মধ্য-জ্যৈষ্ঠের বেলা দুপুর। সূর্যরোষে দগ্ধ পথঘাট। বাস এসে দাঁড়াল নীলরতন হাসপাতালের সামনে। কন্ডাক্টর উদ্গ্রীব। ধর্মতলা-বাবুঘাট, ধর্মতলা-বাবুঘাট। উদাত্ত আহ্বানে সাড়া মিলল না তেমন। ক্ষণিক স্থিতির পরে বাস ফের মৃদুগতি। আর তখনই এক কাণ্ড।
পাদানি ঠেলে কোনও ক্রমে ওপরে উঠে এল এক জন। আদুল গা, জীর্ণ ধুতি। খঞ্জ সে, চলমান বাসে এক পায়ে ভর দিয়ে দাঁড়াল কোনও ক্রমে। তার করুণ দশায় ভাবান্তর হল না কন্ডাক্টরের। সে বরং অতি তৎপর। টিকিট? কর্কশ চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি মানুষটি অসহায়। শুধু চোখের দৃষ্টিতে বুঝিয়ে দিল, যাত্রী হওয়ার যোগ্যতা অর্জনে করুণা ভিন্ন আর কোনও সম্বল নেই তার। ফল হল না ভিক্ষার আবেদনে। বাসের প্রহরী বরং ক্রুদ্ধ।
তার হ্যাঁচকা টানে বাজল বাস থামার ঘণ্টি। নামো, নামো বাস থেকে। হুঙ্কারে খঞ্জ মানুষটি বেসামাল। ততক্ষণে তার পিঠে ধাক্কা পড়েছে কন্ডাক্টরের। ভিক্ষা অমিল বুঝে খোঁড়া পায়ে একটু-একটু করে পাদানি ভাঙছেও সে। কিন্তু, প্রহরীর তাড়া বড়। সুতরাং, কপর্দকশূন্য মানুষটিকে এ বার বড়সড় ধাক্কা। ছুড়ে ফেলার ভঙ্গিতে। বাস থেকে ছিটকে পড়ল করুণা-প্রত্যাশী খঞ্জ। দলা পাকানো মাংসপিণ্ড যেন। বাস ততক্ষণে বেগবান। সে-দিকে তাকিয়ে রইল আশাহত মানুষটি। কী ভাবল? গাল দিল কি কন্ডাক্টরকে? নিজের শারীরিক অক্ষমতাকে? না কি কুর্নিশ জানাল নিজের ভাগ্যকে? ধাক্কায় পড়ে গিয়েও প্রাণে তো বেঁচে গেল শেষ পর্যন্ত। আর একটু হলেই যে চলে যাচ্ছিল বাসের চাকার তলায়!
নিষ্ঠুরতার নির্লজ্জ নিদর্শন পিছনে রেখে এগিয়ে চলল বাস। যেন কিছুই হয়নি, এ ভাবে। বিনা ভাড়ার যাত্রী খেদানোর খুশিতে তৃপ্ত কন্ডাক্টর ব্যস্ত হয়ে পড়ল টিকিট কাটায়। আর আমি, এক পাশবিক আচরণের সাক্ষী, তার দিকে তাকিয়ে হিসেব করতে লাগলাম মনে মনে। নিজের ঠিক কতটা ক্ষতির আশঙ্কায় হঠাৎই নির্দয় নির্মম হয়ে উঠল সে। কন্ডাক্টর নিশ্চয়ই মালিক নয় বাসটির। সুতরাং ভাড়া বাবদ এক জন যাত্রীর কাছে প্রাপ্য চার-ছ’টাকার পুরোটাই যেত না তার পকেটে। যেত সামান্য কমিশন। চার আনা বা তারও কম পয়সা। তো শুধু সেটুকুর জন্য কত সহজে এবং সহসা নিষ্ঠুর হয়ে উঠল সে। এতটাই যে, খঞ্জ এক জন মানুষকে ধাক্কা দিয়ে বাস থেকে ফেলে দিল। সম্ভাব্য পরিণামের চিন্তা মন থেকে মুছে দিল অবলীলায়। কেমন করে সে হতে পারল এতটা হৃদয়হীন?
