ব্যাগ গুছিয়ে...

প্রকৃতি-ভাস্করের দেশে
সামনের নিকষ কালো জমাট মেঘ জানিয়ে দিল ‘সে’ আসছে। ঘন সবুজ জঙ্গলমহলের বুক চিরে ছুটে চলেছে দানবীয় উচ্ছ্বাসে। শাল, পলাশের সবুজ আরও ঘনীভূত। বৃষ্টির নেশায় বুঁদ হয়ে কানাকানি। আকাশ জুড়ে বৃষ্টির দস্যিপনা। সেই অঝোর বৃষ্টি ফুঁড়ে সুপারফাস্ট রূপসী বাংলা এগিয়ে চলেছে। শালবনি, লালমাটির গ্রাম, জলরঙা প্রকৃতি, গ্রিন সিগন্যালকে পিছনে ফেলে অবশেষে গড়বেতা। সামান্য দর কষাকষি। তার পরে সটান ভ্যানরিকশায়। বৃষ্টি সিম্ফনিটিপটিপ টুপটাপ। শহর ছেড়ে বাইপাসে। দু’পাশের প্রকৃতি আরও সজীব। রাস্তার অবস্থা খুবই করুণ, বিধ্বস্ত। মিশকালো পিচরাস্তার দফারফা।
গন্তব্য গনগনি। পশ্চিম মেদিনীপুরের এক অল্পচেনা সৌন্দর্যের খোঁজে। গড়বেতা কলেজ ছাড়িয়ে বেশ খানিকটা চলে এসেছি। মোরামের রাস্তায় এসে পড়তেই ভ্যানওয়ালার বিদায়। বাদুড়ঝোলা লোকাল বাস সাঁ সাঁ পাশ কাটিয়ে চলে গেল দূরের হাইওয়ের দিকে। যেন রক্তে রাঙা মোরাম পায়ের তলায়। সেই পাথুরে জমিনের বুক চিরে সবুজের আস্ফালন। মাটির সোঁদা গন্ধে মিশেছে বুনো ফুলের সুবাস। পথ গেছে বেঁকে। দু’পাশে কাজু আর পলাশের ঘনত্ব। মাথার উপরে কালচে মেঘের কেশর থেকে শ্রাবণী মূর্ছনা। কেউ কোথাও নেই।
এ পথে আমি একলা পথিক। হৃদমাঝারে এক অজানা ভয়। কারণ, এই পথে যদি হুরাল (বুনো শিয়াল) পথ আগলে দাঁড়ায়? পথ ক্রমশ সরু হয়ে আসছে। পাশের কাজুবনের ডালে ঝোড়ো বাতাসের দাপট আমায় জড়িয়ে ধরতে চাইছে। পায়ের নীচে যেন রক্তনদীর ধারা বইছে। সত্যি, একেই বলে অ্যাডভেঞ্চার। কাজুর জঙ্গল পাতলা হয়ে এল। সামনে আদিগন্ত আকাশ। কেমন একটা নীলচে রঙের পরত দেখা যাচ্ছে। দূরে রেলব্রিজ আর রুপোলি ফিতে জড়ানো আঁকাবাঁকা একটি নদী। শ্রাবণ উচ্ছ্বাসের শরীরে আঠারোর বাঁধন। এত ক্ষণ নদীর চলনে মুগ্ধ ছিলাম। এ বার নীচে তাকাতেই চক্ষু চড়কগাছ।
এমন সৌন্দর্যের খনি আমার জন্য অপেক্ষা করছিল, তা ঘুণাক্ষরেও টের পাওয়া যায়নি। এমন সৌন্দর্যের সুলুকসন্ধান করতে এসে ও রকম গণ্ডাখানেক হুরালের মুখোমুখি হতে আমি রাজি। লালমাটির মোরাম এসে শেষ হয়েছে এক খোয়াইয়ের কাছে। ধাপে ধাপে নেমে গিয়েছে সিঁড়ি। খুব সাবধানে সিঁড়ি ভেঙে সোজা গনগনির পেটের ভিতর। ল্যাটেরাইট বা মাকড়া পাথর জল আর বায়ুর সংস্পর্শে এসে ক্ষয়ে ক্ষয়ে নানান ভাস্কর্য তৈরি করে চলেছে, আপন খেয়ালে। এমন আগুন ছোঁয়া শিল্পকর্ম নিজস্ব খেয়ালে তৈরি হলেও ইন্ধন জুগিয়েছে প্রকৃতি নিজেই। যেন কোনও দক্ষ শিল্পীর হাতে আঁকা এক অসাধারণ ল্যান্ডস্কেপ।
আমার বাঁ দিকে লালচে-সোনালি ল্যাটেরাইট সৌন্দর্য আর দূরে ডান দিকে বহতা নদী শিলাবতী। এক অনবদ্য সঙ্গত। আর হবে নাই বা কেন? প্রকৃতির নিজস্ব ক্যানভাসে তার তুলির মাস্টারস্ট্রোক চালাবেন, এটাই তো স্বাভাবিক। ক্রমশ এগিয়ে চলেছে লালখাঁড়ির বেতালা বেহড় খাঁজে। সেই বেতালা বেহড়ের উপরিভাগে লাল আর মধ্যভাগে কাঁচা সোনার রং। মাঝে মাঝে সবুজের বিদ্রোহ। কারও আবার ডাইনোসর, কারও পিরামিড, কোনায় আবার বন্য বরাহের মুখ। যেন কোনও প্রাগৈতিহাসিক সভ্যতার অন্দরমহলে। পায়ের তলায় এখনও ‘ব্লাডলাইন’। অলিগলি, তস্য গলিতে শুধুই সৌন্দর্যের ক্যানভাস।
