|
|
|
|
ওয়েস্ট বেঙ্গল হয়ে যাবে পশ্চিমবঙ্গ |
নিজস্ব সংবাদদাতা • কলকাতা |
আছে ২৮, হবে ২১। ‘ওয়েস্ট বেঙ্গল’ থেকে ‘পশ্চিমবঙ্গ’-এ যাওয়ার সুবাদে রাজ্যগুলির বর্ণানুক্রমিক নামের তালিকায় এ ভাবেই এগিয়ে যেতে চায় এই রাজ্য। এ বার থেকে এই রাজ্যের নাম ইংরেজিতেও ‘পশ্চিমবঙ্গ’ লেখা হবে বলে শুক্রবার সর্বদল বৈঠকে সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত হল। সাংবিধানিক পদ্ধতি মেনে তা আইনে পরিণত হলে ইংরেজিতেও ‘ওয়েস্ট বেঙ্গলে’র পরিবর্তে ‘পশ্চিমবঙ্গ’ লেখা হবে।
ইংরেজিতে ‘ওয়েস্ট বেঙ্গল’ হওয়ার ফলে জাতীয় ক্ষেত্রে বিভিন্ন রাজ্যের বর্ণানুক্রমিক নামের তালিকায় এই রাজ্য এখন আছে ২৮-তম স্থানে। সর্বভারতীয় বিভিন্ন বৈঠকে তাই ‘ডব্লিউ’ আদ্যক্ষর অনুযায়ী ডাক আসে শেষে। ইংরেজি হরফে ‘পশ্চিমবঙ্গ’ লেখা হলে বর্তমান তালিকায় পঞ্জাবকে সরিয়ে ২১-এ চলে আসবে এই রাজ্য। পঞ্জাব এক ধাপ নেমে হবে ২২। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার মনে করছে, সব ভাষায় সার্বিক ভাবে পশ্চিমবঙ্গ লেখা হলে প্রশাসনিক ভাবে রাজ্যের বেশ কিছু সুবিধা হবে। নামের আদ্যক্ষর ‘ডব্লিউ’ থাকায় সর্বভারতীয় স্তরের বৈঠকে পশ্চিমবঙ্গ অনেক পরে বলার সুযোগ পেত। নাম ‘পি’ দিয়ে শুরু হলে তুলনামূলক ভাবে রাজ্য আগে সুযোগ পাবে। তা ছাড়া, রাজ্যে সরকারি কাজকর্মের বেশির ভাগই এখন বাংলা ভাষায় হয়। সেখানে পশ্চিমবঙ্গ নামটিই নথিভুক্ত আছে। ফলে, নাম পরিবর্তনের জন্য নথিপত্র, সাইনবোর্ড-সহ আনুষঙ্গিক বিষয় ঢেলে সাজার দরকার পড়বে না। তালিকায় আগে থাকার সুবিধা ব্যাখ্যা করতে গিয়ে মুখ্যমন্ত্রী মমতা এ দিন পাটুলিতে এক অনুষ্ঠানে বলেন, “এত দিন কোনও বৈঠকে শেষকালে এ রাজ্য ডাক পাওয়ার জন্য রাজ্যের প্রতিনিধিদের কথা ঠিক মতো শোনা হত না। এখন থেকে সে সমস্যাও আর হবে না। পশ্চিমবঙ্গ শুরু হয় ইংরেজির ‘পি’ অক্ষর দিয়ে। এর ফলে রাজ্যগুলির তালিকায় এ রাজ্য তামিলনাড়ু, উত্তরপ্রদেশের থেকেও এগিয়ে আসবে।” তাঁর আরও মন্তব্য: “এখন অনেক বাবা-মা সন্তানের নাম এ অথবা বি দিয়ে রাখেন। কারণ, বিভিন্ন ক্ষেত্রে তাঁদের তালিকায় পিছন দিকে পড়তে হয় না।”
মুখ্যমন্ত্রীর ব্যাখ্যা যা-ই হোক, রাজ্যের নাম বদল করে ইংরেজিতেও ‘পশ্চিমবঙ্গ’ করে দেওয়ার যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন লেখক-শিল্পী-শিক্ষক-খেলোয়াড়-সহ বিভিন্ন স্তরের মানুষ। তাঁদের অধিকাংশেরই মত, ইংরেজিতে ‘পশ্চিমবঙ্গ’ নামকরণ কোনও উল্লেখযোগ্য ‘প্রাপ্তি’ নয়। পূর্ববঙ্গ যখন অবলুপ্ত, তখন পশ্চিমবঙ্গ নামটিই বা কেন থাকবে তা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন অনেকে। সরকারের পক্ষে পরিষদীয় মন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের যুক্তি, “প্রশাসনিক এবং ঐতিহাসিক প্রয়োজন বিবেচনা করে সহমতের ভিত্তিতে যতটা করা যায়, তা-ই করার চেষ্টা হয়েছে।” যদিও প্রশ্ন উঠেছে, এ রাজ্যের ভাষাগত সংখ্যালঘুদের উপর রাজ্যের নামবদলের এই সিদ্ধান্ত কি কার্যত চাপিয়ে দেওয়া হল? কারণ গোর্খা জনমুক্তি মোর্চা ছাড়া অন্য কোনও সংখ্যালঘু গোষ্ঠী এখনও ‘পশ্চিমবঙ্গ’ নামকে সে ভাবে স্বাগত জানায়নি।
