|
|
|
|
চুক্তি আটকাল কেন, দিনভর ব্যাখ্যা দিল্লির |
জয়ন্ত ঘোষাল • ঢাকা |
বারো বছর পরে দ্বিপাক্ষিক সফরে ঢাকায় পা রাখলেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী। তাঁর অভ্যর্থনায় উনিশ বার তোপধ্বনি হল। হজরত শাহ জালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে তাঁকে গার্ড-অফ-অনার দিল তিন সেনাবাহিনী। প্রোটোকল ভেঙে দেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা স্বাগত জানালেন মনমোহন সিংহ ও তাঁর স্ত্রী গুরশরণ কউরকে। বিমানবন্দরের চার দিকে মনমোহন আর হাসিনার বিশাল রঙিন ছবি। উড়ছে দু’দেশের জাতীয় পতাকা, উড়ছে বেলুন। কিন্তু ঘটনা হল, যে সফরে কথা ছিল, মনমোহন আসবেন, দেখবেন এবং জয় করবেন, তিস্তা তার সুরটাই কেটে দিয়েছে।
এত দিনের আলাপ-আলোচনার পরও, তিস্তা চুক্তি কেন হচ্ছে না, সেটা জানতে আজ ভারতের হাইকমিশনার রজিত মিটারকে ডেকে পাঠান বাংলাদেশের বিদেশসচিব মিজারুল কায়েশ। চুক্তি না হওয়ায় অসন্তোষও প্রকাশ করেন তিনি। এমনকী মনমোহন ঢাকায় পৌঁছনোর আগেই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিদেশ সংক্রান্ত উপদেষ্টা গওহর রিজভি বলেন, “পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী যে এলেন না, তাতে আমরা হতাশ। প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে জানতে চাইব, কেন এমন হল।” |
কী হল |
ঐতিহাসিক সীমান্ত চুক্তি |
১৬২ ছিটমহল হস্তান্তর |
তিনবিঘা ২৪ ঘণ্টা খোলা |
৬১ পণ্যে শুল্কছাড় দিল্লির |
|
তিস্তা চুক্তি না হওয়াটা বাংলাদেশের মননে ভারত-বিরোধী অনুভূতি উসকে দিয়েছে। তিস্তার জলের দাবিতে আজ দেশের সব নদীতে নৌকা মিছিল হয়েছে। সেই মিছিলে ফেস্টুন উড়েছে, ‘তিস্তার ন্যায্য পানির দাবি, ভারতের কাছে ন্যায্য দাবি’। অন্য দিকে শহরের রাস্তার দু’ধারে দাঁড়িয়ে সাধারণ মানুষ দাবি জানাচ্ছেন, ‘আমাদের ন্যায্য পানি চাই’।
পশ্চিমে আফগানিস্তান-পাকিস্তানে যেটা করতে পারছেন না, পূর্বে নেপাল-ভুটান-বাংলাদেশকে নিয়ে সেই আঞ্চলিক অক্ষ তৈরির কাজ এই সফরে করতে পারবেন বলে ভেবেছিলেন মনমোহন। সেটা যে পুরোপুরি ভেস্তে গিয়েছে, তা নয়। আগামী দিনে তিস্তা চুক্তি হবে না, এমনও নয়। কিন্তু এই সফরেই তা হয়ে গেলে আজ ঢাকায় বিজয় উৎসব হত, বাজি-পটকা ফাটত।
উল্টে আজ যখন বাংলাদেশের বিদেশমন্ত্রী দীপু মণি সোনার গাঁও হোটেলের সুরমা স্যুইটে মনমোহনের সঙ্গে দেখা করতে এলেন, অথবা মনমোহন যখন প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে শিমূল কক্ষে হাসিনার সঙ্গে দেখা করতে গেলেন, তখন বড় দাদার ছোট ভাইকে ঔদার্য দেখানোর বদলে তিস্তা চুক্তি করতে না পারার ব্যাখ্যা দিতে হল ভারতকে। মনমোহন অবশ্য হাসিনাকে আশ্বাস দিলেন, আপনারা দুশ্চিন্তা করবেন না, তিস্তা চুক্তি আমরা করবই।