প্রশ্নটা পিছু ছাড়ল না কয়েক দিন। এর মাঝে হাতে এল একখানি বই। ‘দ্য সায়েন্স অব ইভিল: অন এমপ্যাথি অ্যান্ড দি অরিজিনস অব ক্রুয়েলটি’। লেখক কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে মনস্তত্ত্বের প্রফেসর সাইমন ব্যারন-কোহেন। বইখানি, মনে হল, যেন লেখা হয়েছে আমার প্রশ্নের উত্তর দিতে। সামাজিক মনস্তত্ত্বের এক প্রাচীন অথচ গূঢ় জিজ্ঞাসায় ডুব দিয়েছেন লেখক। তাঁর প্রতিপাদ্য বর্ণনার আগে মনোবিদ্যা চর্চায় ওই বিশেষ শাখার ইতিহাস কিঞ্চিৎ জানা জরুরি।
জীবনে মানে মানুষে-মানুষে ইনটার-অ্যাকশন। কানেকশন কিংবা ক্রস-কানেকশন। তো এই প্রক্রিয়া অনুধাবনের চেষ্টা করে বিজ্ঞানের যে শাখা, তার নাম সোশাল সাইকোলজি। বিষয়টা পুরনো, এ ব্যাপারে গবেষণার সূত্রপাতও ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ পর্বে, কিন্তু শাস্ত্রটা বড় আকারে জনসমক্ষে চলে আসে ১৯৬০ সালে। বিশেষ এক ঘটনা উপলক্ষে। ঘটনাটি রাজনৈতিক, ফলে তার প্রতিক্রিয়া ছড়াল বিশ্ব জুড়ে, এমনকী কূটনীতির ঝঞ্ঝাট গড়াল রাষ্ট্রসঙ্ঘ পর্যন্ত। কিন্তু সব কিছু ছাপিয়ে তার রেশ রয়ে গেল বিজ্ঞানে। প্রমাণ হয়ে গেল একটা সত্য। ঘটনা যা-ই হোক, তাকে ফেলা যায় বিজ্ঞান নামে আতস কাচটির নীচে। এ ক্ষেত্রে ঘটনাটি সংক্ষেপে বলা দরকার। |
১১ মে ১৯৬০। আর্জেন্তিনার রাজধানী বুয়েনস আইরেস-এর শহরতলি থেকে দিনেদুপুরে কিডন্যাপ করা হল এক জনকে। কিডন্যাপাররা ইজরায়েলের গুপ্তচর সংস্থা মোসাদ-এর ছদ্মবেশী এজেন্ট। সেই মোসাদ, নিশ্ছিদ্র গোয়েন্দা অপারেশনের জন্য যার বিশ্বজোড়া খ্যাতি। অপারেশন এখানেও নিখুঁত। শুধু কিডন্যাপ নয়, অপহৃত ব্যক্তিকে ড্রাগের নেশায় করা হল অচৈতন্য। আর অসুস্থ রোগী সাজিয়ে বুয়েনস আইরেস থেকে বিমানে উড়িয়ে আনা হল তেল-আভিভ। আর্জেন্তিনার পুলিশ, প্রশাসন টের পেল না কিচ্ছুটি। কাকে পাকড়াও করতে এমন নিখুঁত জাল বিস্তার?