দুপুরে চড়া রোদের শাসন। চড়ছে রোদ্দুর। বাড়ছে সৌন্দর্য। লাল-হলুদ-সবুজের রঙের রায়ট। বুনো ফুলে বাহারি প্রজাপতির মধুপানের সে কী সুখটান! রোদের ঝলক ওদের ডানায়। যেমন রং, তেমনই বাহার। এমন সবুজ বাসরে শিলাবতীর ধারে, রুক্ষ মাকড়ায় ফুটে থাকা বুনো ফুলের কাছে খাজনা আদায় করা প্রজাপতিরা কবিতা লেখে পাতায় পাতায়। তাই তো হাসছে আকাশ, শান্ত নদীর বুকে সামান্য আন্দোলন, দূরের ঘাসবনে দু’টি পাখির একান্ত প্রেমালাপ। গনগনির উপচে পড়া লাল-হলুদ-সবুজের ত্রিবেণী সঙ্গম। ঝিমধরা মাতাল বাতাসের স্পর্শে কখন যেন নেশায় বুঁদ হয়ে যাই। শেষ দুপুরের শান্ত পরিবেশ। থেকে থেকে ঝংকার তুলেছে মাছরাঙার তীব্র সুরেলা ডাক।
গনগনির একটি কিংবদন্তি আছে। শোনা যায়, এই গনগনির প্রান্তরেই পাণ্ডবেরা তাঁদের অজ্ঞাতবাসের বেশ কিছু দিন কাটিয়েছিলেন। সেই সময় যুধিষ্ঠির একদিন দেখেন, নদীর পাড়ে বসে এক ব্রাহ্মণ কাঁদছেন। কারণ জিজ্ঞেস করতে ব্রাহ্মণ জানান, নদীর ও-পারের গ্রামে তাঁর বাড়ি। সেই গ্রামে বকরাক্ষসের প্রবল অত্যাচার। রোজ তার এক জন মানুষ চাই খাদ্য হিসাবে। এ বার তার পালা। আর তিনি চলে গেলে তার পরিবার অসহায় হয়ে পড়বে। সব শুনে যুধিষ্ঠির ব্রাহ্মণকে বলেন, তাঁকে আর কাল যেতে হবে না। ঘটনাটা ভীমের কানে যেতেই ভীম ভীষণ রেগে বলেন, কাল বকরাক্ষসের খাদ্য হিসাবে তিনিই যাবেন। পর দিন সকালে নদীর তীরে হৃষ্টপুষ্ট একজনকে দেখে বেজায় খুশি বকরাক্ষস। কিন্তু ক্রমশ বুঝতে পারে, এ তো সাধারণ কেউ নন। তার পরে ভীষণ যুদ্ধ। ওদের যুদ্ধে প্রকৃতির বুকে ক্ষতচিহ্ন তৈরি হয়। বকরাক্ষস নিহত হল। সুস্থ শরীরে ভীম নগরে ফিরে এলে শান্তির বাতাবরণ। এ ঘটনা জনশ্রুতি হলেও, আজকের শিলাবতীর ও-পারের ছোট্ট গ্রামের নাম ভীমনগর।
ইতিহাসের পাতায়ও লেখা আছে গনগনির নাম। চুয়াড় বিদ্রোহের আগুন তখন রাঢ়বাংলায়। বিদ্রোহের নায়ক সর্দার অচল সিংহ। ব্রিটিশদের ফাঁসির ফরমান উপেক্ষা করে দলবল নিয়ে লুকিয়ে ছিলেন গনগনির রুক্ষ প্রান্তরে। কিন্তু শেষরক্ষা হল না। এক রক্তক্ষয়ী সংগ্রামে ব্রিটিশদের হাতে ধরা পড়েন এবং বিচারে ফাঁসি হয়। গনগনির প্রান্তরেই তাঁকে ফাঁসি দিয়ে স্তব্ধ করে দেওয়া হয়েছিল চুয়াড় বিদ্রোহ। গনগনি থেকে মাত্র ২৫ কিলোমিটার দূরে যামিনী রায়ের বিষ্ণুপুর। বাসে বা ট্রেনে অনায়াসেই চলে যাওয়া যায়।
ফিরে চললাম নীল আকাশ, সরলমতির শিলাবতী, চোখধাঁধানো সবুজ পাড়, লাল-হলুদ-সবুজের ত্রিবেণী সঙ্গম, প্রজাপতির ডানায় নানা রঙের ছটা, বুনো ফুলের বাহারি অনাঘ্রাত সৌন্দর্যের সম্ভার নিয়ে। আজও লোকচক্ষুর অন্তরালে যেন কোনও পথভোলা পথিকের হাতে আনমনে ছড়িয়ে যাওয়া মণিমাণিক্য যা রূপসী বাংলার গনগনিতে এলে ফিরে পাওয়া যাবে বারে বারে।

কী ভাবে যাবেন
হাওড়া থেকে রূপসী বাংলা এক্সপ্রেসে বা শালিমার থেকে আরণ্যক এক্সপ্রেসে গড়বেতা।
খড়্গপুর-আদ্রা সেকশনের গড়বেতা স্টেশনে নেমে গড়বেতা কলেজের কাছেই শিলাবতীর
পাড়ে গনগনি। খড়্গপুর, মেদিনীপুর বা বিষ্ণুপুর থেকে বাসেও চলে আসা যায়।
কোথায় থাকবেন
থাকার জন্য রয়েছে বেশ কয়েকটা হোটেল। রয়েছে রেস্তোরাঁ এবং একটি ধর্মশালা।
কখন যাবেন
সারা বছরই যাওয়া যায়। বর্ষায় রূপ অনন্য। যদিও সাবধানতা বাঞ্ছনীয়।
এখানে দলবদ্ধ হয়ে আসা উচিত, একা নয়।




অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.