গোটা সফরেই তিস্তার ছায়া রয়ে গেল। তবে দিনভর কূটনীতি আর আন্তরিকতা দেখিয়ে দিনের শেষে সেই ছায়া অনেকটা সরিয়ে দিতে সক্ষম হলেন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহ।
আজ সকালে এক অন্য ঢাকায় পা রেখেছিলেন মনমোহন। আপ্যায়ন ছিল, কিন্তু তার সঙ্গে ছিল আড়ষ্টতাও। সফর শুরুর কয়েক ঘণ্টা আগে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের আপত্তির জেরে তিস্তা জলবণ্টন চুক্তি থেকে দিল্লির পিছিয়ে যাওয়াতেই এই আড়ষ্টতা। তিস্তা চুক্তি বাতিলের জন্য বাংলাদেশের প্রায় সব সংবাদমাধ্যমই মনমোহনের তীব্র সমালোচনা করেছে। শেখ হাসিনার সরকারের শরিক দলগুলির নেতারা প্রকাশ্যেই বলেছেন, “বাংলাদেশ ‘পানির দেশ’। পানি-ই যদি না মিলল, তবে কী লাভ আর সব চুক্তিতে!” এমনকী কয়েক জন গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রী প্রকাশ্যে এমন বিবৃতিও দিলেন যে, “ওরা তিস্তার জল দিচ্ছে না, আমরাও ওদের ট্রানজিটের সুযোগ দেব না।” যার রেশ ধরে ফেনীর জলবণ্টন নিয়ে চুক্তিই করল না ঢাকা। এমনকী একটা সময় ছিটমহল নিয়ে চুক্তি করতেও রাজি হচ্ছিল না তারা। এমন একটা পরিস্থিতির মধ্যেই শেখ হাসিনার সঙ্গে বৈঠকে বসলেন মনমোহন। সেই বাধো বাধো ভাব নিয়েই। এবং শেষ পর্যন্ত অস্বস্তির মেঘ অনেকটাই সরিয়ে দিতে পারলেন। হাসি ফুটল হাসিনার মুখেও। নিজের বক্তৃতায় মনমোহনের এই সফরকে ‘ফলপ্রসূ’ বলেই অভিহিত করলেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী। হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন কূটনীতিকরাও। |
‘ফলপ্রসূ’ সফরের আলো পড়ল দু’দেশের মধ্যে করা একাধিক চুক্তিতেও। যার মধ্যে ছিটমহল, সীমান্ত চুক্তি, শুল্ক ছাড়, ভারতের মধ্যে দিয়ে পণ্য পরিবহণের জন্য ঢাকাকে ট্রানজিট দেওয়ার মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলি রয়েছে। সাতচল্লিশে দেশ ভাগের পর থেকেই সীমান্ত নিয়ে দু’দেশের বিবাদ। ১৯৭১ সালে পূর্ব পাকিস্তান স্বাধীনতা পেয়ে হয়েছে বাংলাদেশ হলেও উত্তরবঙ্গ, অসম আর মেঘালয়ে দু’দেশের সীমান্ত নিয়ে মতভেদ এত দিন মেটেনি। আজ সেই সমস্যার আনুষ্ঠানিক সমাধান হল। নতুন সীমান্ত মানচিত্রের প্রতিলিপির শেষ পাতায় স্বাক্ষর করলেন দুই প্রধানমন্ত্রী।
বাংলাদেশের মাটিতে ভারতের ১১১টি ছিটমহল, ভারতে বাংলাদেশের ৫১টি। ১৯৭৪ সালে সীমান্ত নিয়ে ইন্দিরা-মুজিব চুক্তিতে এই সমস্যা মিটিয়ে ফেলার অঙ্গীকার করেছিল দুই দেশ। কিন্তু আজও তা হয়নি। সেই চুক্তির আলোয় আজ নতুন প্রোটোকল স্বাক্ষর করেছেন দুই বিদেশমন্ত্রী এস এম কৃষ্ণ এবং দীপু মণি। এতে ছিটমহল হস্তান্তরে সম্মত হয়েছে দুই দেশ। সেই সঙ্গে ঠিক হয়েছে, হস্তান্তর না হওয়া পর্যন্ত বাংলাদেশের দুই ছিটমহল দহগ্রাম ও আংরাপোতায় যাওয়ার জন্য তিনবিঘা করিডর এ বার থেকে ২৪ ঘণ্টাই খোলা থাকবে। এখনই হয়তো সব সমস্যা মিটছে না। কিন্তু, সমাধানের লক্ষ্যে এই যে অগ্রগতি, এর দামও তো কম নয়। দু’দেশের সম্পর্ক উন্নয়নে এর প্রভাব পড়বে।