নাম তার অ্যাডলফ অটো আইখমান। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ কালে অ্যাডলফ হিটলারের বিশ্বস্ত লেফটেন্যান্ট কর্নেল। ছিলেন বিশেষ কাজের দায়িত্বে। ইহুদিরা প্রকৃত মানুষ নয়, ঈষৎ নিম্ন প্রজাতির জীব এই বিশ্বাস থেকে হিটলার হুকুম দিয়েছিলেন পৃথিবীকে ইহুদি-শূন্য করার। তাঁর শাসনাধীন ইউরোপের ভূখণ্ড থেকে খুঁজে খুঁজে গ্রেফতার করা হয়েছিল ৬০ লক্ষ ইহুদি। এদের অধিকাংশকে হত্যাও করা হয়। গুলির অভাবে শুধু গ্যাস চেম্বারে ঢুকিয়ে। শয়ে শয়ে ট্রেন ভর্তি ইহুদি আবালবৃদ্ধবনিতাকে গ্যাস চেম্বারের ঠিকানায় পাঠানোর কাজটা করতেন ওই আইখমান।
১৯৪৮ সাল। গঠিত হল ইহুদি রাষ্ট্র ইজরায়েল। এবং পরের বছর তার গুপ্তচর সংস্থা মোসাদ। সংস্থার মিশন তালিকায় টপমোস্ট প্রায়রিটি-র অন্যতম আইখমান পাকড়াও। ডেড অর অ্যালাইভ। কিন্তু, কোথায় সেই জল্লাদ? যুদ্ধ শেষের আগেই সে জার্মানি থেকে পলাতক। নাম ভাঁড়িয়ে, ছদ্মবেশ ধরে পালিয়ে এক দেশ থেকে অন্য দেশে। তবে, মোসাদ হল মোসাদ। এগারো বছরের মিশন সাকসেসফুল। মিলল খোঁজ। আইখমান নাম পাল্টে বনেছে রিকার্ডো ক্লিমেন্ট। রেডক্রস পাসপোর্ট জোগাড় করে পৌঁছেছে আর্জেন্তিনা। চাকরি করছে বুয়েনস আইরেস শহরে জার্মান গাড়ি কোম্পানি মার্সিডিজ বেনৎজ-এ। অতঃপর অপহরণ।
খবর রটা মাত্র আন্তর্জাতিক মহল তোলপাড়। সরব আর্জেন্তিনা। মুখর প্রতিবাদে। না, কুখ্যাত জল্লাদের প্রতি সহানুভূতিতে নয়। আসলে, পুলিশ প্রশাসনের যে বেইজ্জতির চূড়ান্ত। তাদের নাকের ডগা থেকে জলজ্যান্ত একটা মানুষকে কিডন্যাপ করে পালিয়ে গেল বিদেশি গুপ্তচরেরা! এটা ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইম। আর্জেন্তিনা-ইজরায়েল কাজিয়া পৌঁছল রাষ্ট্রসঙ্ঘের দরবারেও। কিস্যু হল না। কূটনীতির পাঞ্জায় হেরে রণে ভঙ্গ দিল আর্জেন্তিনা।
এবং জেরুজালেম-এর আদালতে বিচার শুরু হল কুখ্যাত যুদ্ধাপরাধীর। শাস্তি জানাই ছিল। মৃত্যুদণ্ড। ১৯৬২ সালের ৩১ মে মধ্য রাতে ফাঁসি হল আইখমান-এর। ইজরায়েল রাষ্ট্রে আজ পর্যন্ত একমাত্র মৃত্যুদণ্ড।
কিন্তু এর মধ্যে বিজ্ঞান কোথায়? আছে। আত্মপক্ষ সমর্থনে আইখমান-এর বক্তব্যে। তিন মাসের শুনানি পর্বে তাঁর বিরুদ্ধে ১৫০০ নথি এবং ১০০ জন সাক্ষী (৯০ জন নাতসি জেল থেকে পলাতক)। অথচ, কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে আসামি নির্বিকার। নথি বা সাক্ষীদের প্রতিটি অভিযোগই যে সত্যি, তা মেনে নিল সে। তা হলে? চরম ঘৃণ্য কাজ সে করল কী করে? আইখমান বার বার এক জবাব দিল: ‘বড় কিংবা ছোট কোনও কাজই আমি করিনি অ্যাডলফ হিটলারের নির্দেশ ছাড়া।’ অর্থাৎ যে কোনও চাকরির যা শর্ত ওপরওয়ালার হুকুম তামিল আমি শুধু তা-ই মেনেছি। আমি দোষী নই।
