অণ্ণা-গ্রামে
সহমতে ভরসা রেখেই উন্নয়ন পেয়েছে রালেগণসিদ্ধি, সুশাসনও
দ্মাবতী মন্দির চত্বরে তিনশো বছরের পুরনো সহস্র ঝুরির বটগাছ। তার তলায় বসে রয়েছেন কপর্দকহীন বৃদ্ধ। খর্বকায়। তিনটি প্লাস্টিকের চেয়ার একের পর এক রেখে তবে তাঁকে সব দর্শনার্থীর চোখের নাগালে আনা গিয়েছে। মানুষটি বলে চলেছেন, ‘‘কুড়ি বছর ভ্রষ্টাচারের বিরুদ্ধে লড়ছি। রাজ্যের তিন জন ক্যাবিনেট মন্ত্রীর উইকেট নিয়েছি আমি।’’ গোয়া, রাজস্থান, দিল্লি থেকে আসা মানুষ হাততালি দিচ্ছেন বারবার, মিডিয়া ধরে রাখছে তাঁর প্রতিটি কথা।
পুণে থেকে প্রায় ৮০ মাইল দূরের গ্রামটি, রালেগণসিদ্ধি। অণ্ণার ১৪টি অনশনের ১১টিই এই গ্রামে, যাদববাবার মন্দিরে। সেই মন্দিরের একটি ছোট ঘরেই তাঁর আস্তানা। অণ্ণার দুর্নীতি-বিরোধী অভিযান আর সহমতের রাজনীতির আঁতুড়ঘর এই গ্রাম।
এ গ্রামের গ্রামসভায় স্থির হয়ে যায়, গ্রামের উন্নয়নের জন্য কী কী হবে। পঞ্চায়েত কেবল টাকা আনবে আর খরচের হিসেব দেবে। নীতি নির্ধারণ, উন্নয়নের রূপরেখা, প্রকল্পের পরিকল্পনার জন্য পঞ্চায়েত বা রাজনৈতিক দল বা সরকারি কর্তাদের উপর ভরসা করতে রাজি নন অণ্ণা। সরকারের তিজোরিতে মানুষেরই পয়সা রয়েছে। তাই পয়সা দেবে সরকার, আর সহমতের ভিত্তিতে প্রকল্প নির্ধারণ করবে গ্রামবাসী, এই হচ্ছে অণ্ণার বক্তব্য। শিক্ষক দিবসে অণ্ণার আহ্বান, ‘‘ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত হওয়ার জন্য ভ্রষ্টাচার বেড়ে গিয়েছে। মদ বেশি খেলে যা হয়, অত্যধিক ক্ষমতা পাওয়ায় এই সরকারের তাই হয়েছে। লোকশাহী মানে, লোকের মতই যেখানে প্রধান। কিন্তু পুরো কাজ করছে অফিসার আর মন্ত্রী। মানুষের সহমত নিয়ে তবে কাজ করতে হবে। যা খরচ হবে সব ইন্টারনেটে প্রকাশ করতে হবে।’’
রাজনীতিকে ভ্রষ্টাচার মুক্ত করতে অণ্ণার সহজ দাওয়াই, মানুষ দেখে নির্বাচন করো। কেবল সৎ মানুষকেই নির্বাচন করো। অণ্ণার গ্রাম এই নীতিতেই চলে। গ্রামের গৃহবধূ অলকা দসরে বললেন, ‘‘আমাদের পঞ্চায়েতে যে নির্বাচন হয়, সে তো গ্রামসভাতেই সব ঠিক হয়ে যায়। অণ্ণাই বলেন, এরা এরা দাঁড়াতে চায়, বলো তোমরা কাকে চাও। সবাই যার জন্য হাত তোলেন, সে-ই হয় সরপঞ্চ।’’ এ ভাবেই কিসান পাঠারে দু’বার জিতেছিল, কোনও নির্বাচন ছাড়াই। এ বার দাঁড়ালে কয়েক জন আপত্তি করায় অণ্ণা নির্বাচনের পথে যান। কিসান হেরে যান, আসেন জয় সিংহ মাতরে। গণেশ পুজো মহারাষ্ট্রে হয় প্রতি মহল্লায়। অণ্ণার গ্রামে একটাই পুজো ‘এক গাঁও, এক গণপতি’। সেখানে সকলেই যোগ দেয়। সংবর্ধনা দেওয়া হয় বৃদ্ধদের এবং গ্রামের নতুন বউদের, বললেন কলেজছাত্র শ্যাম যাদব পঠারে বালু। বক্তৃতা হয় সন্ধ্যায়, সেখানে ভ্রষ্টাচারের সঙ্গে ভ্রূণহত্যার প্রসঙ্গও আসে।
