|
|
|
|
নামে কী আসে যায়, কাজের কাজ হবে কি আদৌ |
জয়ন্ত ঘোষাল • নয়াদিল্লি |
সংসদের মজলিশে ‘ওয়েস্ট বেঙ্গলে’র ‘পশ্চিমবঙ্গ’ হয়ে ওঠার খবর যখন এসে পৌঁছল, তখন অপরাহ্ন।
বিজেপি নেতা অরুণ জেটলি বললেন, “আর ‘ওয়েস্ট বেঙ্গল’ বলা যাবে না। এ বার বলতে হবে ‘পশচিমবঙ্গো’। তবে নামে কী আসে যায়? এমনটাই তো বলেছেন কবি কালিদাস।”
রে রে করে উঠলেন কপিল সিব্বল। কালিদাস কোথায়, এ কথা তো শেক্সপিয়ার বলেছেন! মুচকি হেসে অরুণ বললেন, “নামে কী আসে যায়?”
তৃণমূলের কেন্দ্রীয় মন্ত্রী দীনেশ ত্রিবেদী টেবিল ঠুকে বললেন, “আসে যায়। নামে আসে যায়। এ বার দেখুন না, নাম পরিবর্তনের ফলে দিল্লির দরবারে প্রশাসনিক কত সুবিধা হবে। এই সিদ্ধান্তটাও তো এত দিনে ‘ওরা’ নিতে পারেনি। ‘আমরা’ নিলাম।”
কী প্রশাসনিক সুবিধা হবে?
বলা হচ্ছে, পিছিয়ে পড়ার ক্রনিক অসুখ থেকে বাঁচবে বাংলা। স্বাধীনতার পর ’৫৬ সালে ১ নভেম্বর সেই যে ভারতের প্রদেশগুলির তিন ধরনের শ্রেণিবিন্যাস হয়েছিল, তার পর থেকে আজ পর্যন্ত ইংরেজি বর্ণমালার প্রায় সব শেষের অক্ষর ‘ডব্লিউ’ দিয়ে নাম শুরু হওয়ায় সর্বত্রই ডাক আসত সবার শেষে। ‘ডব্লিউ’ বর্ণটির পরে থাকে এক্স, ওয়াই, জেড। ওই বর্ণগুলি দিয়ে কোনও রাজ্য নেই। তাই ‘ওয়েস্ট বেঙ্গল’ বরাবরই শেষ বক্তা। জ্যোতি বসু থেকে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য, কেউ এ নিয়ে মাথা ঘামাননি। বেশির ভাগ মুখ্যমন্ত্রী সম্মেলনেই তাঁদের বক্তৃতা দেওয়ার আর সুযোগ আসত না। সুযোগ এলেও দেখা যেত তখন ভাঙা হাট! অধিকাংশ মুখ্যমন্ত্রী য পলায়তি স জীবতি এই আপ্তবাক্য মেনে উধাও। শতরঞ্চি আর হারমোনিয়াম যাদের, বসে থাকতেন সেই অনুষ্ঠানের উদ্যোক্তারাই। এ বার ইংরেজিতে পশ্চিমবঙ্গের আদ্যক্ষর হল ‘পি’। মুখ্যমন্ত্রী সম্মেলনে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে আর শেষ বক্তা অন্তত হতে হবে না। এ-ও এক ‘পরিবর্তন’।
কিন্তু এই যুক্তি যে খারিজ করে দিচ্ছেন দিল্লির অধিকাংশ রাজনীতিক ও প্রশাসক! সবাই তো আর তরুণ গগৈ-এর মত ভাগ্যবান হন না! তামিলনাড়ু তো ‘টি’ দিয়ে! কিন্তু মুখ্যমন্ত্রী জয়ললিতা কী করেন? আজ বলে নয়। অতীতেও করেছেন। মুখ্যমন্ত্রী সম্মেলনে এসে প্রথমেই প্রধানমন্ত্রীকে জানিয়ে দিতেন, তাঁকে বিকেলের বিমানে ফিরে যেতে হবে। জরুরি কাজ আছে। তাঁকে আগে বলতে দেওয়া হোক। ‘না দিলে লিখিত বক্তৃতার কপিটি রেখে গেলাম। আপনারা পড়ে নেবেন।’ জয়ললিতাকে তাই বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই আগে বলার সুযোগ দেওয়া হয়। এক বার তো গুজরাতের মুখ্যমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী বলেই ফেলেন, “জি ফর গুজরাত। আমি মাঝামাঝি জায়গায় আছি। কিন্তু ‘আম্মা’-র সঙ্গে পেরে উঠি না।” শুধু আম্মাই নন। উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী মায়াবতীও বেশ কয়েক বার ‘ইউ’-এর গ্লানি ভাঙতে অসম, অরুণাচলের পরেই বলে নিয়েছিলেন।
জহওরলাল নেহরুর জমানায় বিধানচন্দ্র রায়ও এই ‘বিশেষ’ গুরুত্ব পেতেন। সেখানে বর্ণানুক্রম ছিল তুচ্ছ বিষয়। তখন অবশ্য রাজ্যের সংখ্যা এখনকার চেয়ে অনেক কম ছিল। তবু কোনও এক মুখ্যমন্ত্রী নেহরুকে প্রশ্ন করেছিলেন, “আপনি সব সময় বিধান রায়কে আগে বলতে দেন কেন?” নেহরু রসিকতা করে বলেন, “ওঁর উচ্চতা নিয়ে আমার একটু ঈর্ষা আছে।” তৎকালীন আইসিএস অফিসার অশোক মিত্র তাঁর আত্মজীবনীতে লিখেছেন, “নেহরু এই ‘উচ্চতা’ শব্দটি দৈহিক এবং মানসিক দু’টি দিক ভেবেই বলেছিলেন। এটা বুঝে মজা পেয়েছিলাম।”