জবাবটি, বলা বাহুল্য, নতুন নয়। যুদ্ধাপরাধী হিসেবে অভিযুক্ত হয়ে বিচারের সময় হিটলারের অনেক জেনারেলই ওই যুক্তি দিয়েছিল। কিন্তু, আত্মপক্ষ সমর্থনে আইখমান-এর মন্তব্য শুনে বিশেষ বিচলিত হলেন পলিটিকাল ফিলজফির গবেষিকা হানা অ্যারেন্ড। কারণটা হয়তো এই যে, ‘নিউ ইয়র্কার’ ম্যাগাজিনে রিপোর্টিংয়ের জন্য এই বিচারপর্ব জেরুজালেমের আদালতে বসে দেখেছিলেন তিনি। প্রতিবেদন ছাড়াও ওই প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার ফসল একখানি বই। ‘আইখমান ইন জেরুজালেম: আ রিপোর্ট অন দ্য বেনালিটি অব ইভিল’। বইখানির সাব টাইটেল তার উপজীব্য। বেনালিটি অব ইভিল। শয়তান বা শয়তানির তুচ্ছতা। অ্যারেন্ড বলতে চাইলেন, আইখমান বা তার মতো হিটলারের নৃশংস সাঙ্গোপাঙ্গদের মানসিক বিকারগ্রস্ত ভাবা ভুল। আলাদা নয় ওরা আর পাঁচটা সাধারণ মানুষের থেকে। সব চাকুরিজীবী যেমন চায় ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কথা মেনে চলে কেরিয়ারে উন্নতি, তেমনই চেয়েছিল আইখমান। তার আচরণের মূলে নিতান্ত সাদামাঠা এক চাহিদা। শয়তানি, আসলে, তুচ্ছ অতি সাধারণ একটা ব্যাপার।
অ্যারেন্ড নৃশংসতার যে ব্যাখ্যা দিলেন, তা মনে ধরল এক জন বিজ্ঞানীর। তিনি ইয়েল ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক স্ট্যানলি মিলগ্রাম। মানবমনে নিষ্ঠুরতা নিয়ে অনেক দিন ধরে ভাবছিলেন যিনি। ‘আইখমান ইন জেরুজালেম’-এর প্রতিপাদ্যকে পরীক্ষার কষ্টিপাথরে যাচাই করলেন এই গবেষক।
কী রকম এক্সপেরিমেন্ট? সমাজের নানা অংশ থেকে ৪০ জনকে বাছাই করে মিলগ্রাম নিয়ে এলেন ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ের মনস্তত্ত্ব গবেষণাগারে। ওদের সবাইকে বলা হল, এক পরীক্ষার জন্য শিক্ষক সাজতে হবে। অংশ নিতে হবে সেই পরীক্ষায়, যার উদ্দেশ্য বিদ্যাচর্চায় শাস্তির ভূমিকা যাচাই। সবটাই সাজানো, তবু ভাড়া করে আনা মানুষদের বলা হল ও কথা। বলা হল, ছাত্র পড়া ভুল বললে ইলেকট্রিক শক দেবেন। শুরুতে ১৫ ভোল্ট। তার পর ১৫ ভোল্ট করে বাড়াতে বাড়াতে ৪৫০ ভোল্ট পর্যন্ত। ছাত্র সাজল মিলগ্রামের রিসার্চ অ্যাসিস্ট্যান্টরা। এরা রইল সব ওই ৪০ জন ‘শিক্ষক’-এর দৃষ্টির আড়ালে অন্য একটা ঘরে। এ বার ‘শিক্ষক’দের বলা হল, ছাত্ররা পাঠ্য জিনিস কতটা শিখেছে, তা যাচাই করতে একের পর এক প্রশ্ন করুন, আর ওরা ভুল উত্তর দিলে ক্রমান্বয়ে শকের মাত্রা বাড়িয়ে যান। আর ‘ছাত্র’দের শেখানো হল, ওই মাত্রা দেখে (হ্যাঁ, শুধু দেখে, কারণ, বাস্তবে শক খাওয়ার প্রশ্নই ওঠে না) ক্রমশ বেশি বেশি চিৎকার করে যন্ত্রণার অভিনয় করো। তেমন হলে চিৎকার করে জানাও যে, শক সহ্য করতে না পেরে তোমরা মরতে বসেছ। কিংবা মরে গেছ।
