশ দিন। ইতিমধ্যেই কলকাতা থেকে হাজির আট জন কোচ। সিএবি এ দিনই জানিয়ে দিল, দশ জন ক্রিকেটারকে বাছা হবে প্রথমে। তার পর তাদের ঠিকানা হবে কলকাতা। সঙ্গে প্রাপ্তি স্থানীয় লিগে খেলার টিকিট। এবং শুনে আবেগের এমনই বিস্ফোরণ হল যে পাটিল পর্যন্ত বলে ফেললেন, “ক্রিকেটের কাজে বহু জায়গায় গিয়েছি। কিন্তু এমন আবেগ কোথাও দেখিনি। জানুয়ারিতে আবার আসব।”
পাটিলের আবেগে ভেসে যাওয়াতে আশ্চর্যের কিছু নেই। বরং অবাক লাগতে পারে কঠিন জীবনযুদ্ধ সামলে ওই সব ক্রিকেটছাত্রের ক্রিকেটের প্রতি বেঁচে থাকা ভালবাসা দেখলে। মাওবাদী আন্দোলনের সময় অনেককেই যেতে হয়েছে মিটিং-মিছিলে। তালা ঝুলেছিল ঝাড়গ্রামের ক্রিকেট কোচিং সেন্টারে। দিনের পর দিন ঘরে বন্দি থাকতে হত। স্কুলের পাট চুকে গিয়েছিল। তবু লুকিয়ে-চুরিয়ে চলত ক্রিকেট। ব্যাট ছিল না, থাকত টেনিস র্যাকেট। পিচ ছিল না, মাঠের ধান কাটার পর জমিতে গাছের গুঁড়ি চালিয়ে তৈরি হত বাইশ গজ। কলকাতা থেকে যাওয়া ময়দানের এক কোচ বলছিলেন, “এদের অনেকেই এখনও ডিউস বল কাকে বলে জানে না।” “সম্ভব ছিল না। সামর্থ্যও ছিল না। এক সময় ক্রিকেট চালু হয়েও বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। আজ ফের চালু হয়েছে ঠিকই, কিন্তু ফের যদি গণ্ডগোল হয়?” আশা-আশঙ্কার মাঝে ভাসছিলেন লালগড়ের যুবক অভিরূপ দাস। শালবনির শুভাশিস মাহাতোর আবার বিশ্বাস, জ্ঞানের আলো ক্রিকেটই ফিরিয়ে দিতে পারে। “এই অন্ধকার অবস্থাটা থেকে বেরোতে চাই। ক্রিকেটটা ভাল করে খেললে, সুস্থ জীবনে আবার ফিরতে পারব।” একটাই শুধু আক্ষেপ। পাটিলকে এত কাছে পেয়েও টিপস নেওয়া গেল না। সিএবি কর্তারা সময় নিয়ে একটু দূরদর্শিতা দেখালে সেটাও সম্ভব হত। “ঠিক আছে, উনি তো আসবেন আবার জানুয়ারিতে। তখন সব জানব। এখন মন দিয়ে প্র্যাক্টিসটা করি,” বলে চলেন শালবনির শুভাশিস। জঙ্গলমহলে বন্দুক এখন অতীত, ক্রিকেট অনেক বেশি বর্তমান। কে বলতে পারে, ভবিষ্যতের মনোজ-ঝদ্ধিরা এখান থেকেই উঠে আসবে না? |