বাংলাদেশ অবশ্য ভারতকে এখনই চট্টগ্রাম ও মংলা বন্দর ব্যবহারের সুযোগ ও ট্রানজিটের সুযোগ দিতে রাজি হয়নি। বৈঠকে নিজেদের সমস্যাগুলি বিস্তারিত ভাবে ব্যাখ্যা করেছেন বাংলাদেশের প্রতিনিধিরা। রয়েছে নিরাপত্তা নিয়ে প্রশ্ন। সঙ্গে রাজনৈতিক বাধ্যবাধকতার বিষয়টিও। ভারত ঢাকার ব্যাখ্যা গুরুত্ব দিয়েই শুনেছে। কিন্তু ট্রানজিটের বিষয়টি নিয়ে এত ছুঁৎমার্গ যে কাজের নয়, তা প্রমাণ করতেই যেন বাংলাদেশকে ট্রানজিটের সুবিধা দেওয়ার কথা ঘোষণা করেছে। উত্তরবঙ্গ হয়ে বাংলাদেশের পণ্যবাহী ট্রাক এখন অনায়াসে যাতায়াত করবে তৃতীয় দেশ নেপালে। এতে বাণিজ্য বাড়বে বাংলাদেশের। নিজেরা ঢাকার থেকে ট্রানজিটের সুযোগ না পেলেও সে সুযোগ দেওয়ার উদারতা দেখিয়েছে দিল্লি।
আর একটি বিষয় বাণিজ্য ভারসাম্য। ৬১টি পণ্যের শুল্কমুক্ত রফতানির সুযোগ পেল ঢাকা। এর মধ্যে ৪৬টি পোশাক ও বস্ত্র। ঢাকার যুক্তি, বাংলাদেশ এই পণ্য রফতানির সুযোগ পেলে
দু’দেশের বাণিজ্যের ভারসাম্য অনেকটাই ফিরবে। তৈরি হয়েই এসেছিলেন মনমোহন। এর জন্য দেশের শক্তিশালী বস্ত্রশিল্প মহলের চাপকেও তিনি গ্রাহ্য করেননি। হাসিনা এই পদক্ষেপের জন্য ধন্যবাদ জানিয়েছেন মনমোহনকে। আর মনমোহন বলেছেন, “বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ককে সর্বাধিক অগ্রাধিকার দেওয়াটা দিল্লির নীতি এবং এ বিষয়ে পূর্ণ রাজনৈতিক ঐকমত্য রয়েছে ভারতে। অতীতের ভুল বোঝাবুঝি ছেড়ে এখন উন্নয়নের পথে হাঁটার সময়। এক মাত্র সেই পথেই অশিক্ষা, মৌলবাদ ও সন্ত্রাসকে প্রতিহত করা সম্ভব।” দু’দেশের সম্পর্কের দিকচিহ্ন নির্দেশ করে তাই একটি চুক্তি আজ সই করেছেন দুই প্রধানমন্ত্রী। তাতে উন্নয়নের পথে পারস্পরিক সহযোগিতার অঙ্গীকারই করা হয়েছে। দিনশেষের এই হৃদ্যতার ছায়া অবশ্য গোড়ায় ছিল না। একটা সময় এমন ধারণাও তৈরি হচ্ছিল যে, সফরের মূল উদ্দেশ্যটাই জলে যাবে নাতো? দু’দেশের সরকারের শীর্ষ নেতাদের পাশাপাশি এই সফরকে ‘ঐতিহাসিক’ করে তুলতে প্রায় দু’বছর ধরে কম পরিশ্রম করেননি দু’দেশের কূটনীতিকরাও। শুধু তো জলবণ্টন নয়, বকেয়া সমস্যাগুলির সন্তোষজনক সমাধানের পথ খুঁজে, বাণিজ্য ভারসাম্য গড়ে তুলে দু’দেশের সম্পর্ককে একটি দীর্ঘস্থায়ী মাত্রা দিতে চেয়েছেন তাঁরা। কিন্তু তিস্তা নিয়ে হঠাৎই তৈরি হওয়া জটিলতাই তুলে ধরছিল প্রশ্নচিহ্ন। দিনের শেষে অবশ্য সব আশঙ্কা অমূলক বলেই প্রমাণিত হল। সন্তুষ্ট শেখ হাসিনা। কিন্তু এই পট পরিবর্তনের জন্য অনেক বেশি পরিশ্রম করতে হল ‘টিম মনমোহনকে’। বাড়তি পরিশ্রম, সঙ্গে বাড়তি সহনশীলতাও। আর তাতেই এল সাফল্য। |