এমন পরিস্থিতিতে কত জন মানসিক সুস্থ মানুষ অন্যকে ৪৫০ ভোল্ট শক দেবে? আসল এক্সপেরিমেন্ট শুরুর আগে এ প্রশ্নের উত্তর জানতে এক সমীক্ষা করলেন মিলগ্রাম। ৪৫০ ভোল্ট মানে তৎক্ষণাৎ মৃত্যু। প্রশ্নের জবাবে বেশির ভাগ মানুষ বললেন, শয়ে এক জন। মনোরোগ চিকিৎসকেরা বললেন, হাজারে এক। আপনি নিজে কত ভোল্টে পৌঁছে জ্ঞান হারাবেন? জানতে চাইলে, অধিকাংশ মানুষ বললেন, ১৩৫ ভোল্টে। আপনি নিজে অন্যকে ৪৫০ ভোল্ট পর্যন্ত শক দেবেন? কেউ ‘হ্যাঁ’ বললেন না।
হায়, বাস্তব পরীক্ষায় কিন্তু সমর্থন মিলল না সমীক্ষার। ছাত্রের চিৎকারে শকের পরিমাণ বাড়াতে দ্বিধাগ্রস্ত শিক্ষকদের যখন বলা হল, কাজটা করতেই হবে, কারণ ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সেটাই নির্দেশ, তখন অনেকেই মানলেন সেই হুকুম। ৪৫০ ভোল্ট পর্যন্ত শক দিলেন কত জন? ৪০-এর মধ্যে ২৬, অর্থাৎ ৬৫ শতাংশ মানুষ।
মিলগ্রামের এক্সপেরিমেন্ট বলে দিল, জনগণের এক মোটা অংশ তা-ই করে, যা তাদের করতে বলা হয়। ওপরওয়ালা নির্দেশ দিচ্ছেন জানলে, ভাবে না কাজের চরিত্র নিয়ে, মানে না বিবেকের বাধা। সাধারণ মানুষ, নিজের কাজে মত্ত হয়ে অন্যের প্রতি বিদ্বেষভাবাপন্ন না হয়েও বনতে পারে অত্যাচারের অংশীদার। এক টেলিভিশন সাক্ষাৎকারে মিলগ্রাম বললেন, ‘নাতসি জার্মানিতে যেমন ছিল, তেমন ডেথ ক্যাম্প যদি বানানো হত আমেরিকায় মাঝারি মাপের শহরগুলিতে, তা হলে সেগুলো চালানোর মতো যথেষ্ট লোকজন মিলত এখানেও।’ নৃশংস নাতসিদের সঙ্গে আমেরিকাবাসীদের তুলনা! দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর আমেরিকায় এমন মন্তব্যের প্রতিক্রিয়া অনুমান করা যায়। চরম নিন্দার শিকার হলেন মিলগ্রাম।
স্রেফ ঐতিহাসিক কারণে নিষ্ঠুরতা গবেষণা বার বার টানে ইহুদি বিজ্ঞানীদের। হানা অ্যারেন্ড এবং স্ট্যানলি মিলগ্রাম ছিলেন ইহুদি বাবা-মায়ের সন্তান। ‘দ্য সায়েন্স অব ইভিল’ যিনি লিখেছেন, সেই সাইমন ব্যারন-কোহেন তাঁর বইয়ের শুরুতেই জানিয়েছেন, তিনিও জন্মেছেন ইহুদি পরিবারে। আর, এই জন্মসূত্রে বাঁধা পড়েছে তাঁর গবেষণা। কী ভাবে? তাঁর বয়েস যখন সাত, তখন বাবার মুখে শুনেছিলেন ইহুদিদের বিরুদ্ধে নাতসি বর্বরতার কাহিনি। নাতসিরা এক জন ইহুদিকে মানুষের বদলে মনে করত একটা জিনিস। জড় বস্তু। যেমন খুশি তেমন ভাবে ব্যবহারের যোগ্য। ব্যারন কোহেন বাবার মুখে শুনেছিলেন তাঁর প্রেমিকার মায়ের দুর্দশা। ভদ্রমহিলা