রালেগণসিদ্ধি এখন অতি সমৃদ্ধ গ্রাম, দিনমজুরির রেট দুশো টাকা। সকলে খেতিবাড়ির কাজে লেগে আছে বলে একশো দিনের কাজের চাহিদাই নেই। জোয়ার, বাজরা, গম নিজেরাই এর ওর সাহায্যে আহমদনগর বা পুণেয় গিয়ে বিক্রি করে আসেন। “এ বছর আমরা দেড় কোটি টাকার পেঁয়াজ বিক্রি করেছি”, বললেন গ্রামের সরপঞ্চ জয়সিংহ রাও মাতারে।
এই সমৃদ্ধির পিছনে রয়েছে অণ্ণা হজারের ২৫ বছরের প্রয়াস। গ্রামের চার পাশে ঘিরে থাকা পশ্চিমঘাট পাহাড়ের গা ঘিরে কাটা রয়েছে ‘ট্রেঞ্চ’ বা খাদ। মাটির বাঁধ, আলগা পাথর জড়ো করে বাঁধ, কোথাও বা রয়েছে সিমেন্টের বাঁধ। আর রয়েছে ১৩০ মিটার লম্বা মাটির দেওয়াল, যা ৩০ হেক্টর এলাকা জুড়ে জলাধার তৈরি করেছে। বৃষ্টি এখানে অল্প, কারণ গোটা এলাকাটাই ‘রেন শ্যাডো এরিয়া’। কিন্তু সেই জলের এক বিন্দুও নষ্ট যাতে না হয়, সে কাজটাই অণ্ণা শুরু করেছিলেন ২৫ বছর আগে। মাটিতে জলস্তর বাড়তে থাকে, কুয়োয় জল ওঠে, তা থেকে পাম্প-পাইপে জল আসে খেতে।
দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়া অণ্ণা এই উন্নয়ন সম্ভব করেছেন একটাই মন্ত্রে সততায় ভরসা করে সহযোগিতা। ফৌজি জীবন থেকে অবসরের পর অণ্ণা তাঁর শেষ সম্বলও গ্রামের জন্য খরচ করেছেন। আবার তাঁর প্রতি আস্থায় গ্রামবাসীরাও বিনা মজুরিতে শ্রমদান করেছেন। আজও সে নিয়ম জারি রয়েছে যাঁরা নিজেরা কাজ করবেন না, তাঁদের মাসে দু’দিন মজুরির পয়সা দিতে হবে। সহযোগিতার ভিত্তিতেই চলছে সমবায়। নিজেরা সমবায়ভিত্তিক ডেয়ারি বানানোর ফলে আশেপাশের গ্রামের চেয়ে রালেগণসিদ্ধির মানুষ বেশি দাম পান চিলিং প্ল্যান্টগুলো থেকে।
উন্নয়নের এমন মডেল কম হলেও ব্যতিক্রমী নয় অবশ্য। বিকল্প নীতিতে জল ধরে আবাদ বাড়ানোর দৃষ্টান্ত রয়েছে নানা রাজ্যেই। আহমদনগরের কিছু কিছু গ্রাম এ বিষয়ে রালেগণসিদ্ধিকেও ছাড়িয়ে গিয়েছে। কিন্তু রালেগণসিদ্ধি ব্যতিক্রম অন্য কারণে। আড়াই হাজার পরিবারের গ্রামে প্রায় পাঁচশো দলিততাঁদের ঋণ ছিল প্রায় ষাট হাজার টাকা। অণ্ণার নেতৃত্বে গ্রামের মানুষ সিদ্ধান্ত নিয়ে ওই ঋণ শোধ করে দেন ক্রমশ। মাহার, চামার, মাং পরিবারগুলি এখন দারিদ্র্য থেকে বেরিয়ে আসতে পারছেন গ্রামে বিপিএল পরিবার দেড়শো থেকে কমে এখন দাঁড়িয়েছে পঞ্চাশেরও কম, জানালেন পঞ্চায়েত কর্তারা।
কোন জাদুমন্ত্রে? সহমতের রাজনীতি। প্রবক্তার নাম, অণ্ণা হজারে।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.