|
|
|
|
শনিবারের নিবন্ধ ১... |
আমাদের জর্জদা |
যার কেউ নেই তার দেবব্রত বিশ্বাস আছে। কারণ যে গান ছিল একান্ত তাকে অনেকান্ত
করেছিলেন তিনি। ২২ অগস্টের দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে সেই রবীন্দ্রগায়ককে জন্মশতবর্ষের
শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করলেন ‘রুদ্ধসঙ্গীত’-এর নাট্যকার ও পরিচালক ব্রাত্য বসু |
“সৃষ্টির গভীরতার মধ্যে যে একটি বিশ্বব্যাপী প্রাণকম্পন চলেছে, গান শুনে সেইটেরই বেদনাবেগ যেন আমরা চিত্তের মধ্যে অনুভব করি।...এতে করে আমাদের চেতনা দেশকালের সীমা পার হয়ে নিজের চঞ্চল প্রাণধারাকে বিরাটের মধ্যে উপলব্ধি করে।”
ছন্দের অর্থ: রবীন্দ্রনাথ
সে যেন প্রায় গত জন্মের কথা। একটি ভাড়াবাড়ি। বাইরের ঘরটা বসার। কিছু চেয়ার, কিছু বই, টেবিল আর অবশ্যই একটা রেকর্ড প্লেয়ার। শীতের ধোঁয়াশামাখা রোববারের সকালে এক জন মাস্টারমশাই-অধ্যাপক বাবা তাঁর নিজের জন্য তো বটেই, তাঁর বালক পুত্রের জন্যও চালালেন একটি পঁয়তাল্লিশ এলপি রেকর্ড। সদ্য ঘুম ভাঙা বালকের কানে রান্নাঘরের শব্দ, মায়ের বকুনি, নামতা, পাখির ডাক, বাইরের রাস্তায় সাইকেলের ঘন্টির শব্দ সবই ছাপিয়ে গিয়ে প্রবেশ করল গ্রামোফোনের মধ্যে গুঁড়ি মেরে বসে থাকা ওই গায়কের গাওয়া পর পর বিখ্যাত রবীন্দ্রসঙ্গীত আর সেই বালকের চোখের সামনে খুলে যেতে শুরু করল সামনের জীবনের পড়ে থাকা কত শত রহস্যের মানে, তার ইঙ্গিত, অস্ফুট সব হাতেগরম আশ্চর্য যত চলচ্ছবি। বছরের পর বছর, যুগের পর যুগ বহু শীর্ণ ডিগডিগে বাঙালি বালকের এই ভাবেই ছেলেবেলা কেটেছে। তারা ওই গায়কের রবীন্দ্রসঙ্গীত শুনে এক রকম করে জীবনের মানে বুঝেছে। পরে নিজের জীবনের সঙ্গে মিলিয়ে দেখেছে কতকের মানে আছে, কতকের হয়তো মানে নেই। তাতে অবশ্য তাদের কিছু যায় আসেনি তেমন।
বুঝতেই পারছেন আমি দেবব্রত বিশ্বাসের কথা বলছি। জর্জ বিশ্বাস। এ কথা ঠিক, আমরা যারা এ পৃথিবীতে বেঁচেবর্তে এখনও ঘুরে বেড়াচ্ছি, যাঁরা চলে গেছেন আমাদের ছেড়ে, তাঁদের সংখ্যা আমাদের তুলনায় অনেক বেশি, কিন্তু এই পূর্ব ভারতের নরখণ্ডে যাঁরা আছেন এবং যাঁরা চলে গেছেন, তাঁদের মধ্যে অনেক সাদৃশ্যের মধ্যে হয়তো এইটে অন্যতম গায়ে-গতরে বড় হয়ে ওঠার জন্য এবং শিল্প কী তার মানে অল্প করে বুঝতে হলে তাঁর গান শোনা অবশ্যকর্তব্য। ‘রুদ্ধসঙ্গীত’ নাটকটি লিখে যে প্রযোজনাটি করা গিয়েছিল তার পিছনে ছিল পূর্বপুরুষের ওই অকথিত ও অব্যক্ত ঋণ। তার নাটককার ও নির্দেশক সেখানে নিমিত্ত মাত্র। আরও বহু মানুষের অভিপ্রায়, স্মরণ, চোখের জল, আশীর্বাদ এ সবই এসে মিশেছিল থিয়েটারের শব্দ ও দৃশ্যের মোহনায়।