নিজের দু’হাতের পাতা উপুড় করে পাশাপাশি রাখলে দেখা যেত, দুটো বুড়ো আঙুল কাছাকাছি নেই। ও দুটো রয়েছে দু’দিকে। পাশাপাশি বরং দুটো কড়ে আঙুল। কেন বৃদ্ধার এই হাল? বন্দি শিবিরে দিনযাপনের পরিণাম। নাতসি সার্জেনরা কেটে ফেলেছিল তালুর গোড়া থেকে তার দুটো হাত। তার পর সেলাই করে দিয়েছিল বাঁ হাতে ডান তালু, ডান হাতে বাঁ তালু। কেমন দেখায়, তা পরখ করতে। ডাক্তার হিসেবে শারীরবিদ্যার এক সেমিনারে ব্যারন কোহেন জেনেছিলেন এক তথ্য। মানুষ কত ঠান্ডা সহ্য করতে পারে, সে ব্যাপারে সবচেয়ে গভীরে জানেন জার্মান বিজ্ঞানীরা। কেন? ইহুদি নারী-শিশু-বৃদ্ধদের বরফ-ঠান্ডা জলের ট্যাঙ্কে ডুবিয়ে ওরা পরীক্ষা করতেন তাদের হৃৎস্পন্দন।
নাতসি নৃশংসতা যে হতে পারে কত রকমের, তার বুঝি ইয়ত্তা নেই। বন্দি শিবিরে মৃত্যুর দরজা থেকে ফেরত এক প্রত্যক্ষদর্শীর আত্মজীবনীতে বর্ণিত ঘটনার উল্লেখ করেছেন ব্যারন-কোহেন। শিবির থেকে পালিয়ে বাঁচার চেষ্টা করেছিল এক ইহুদি। ধরা পড়ে গেল। চেষ্টার শাস্তি মৃত্যু। কিন্তু নাতসি গার্ড গুলি করে মারল না তাকে। হত্যাকে নারকীয় মাত্রা দিতে ইহুদির পাশে দাঁড় করাল তার সবচেয়ে কাছের বন্ধুকে। হুকুম করল, তাকে ইহুদির গলায় পরাতে হবে ফাঁসির দড়ি। বন্ধু পারল না নির্দেশ মানতে। ভয়ে, ব্যথায় কাঁপতে লাগল সে। তার করুণ অবস্থা দেখে এগিয়ে এল ইহুদি। বন্ধুর হাতখানিতে চুমু খেল এক বার। তার পর নিজের গলায় পরে নিল ফাঁসির দড়ি। মৃত্যুর আগে এ ভাবেই বন্ধুকে মুক্তি দিয়ে গেল গ্লানি থেকে।
ব্যারন-কোহেন কবুল করেছেন, ইহুদি পরিবারে বড় হয়ে ও রকম সব ঘটনার বিবরণ শুনে বা পড়ে তিনি প্ররোচিত হয়েছেন নিষ্ঠুরতা গবেষণায়। তবে, শুধু নাতসি বর্বরতার ব্যাখ্যা অভীষ্ট নয়। ‘দ্য সায়েন্স অব ইভিল’ বইখানিতে তিনি পেশ করেছেন পিশাচবৃত্তির বহু আধুনিক নমুনা। এটা বোঝাতে যে, নৃশংসতা দেশ-কালে সীমাবদ্ধ নয়, তার থাবা যখন-তখন যেখানে-সেখানে পড়ে। সোনার আংটির লোভে নাইরোবি-র সুপার মার্কেটে মহিলার হাত কেটে নিয়ে পালায় ছিনতাইবাজ। উগান্ডার গ্রামে চড়াও এক দল মহিলা সেনা অফিসার বেছে নেয় সন্তান-সমেত সাত মহিলাকে; বন্দুকের নলের সামনে দাঁড় করিয়ে ওদের বাধ্য করে খুঁটিতে মাথা ঠুকে নিজেদের বাচ্চাকে মেরে ফেলতে। কঙ্গো-র এক গ্রামের বাড়িতে হানা দিয়ে উগ্রপন্থীরা প্রথমে গৃহস্বামীর হাত-পা বেঁধে ফেলে; তার সামনে তার ছেলেকে বাধ্য করে নিজের মায়ের শ্লীলতাহানি করতে; গৃহস্বামী ও ছেলেটিকে খুন, মহিলাটিকে ধর্ষণ এবং বাড়িটিকে আগুনে ধূলিসাৎ করার পর তারা গ্রাম ছাড়ে। কেমন করে মানুষ এমন পাশবিক হয়ে ওঠে?