অন্য দিকে, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের মতো কেউ কেউ আবার আগে ‘পশ্চিমবঙ্গ’ নামের পক্ষে থাকলেও এখন মত বদলেছেন। সুনীলবাবু দু’মাস আগে বলেছিলেন,
ইংরেজিতেও পশ্চিমবঙ্গই থাক। কিন্তু এ দিন তিনিও বলেন, “আমাদের হৃদয়ে অখণ্ড বাংলা।” এমনকী আয়ারল্যান্ড বা পঞ্জাবের বিভাজনকে ভৌগোলিক এবং ঐতিহাসিক সত্য বলে মানলেও তাঁর বক্তব্য, “ও সব কথা তুলে লাভ নেই। ইতিহাস দিয়ে হৃদয় কথা বলে না। মানুষ বরং নতুন নতুন ইতিহাস তৈরি করে।” বিধানসভায় এ দিন সর্বদল বৈঠকের পরে পার্থবাবু বলেন, “পশ্চিমবঙ্গ নামের ফলে সব উদ্দেশ্য হয়তো পূরণ হবে না। কিন্তু এই মুহূর্তে সহমতটাই বড় কথা।” শাসক দলের বক্তব্য, ১৯৯৯ সালে রাজ্যের নামবদলের উদ্যোগ থমকে গিয়েছিল সর্বসম্মতির
অভাবেই। সেই জন্য এ বার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় রাজনৈতিক সহমতের ভিত্তিতেই এগোলেন।
বিরোধী দলনেতা সূর্যকান্ত মিশ্রও বলেন, “আদ্যক্ষরে এগোনোটাই একমাত্র কারণ ছিল না। আরও কিছু বিষয় ছিল। তবে নানা মত যা-ই থাকুক বা আগে যা-ই হয়ে থাকুক না কেন, এখন ঐকমত্যের ভিত্তিতে পশ্চিমবঙ্গ হবে।” ইংরেজিতে ‘পশ্চিমবঙ্গ’ একটি শব্দ হিসেবেই লেখা হবে। শুধু ‘পি’ই লেখা হবে বড় হাতের হরফে। নিয়ম অনুযায়ী, সর্বদল বৈঠকের সিদ্ধান্ত রাজ্য মন্ত্রিসভায় পাশ হবে অথবা বিধানসভায় প্রস্তাব আকারে পেশ করে তা পাশ করানো হবে। তার পরে সরকার যে বিজ্ঞপ্তি জারি করবে, তা পাঠানো হবে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের কাছে। বিষয়টি তার পরে আলোচনা করে সংসদের দুই কক্ষেই গৃহীত হয়ে বিল পাশ হবে। তাতে রাষ্ট্রপতির স্বাক্ষর লাগবে। তবে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক চাইলে সংসদের দুই কক্ষে প্রস্তাব পাশের পরে রাজ্য সরকারকেও বিধানসভায় একটি বিল আনার কথা বলতে পারে। স্বভাবতই, গোটা প্রক্রিয়াটি বেশ সময়সাপেক্ষ।
রাজ্যের নতুন নাম ঠিক করার জন্য পার্থবাবু এবং সূর্যবাবুকেই আলোচনা চালাতে বলেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী। তাঁরা প্রাথমিক ভাবে ৬টি নামের তালিকা জমা দিয়েছিলেন। বিধানসভায় মুখ্যমন্ত্রীর ঘরে এ দিন সর্বদল বৈঠকে অবশ্য মূলত ‘বাংলা’, ‘বঙ্গ’, ‘বঙ্গভূমি’ এবং ‘পশ্চিমবাংলা’ নিয়ে আলোচনা হয়। মুখ্যমন্ত্রী নিজে ‘বঙ্গভূমি’ নামটির পক্ষপাতী ছিলেন। কিন্তু তিনি বৈঠকে বলেন, ওই নাম নিয়ে ঐকমত্য না-থাকলে তিনি নিজের মত ‘চাপিয়ে’ দিতে চান না।
এর আগে ৩ অগস্টের সর্বদল বৈঠকে প্রাক্তন মন্ত্রী তথা আরএসপি বিধায়ক সুভাষ নস্কর ‘পশ্চিমবঙ্গ’ নামটির প্রস্তাব দিয়েছিলেন। অন্য কোনও নামে সহমত হচ্ছে না দেখে এ দিন ফের ‘পশ্চিমবঙ্গ’ নামের সেই প্রস্তাবটিই উঠে আসে। ‘বাংলা’ বা ‘বঙ্গ’ ঠিক পূর্ণশব্দ নয় বলে বৈঠকে সরকারি পক্ষের প্রতিনিধিরা মত দেন। বামফ্রন্ট বৃহস্পতিবারই ঠিক করেছিল, ‘বাংলা’ না-হলে ইংরেজিতেও ‘পশ্চিমবঙ্গ’ ব্যবহার করা যেতে পারে। শেষ পর্যন্ত সেই মর্মেই ঐকমত্য হয়। |