কিন্তু তাতে বরফ যে খুব গলল, এমন নয়। ফেনী নদীর জলবণ্টন নিয়ে কোনও চুক্তি আজ ঢাকা করল না। পূর্ণাঙ্গ চুক্তি হল না পণ্য চলাচলের জন্য ভিন দেশের মাটি ব্যবহার (ট্রানজিট) নিয়েও। বাংলাদেশের পক্ষ থেকে জানিয়ে দেওয়া হল, তিস্তা চুক্তি না হলে ট্রানজিট দেওয়ার বিষয়েও সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে না। দেশের অর্থমন্ত্রী এ এম এ মুহিত বলেন, “ট্রানজিট সুবিধা দিতে দিতে আগামী বছর হয়ে যাবে।” ভারতের পক্ষে বিদেশ মন্ত্রকের এক কর্তা যার ব্যাখ্যা দিয়ে বলছেন, আপাতত রাস্তা ও অন্যান্য পরিকাঠামো তৈরি করা হোক। তার পরে ব্যবসা-বাণিজ্যের জন্য ট্রাক নিয়ে যাওয়ার দাবি উঠবেই। তখন সেটা অনেক বেশি কার্যকর হবে। (দিল্লি অবশ্য এখনই বাংলাদেশি ট্রাক ভারত দিয়ে নেপালে যেতে দিতে সম্মত।) ছিটমহল হস্তান্তর চুক্তি করতেও রাজি হচ্ছিল না ঢাকা। দিল্লির কর্তারা বহু কষ্টে তাদের রাজি করান। |
কী হল না |
তিস্তা, ফেনি জল-চুক্তি |
পূর্ণাঙ্গ ট্রানজিট সমঝোতা |
|
আসলে তিস্তা চুক্তি না হওয়া পর্যন্ত দু’দেশের সম্পর্কের উষ্ণতা যে ফিরবে না, সেটা বিলক্ষণ বুঝতে পারছে কূটনৈতিক মহল। এই প্রতিকূল পরিস্থিতিকে অনুকূলে আনার জন্য আজ দিনভর প্রবল প্রয়াস চালিয়েছেন ভারতের কূটনীতিকরা। আসরে নেমেছেন মনমোহনও। ঢাকাকে ভারতের অভ্যন্তরীণ সমস্যা জানানোর পাশাপাশি এ-ও বলেছেন যে, তিস্তা চুক্তি করতে দিল্লি বদ্ধপরিকর।
পরে সাংবাদিকদের তিনি বলেন, “দু’দেশের মধ্যে দিয়ে প্রবাহিত নদীগুলির জলবণ্টন নিয়ে আলোচনায় যথেষ্ট অগ্রগতি হয়েছে। তবে জলবণ্টন নিয়ে কোনও দেশে যাতে বাধা তৈরি না হয়, তা নিশ্চিত করার জন্য আরও আলোচনার প্রয়োজন।” বস্তুত, মমতার আপত্তি দূর করাই এখন কেন্দ্রীয় সরকারের বড় মাথাব্যথা। ভারতের বিদেশসচিব রঞ্জন মাথাই গত কালই জানিয়ে দিয়েছেন, যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোয় কোনও অঙ্গরাজ্যের সম্মতি ছাড়া আন্তর্জাতিক চুক্তি করা সম্ভব নয়।
দিল্লির সরকারি সূত্রে খবর, তিস্তা চুক্তির নতুন যে খসড়া তৈরি হচ্ছে, নির্দিষ্ট ভাবে কত কিউসেক হারে জল বাংলাদেশ পাবে, তা বলা থাকবে না। শতাংশের একটা হিসেব থাকবে বটে, কিন্তু তা-ও বছরভর নির্দিষ্ট হারে নয়। কারণ, তিস্তা দিয়ে সারা বছর এক পরিমাণ জল প্রবাহিত হয় না। হাইড্রলিক ইঞ্জিনিয়াররা এখন গোটা বিষয়টা খতিয়ে দেখবেন। তার পর অন্তর্বর্তী চুক্তি হবে। তা ছাড়া, সিকিমের সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গেরও আলাদা করে সমঝোতা হওয়া দরকার। উজানের রাজ্য সিকিম কতটা জল নেবে, তার উপরেই নির্ভর করবে পশ্চিমবঙ্গে তিস্তায় কত জল মিলবে। রাজ্যের অভিযোগ, গঙ্গা চুক্তির সময় বিহার বা উত্তরপ্রদেশের সঙ্গে এই বোঝাপড়া না হওয়ায় তারা অনেক বেশি জল টেনে নেয়। বাংলাদেশকে দিয়ে রাজ্যের জন্য আর যথেষ্ট জল থাকে না। যার জেরে মরতে বসেছে হলদিয়া বন্দর। গঙ্গার ড্রেজিং বা সঙ্কোশ নদীর জল বাংলাদেশের মধ্যে দিয়ে খাল কেটে গঙ্গায় এনে ফেলার যে প্রতিশ্রুতি কেন্দ্র দিয়েছিল, তা-ও রাখা হয়নি। তবে তিস্তা চুক্তি না হওয়ায় শেখ হাসিনা অসন্তুষ্ট হলেও মনে করছেন, চুক্তি অর্ধেক হওয়ার থেকে ভাল ভাবে হওয়া ভাল। সে জন্য তিনি নিজেও মমতার সঙ্গে যোগসূত্র গড়ে তুলেছেন। হাসিনার দূত হয়ে সাংবাদিক বেবি মওদুদ মহাকরণে গিয়ে মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করেছেন। তবে একটা নির্দিষ্ট সময়সীমার মধ্যে তিস্তা চুক্তি করতে চাইছে ঢাকা। যার উত্তরে দিল্লি বলেছে, সময় বেঁধে নয়, তবে যত শীঘ্র সম্ভব চুক্তি করা হবে। |
|
|
|
|
|