প্রশ্নের উত্তর সন্ধানে ব্যারন-কোহেন পেশ করেছেন নতুন তত্ত্ব। আর, এ জন্য তিনি প্রথমেই খারিজ করে দিয়েছেন ইভিল শয়তান বা শয়তানি দিয়ে নৃশংসতা ব্যাখ্যার চেষ্টা। তাঁর মতে, ওটা মানা যায় না। হত্যাকারী কেন নির্দোষ শিশুটিকে খুন করল? কারণ, ও শয়তান। উগ্রপন্থী কেন সুইসাইড-বম্বার হল? কারণ। ও শয়তান। ব্যারন-কোহেন লিখেছেন, এমন সব মন্তব্য হল ‘নন-এক্সপ্লানেশন’। কোনও ব্যাখ্যাই নয়। বরং একটা ধাঁধাকে আর একটা ধাঁধা দিয়ে ব্যাখ্যার চেষ্টা। বিজ্ঞানে এটা চলে না। নাতসিরা নৃশংস, কারণ ওরা শয়তান এটা বললে কিছু বোঝা যায় না। ব্যারন-কোহেন মনে করেন, ‘ইভিল’ আইডিয়াটা ধর্মবিশ্বাসের উপহার। বহু ধর্মের কাহিনিতে শয়তান বড়সড় ভাবে হাজির।
তো সেই শয়তানকে নির্বাসনে পাঠিয়েছেন ব্যারন-কোহেন। ‘ইভিল’-এর বদলে নিষ্ঠুরতা ব্যাখ্যায় আমদানি করেছেন নতুন শব্দ। এমপ্যাথি। সহমর্মিতা। নিষ্ঠুরতাকে ‘ইভিল’-এর মতন একটা অর্থহীন শব্দের খাঁচায় বেঁধে না রেখে ওই বিজ্ঞানী তাকে ফেলেছেন সহমর্মিতা শব্দটির মাইক্রোস্কোপের তলায়। নিষ্ঠুরতা, ওঁর দৃষ্টিতে, এমপ্যাথি ইরোশন বা সহমর্মিতার অবক্ষয়। এমপ্যাথি কী? হ্যাঁ, তারও একটা বৈজ্ঞানিক সংজ্ঞা দিয়েছেন ব্যারন-কোহেন। লিখেছেন, শুধু নিজের ভাবনায় বুঁদ হয়ে না থেকে, অন্যের অনুভূতি উপলব্ধি করে যথোপযুক্ত আবেগের তাড়না হল এমপ্যাথি। অভিধানে সহমর্মিতা শব্দটার অর্থও তো সেটাই।
নিষ্ঠুরকে শয়তান আর নিষ্ঠুরতাকে শয়তানি না বলে, ওগুলোকে নতুন ভাবে ব্যাখ্যা করায় লাভ? তা আছে বইকী! পদার্থবিদ লর্ড কেলভিন বলেছিলেন, যা মাপা যায় না, তা বিজ্ঞানের আওতায় পড়ে না। ব্যারন-কোহেন দাবি করেছেন, নিষ্ঠুরতাকে সহমর্মিতার অভাব হিসেবে দেখলে, নিষ্ঠুরতাকে মাপা যায়। মানে, তার একটা স্কেল বানানো যায়। তিনি যে স্কেল বানিয়েছেন, তাতে গ্রেড সাতটি। জিরো, ওয়ান, টু, থ্রি থেকে সিক্স ডিগ্রি অব এমপ্যাথি। পৃথিবীর সব মানুষ সহমর্মিতায় ওই মাপকাঠিতে কোনও না কোনও গ্রেড-এ পড়বে। এক দিকে জিরো ডিগ্রি এমপ্যাথির মানুষ। যারা নিজের চিন্তায় এতটা মশগুল যে, অন্যের অনুভূতি কিচ্ছুটি উপলব্ধি করে না। এরা নিষ্ঠুরতম মানুষ। এবং মানসিক বিকারগ্রস্ত। অন্য দিকে সিক্স ডিগ্রি এমপ্যাথি। সর্বোচ্চ সহমর্মিতা। এমন মানসিকতার মানুষ নিজের সব ভুলে অন্যের দুঃখে কাতর। এক দিকে খুনি, অন্য দিকে দয়ার অবতার। হিটলার এবং মাদার টেরিজা। মাঝখানের সব মানুষ পাঁচ শ্রেণির। সহমর্মিতা যাদের পাঁচ রকম ডিগ্রির।