কিন্তু কেন এত ভালবেসেছি আমরা তাঁকে? তা কি শুধুই নিজের জীবনের রহস্য, প্রেমে পড়া, বন্ধুত্ব, প্রতিবাদ, আচ্ছন্নতা এ সবই তিনি হাতে করে বুঝিয়েছিলেন বলে? শুধু এই মানেটুকুই যদি বেরোয়, তা হলে তাঁর প্রতি অবিচারই করা হবে খানিকটা। সে মানে তো আরও বহু বরেণ্য গায়কের গায়নরীতিতে লেপ্টে থাকে। প্রত্যেকেই তার থেকে ছেনে নিয়ে নিজের অভিজ্ঞতা ও উপলব্ধির সমর্থন খোঁজেন নিজের মতো করে। কিন্তু এই গায়কের ক্ষেত্রে সব চেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য ছিল বোধহয় এটাই, ধ্রুপদী প্রাতিষ্ঠানিকতার হাত থেকে রবীন্দ্রসঙ্গীতকে তিনি শুধুমাত্র জনপ্রিয় মৃত্তিকাচারী না করে তাকে গেঁথে দিয়েছিলেন মাটির একেবারে ভেতরে। অর্থাৎ যা কিনা ছিল যুধিষ্ঠিরের রথ, তাকে কর্ণের রথ করেছিলেন এই ব্রাহ্ম বাঙাল যে গান ছিল একান্ত তাকে অনেকান্ত করলেন তিনি তাই প্রত্যেকে নিজের মতো করে ব্যাখ্যা করতে পারলেন সেই অনুপম উচ্চারণকে। অনেকে তাই যে বলেন তিনি ‘বিতর্কিত’, তাঁর ব্যক্তিত্ব ‘বিতর্কিত’ তা বোধহয় ঠিক নয় তত। আসলে তাঁর ওই গায়নরীতিই ‘বিতর্কিত’ যা স্বীয় ব্যক্তিত্বেরই নির্যাস। কারণ সেই গায়নরীতি মৌলিক, স্বতন্ত্র ও যুগের দাবি মেনে অভিনব। আর কে না জানে আমরা মৌলিকতা ও স্বতন্ত্রতাকে যত আক্রমণ করেছি পৃথিবীর অন্যান্য জাতি তার তুলনায় নেহাতই নস্যি। |
|
অনেকে তাঁর গানের ধরন ‘পুরুষবাদী’ বলেন। এ নিয়েও বিতর্ক থাকতে পারে। এ কথা ঠিক, তাঁর কণ্ঠের পুরুষ-ভক্তের সংখ্যা যত বেশি, মহিলার সংখ্যা তার থেকে কম। জানি অনেক মহিলা এতে ঝাঁঝিয়ে উঠে বলবেন, ‘আপনাদের থেকে জর্জদা কম শুনি না মশাই।’ কিন্তু যে কিশোর মুগ্ধ হয়ে শুনেছিল ‘গোধূলিগগনে মেঘে ঢেকে ছিল তারা’-- শুনে হৃদয়হীনা মেয়েটির জন্য চোখের জল ফেলেছে বা যে তরুণ দু’কলম কবিতা লিখেছে ‘শুধু যাওয়া আসা’ শুনে বা যে দূরের জানলার এক চিলতে শাড়ি এক পলকের জন্য দেখে জানলার শিকে বৃষ্টির দাগ নিয়ে শুনেছে ‘বহু যুগের ওপার হতে আষাঢ়’, তার প্রতিক্রিয়ায় তো তারা শুধুই পেয়েছে ধুলো কেবলই নিষ্ঠুর ধুলো। কিন্তু সেই সব অভাগা বেগানার রাতের পর রাত সম্বল হয়ে থেকেছেন জর্জদা। যার কেউ নেই তার দেবব্রত বিশ্বাস আছে। ‘এই তো জীবন কালীদা’ তাই না?
যেমন সাহিত্যে, যেমন নাট্যে, যেমন চলচ্চিত্রে বা শিল্পকলায় গত শতাব্দীর পঞ্চাশের দশক থেকে শুরু হয়েছিল স্বাধীনতা-উত্তর স্বর্ণযুগ। বাংলা গান এবং রবীন্দ্রসঙ্গীতও তার ব্যতিক্রম কিছু নয়। পরের চল্লিশ বছর বাঙালি যা নিয়ে বাঁচবে, তার ভাত ডাল, তরকারি, কাটাপোনা, চাটনি এবং আমাশা পরিকীর্ণ চেনা ছকের জীবনের বাইরের রসদ যা থেকে আসবে, তার গড়ন এ সব মাধ্যমই অল্প বিস্তর তৈরি করে দিতে পেরেছিল। আজকের যে বাঙালি চেহারা বিশ্বমানসের তীব্র গতির সঙ্গে জায়গা করে নিতে পারছে, তার পিছনে আছে মহান সেই সব অতীতের জীবনকুণ্ড ঘিরে প্রদক্ষিণ। যে মানুষ মলিন, যে মানুষ বিবর্ণ আর যে মানুষ উজ্জ্বল তাদের প্রত্যেকের অবস্থান তারা নিজেরা যেমন, এই সব মহান অতীতও তার কিছু কিছু নির্দিষ্ট করেছে। আমি দেবব্রত বিশ্বাসকে সেই কীর্তির অন্যতম পথিকৃৎ বলতে চাই। তাঁর এই জন্মশতবার্ষিকী জন্মদিনে আমি তাঁকে সাষ্টাঙ্গে প্রণাম জানালাম।
ভাল থাকবেন জর্জদা। |
|
|
|
|
|