ওঁরা বলেন |
|
|
বিশ্বের বিভিন্ন বড় শহরের একাধিক নাম থাকে। নামগুলির মধ্যে
থাকে সাংস্কৃতিক ব্যঞ্জনা। যেমন, ভৌগোলিক এলাকা অভিন্ন হলেও
বোম্বে এবং মুম্বইয়ের ব্যঞ্জনা আলাদা। পানের জন্য বেনারসী, শাস্ত্র
পাঠ হয় বারাণসীতে, আর মৃত্যুর বেলায় বলা হয় কাশী। পশ্চিমবঙ্গ
নামকরণের এই উদ্যোগে সেই বোধের অভাব রয়েছে।
আশিস নন্দী |
পূর্ববঙ্গ, পশ্চিমবঙ্গ, বিভক্ত পঞ্জাব বা বিভক্ত আয়ারল্যান্ড
এ সব ইতিহাসের পাতায় থাক। মানুষ নতুন ইতিহাস
গড়ে। আমরাও শুধু বাঙালি, ‘পশ্চিম বাঙালি’ নই।
ইংরেজিতে ‘পশ্চিমবঙ্গ’ চেয়েছিলাম নাম বদলের
প্রথম ধাপ হিসেবে। এখন রাজ্যের নাম ‘বাংলা’ চাই।
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় |
|
|
|
এখন কোনও পূর্ববঙ্গ নেই, অথচ পশ্চিমবঙ্গ থেকে
গেল! শুধু ‘বাংলা’ নামটাই তো ভাল হত।
ইংরেজি বর্ণানুক্রমেও তালিকার উপরে থাকত।
শঙ্খ ঘোষ |
কী বা বদল হল! তেমন কোনও পরিবর্তন
তো হল না। শুধু বাংলা বা বঙ্গ বললেই
বোধহয় ভাল হত। সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় |
|
|
|
ঠিক সিদ্ধান্ত। পশ্চিমবঙ্গের নাম কেন
আমরা ইংরেজি অনুবাদ করে
ওয়েস্ট বেঙ্গল বলব?
হরকাবাহাদুর ছেত্রী |
নামের আদ্যক্ষর অনুযায়ী তালিকায় ‘পশ্চিমবঙ্গ’ এ রাজ্যকে
এগিয়ে
দেবে ঠিকই, তবে ‘বাংলা’ হলে আরও এগোত। ‘বাংলা’ নামটা
শুনতেও অনেক মিষ্টি। বা ‘বঙ্গভূমি’ও মন্দ হত না।
সুচিত্রা ভট্টাচার্য |
|
|
|
বেঙ্গালুরু, চেন্নাই, মুম্বই, কলকাতা সব বদলেছে।
কী লাভ হয়েছে? পশ্চিমবঙ্গের থেকে ওয়েস্ট
বেঙ্গল-ই ভাল ছিল মনে হয়।
লেসলি ক্লডিয়াস |
এটা ভাল লাগল না। পশ্চিম শব্দটা জুড়ে দেওয়া
হল কেন? শুধু বেঙ্গল হতে পারত। আমার
অবশ্য প্রথম পছন্দ ছিল বঙ্গ প্রদেশ। গুরুবক্স সিংহ |
|
এই নাম বদলের কোনও যুক্তি খুঁজে পাচ্ছি না। সর্বভারতীয় সরকারি সম্মেলনে আগে-পরে নাম ডাকার
ক্ষেত্রেই বা কী এমন সুরাহা হবে? ইংরেজিতে ‘ডব্লিউ’ থেকে ‘পি’, এটুকুই অগ্রগতি!
সুলেমান খুরশিদ |
|
কী লেখা হবে নম্বরপ্লেটে |
নাম বদলের সঙ্গে সঙ্গে এ রাজ্যে নথিভুক্ত গাড়ির নম্বরপ্লেটে কী লেখা হবে, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। এত দিনের
‘ডব্লিউ বি’-র পরিবর্তে কি ‘পশ্চিমবঙ্গ’-এর ‘পি বি’, না অন্য কিছু? পরিবহণ দফতরের অভিজ্ঞ অফিসাররা
বলছেন, পঞ্জাবে নথিভুক্ত গাড়ির নম্বরপ্লেটে ‘পি বি’ লেখা হয়। তাই এ রাজ্যে ‘পি বি’ লেখা যাবে না। পরিবহণ
দফতরের এক পদস্থ অফিসার বলেন, ‘পি এস’ অথবা ‘পি এ’ লেখা যেতে পারে। তবে এই পরিবর্তন এখনই হচ্ছে
না। নাম বদল নিয়ে গেজেট-নোটিফিকেশনের পরে পরিবহণ দফতর এ ব্যাপারে নির্দেশিকা
জারি করবে। আগামী সপ্তাহে পরিবহণ-অফিসারেরা বিষয়টি খতিয়ে দেখবেন। |
|
|
|
|
|
|