কেন এক এক জনের সহমর্মিতা এক এক মাপের? উত্তরের খোঁজে নেমে ব্যারন-কোহেন দেখেছেন, মানব মস্তিষ্কের দশটি অংশের ক্রিয়া সমষ্টিগত ভাবে জন্ম দেয় সহমর্মিতার। মানুষে মানুষে ওই ক্রিয়া আলাদা, তাই এক এক জনের সহমর্মিতা এক এক মাপের? তা হলে ওই মাত্রা ভেদের মূলে কি জিন? মানুষ কি নিষ্ঠুর কিংবা দয়ালু হয়েই জন্মায়? না, ব্যারন-কোহেন দেখিয়েছেন, জিনের প্রভাব থাকলেও, মস্তিষ্কের ওই দশটি অংশ কতটা কাজ করবে, তা নির্ভর করবে শৈশবে এক জন মানুষ মা-বাবার স্নেহ কতটা পেয়েছে, তার ওপর।
সহমর্মিতার সঙ্গে যুক্ত মস্তিষ্কের দশটি অংশের খোঁজ ব্যারন-কোহেন পেয়েছেন বিশেষ গবেষণার সূত্রে। কেমব্রিজ ইউনিভার্সিটিতে তাঁর কাজের মূল বিষয় অটিজম এবং অ্যাসপারগার’স সিনড্রোম। যে সব মানুষ ও দু’টির কোনও একটিতে আক্রান্ত, তারা, যথেষ্ট বুদ্ধিমান হওয়া সত্ত্বেও, অন্যদের সঙ্গে মেলামেশায় একেবারে অপটু। কেন? দেখা গেছে, ওরা অন্যদের মনের ভাব একদম উপলব্ধি করতে পারে না। মানে, ওদের এমপ্যাথি জিরো ডিগ্রি। কিন্তু, ওরা তো খুনি নয়। হোক না ওদের মস্তিষ্কে দশটি অংশের ক্রিয়া একটু আলাদা। ওদেরই দলে পড়েন কোনও কোনও বিজ্ঞানী কিংবা শিল্পী। যারা নিজেদের গবেষণা কিংবা সৃষ্টিকর্মে এত মগ্ন যে, অন্যদের কথা স্বার্থপরের মতো ভুলে যান। ওরাও কিন্তু খুনি নন। এ সব আবিষ্কার থেকে ব্যারন-কোহেন জিরো ডিগ্রি এমপ্যাথিকে আবার দুই শ্রেণিতে ভাগ করেছেন। যাদের কথা বলা হল, তাঁরা জিরো-পজিটিভ। সহমর্মিতা এদের শূন্য হলেও, এরা অন্যের ক্ষতি করেন না। আর এক দল জিরো-নেগেটিভ। যারা মস্তিষ্কের বিকারগ্রস্ত, খুনি।
বিজ্ঞান মানে বিতর্ক। ব্যারন-কোহেন যা বলছেন, তার সবটা নিয়ে না হলেও, ঘোর তর্ক উঠেছে একটা প্রশ্নে। জিরো ডিগ্রি এমপ্যাথি নিয়ে। নিষ্ঠুর মানুষ যে নৃশংস আচরণে লিপ্ত হয়, তা কি অত্যাচারিতের বেদনা উপলব্ধি করতে না পেরে? না কি তা সম্পূর্ণ উপলব্ধি করে? যে নাতসি গার্ড ইহুদির বন্ধুকে হুকুম করেছিল তার গলায় ফাঁসির দড়ি পরাতে, সে যদি না বুঝত ইহুদির যন্ত্রণা, তা হলে ও রকম নির্দেশ সে দিত কি?
কে জানে, হয়তো বাস কন্ডাক্টর খঞ্জ মানুষটিকে ধাক্কা মেরে ফেলে দিয়েছিল তাকে চরম বেদনা উপহার দিতেই। |