জাতীয় রাজনীতিতে বিধান রায়ের সেই গুরুত্ব কিন্তু নামের আদ্যক্ষর দিয়ে নিরূপিত হয়নি। অশোক মিত্র লিখেছেন, বিধানবাবুকে ‘ভারতরত্ন’ উপাধিতে ভূষিত করা হয়। রাষ্ট্রপতি ভবনের দরবার হলে উৎসব শেষে চায়ের আসরে কতিপয় সাধারণ কর্মচারীর সঙ্গে তিনি এমনই আলাপে মগ্ন হলেন, সকলে বুঝেছিল ভারতের সর্বোচ্চ সম্মানও তাঁকে বিন্দুমাত্র স্ফীত করেনি। তাই শেষ বিচারে আজও রাজ্যের নাম ‘পশ্চিম বাংলা’ না ‘পশ্চিমবঙ্গ’, তাই দিয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের গুরুত্ব বিচার হবে না। তৃণমূলের মুখ্য সচেতক সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, “দু’টি বিষয় আলাদা। মাতৃভাষায় রাজ্যের নামকরণের সঙ্গে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের গুরুত্বের কোনও সম্পর্ক নেই। মমতার গুরুত্ব মমতার জন্যই। তিনি অসাধ্য সাধন করেছেন বলে।”
ভাষাভিত্তিক রাজ্য পুনর্গঠন নিয়ে অতীতে কলকাতা শহরেই বাঘে-কুমিরে লড়াই লেগে গিয়েছিল। বিধান রায় ১৯৫৬ সালের ২৩ জানুয়ারি ঘোষণা করেন, বিহার ও পশ্চিমবঙ্গ এক হয়ে যাবে। বিধান রায় ভেবেছিলেন, এতে বাংলার প্রশাসনিক সুবিধা হবে। নেহরু এই প্রস্তাবকে ভূয়সী অভিনন্দন জানান। বিহার রাজি ছিল। বিহার বিধানসভাতেও দুই রাজ্যকে এক করার বিষয়ে তড়িঘড়ি বিল আনা হয়। কিন্তু কলকাতায় অতুল্য ঘোষের নেতৃত্বে রাজ্য কংগ্রেস তার বিরোধিতা শুরু করে। মে মাস পর্যন্ত কলহ চলার পরে রণে ভঙ্গ দেন বিধান রায়। সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার করেন। আইন উপদেষ্টা ও সচিব পি কে হাজরা কিন্তু বরাবরই এই প্রস্তাবে আপত্তি করেছিলেন। বিধান রায় প্রথমে মানতে না পারলেও পরে হাজরার যুক্তি মেনে নেন।
এ বার অবশ্য দু’টি রাজ্য এক হওয়ার বিষয় নয়। বিষয়, রাজ্যের নামকরণ। মাতৃভাষার প্রতি এই প্রেম এবং আকস্মিক বেশি করে বাঙালি হয়ে ওঠার চেষ্টা দেখে রাজধানীর অনেক অবাঙালি নেতাই বলছেন, “এ বার কিন্তু পশ্চিমবঙ্গ নামটার এক প্রবল উচ্চারণ-বিকৃতি শুনতে হবে।” বিমানসেবিকার মুখে ‘কলকাতা’ শুনে ‘কোলকাতা’বাসীর যেমন ভিরমি খাওয়ার জোগাড় হয়, ঠিক সে ভাবেই পশ্চিমবঙ্গ উচ্চারণ যে কী ভয়াবহ হতে পারে তাঁর নমুনা বেশ কিছু সংসদের রিহার্সালেই বোঝা গিয়েছে। রসিকতার ছলে লালুপ্রসাদ যাদব বলেছেন, “মুখে রসগোল্লা রেখে হিন্দিতে পশচিমবঙ্গল বলতে থাকো। তা হলে উচ্চারণটা শুদ্ধ বাংলা হয়ে যাবে।”
কিন্তু প্রশাসনিক সুবিধা? নতুন নামকরণের পর ২১ অগস্ট প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহ যাচ্ছেন কলকাতা সফরে। তাতে কি রাজ্যের আর্থিক প্যাকেজে কোনও নাটকীয় প্রাপ্তি যোগ হতে চলেছে? লাল ফিতের সমস্ত বাঁধন, জহওর রোজগার যোজনা থেকে এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাঙ্কের ঋণ সব কি এ বার খুলে যাবে? মার্কিন লগ্নি থেকে মুকেশ অম্বানীর অগ্রাধিকার কি গুজরাতের বদলে হবে নতুন ‘পশ্চিমবঙ্গ’?
নতুন নামকরণ কি হবে বাংলার ইতিহাসের পথে সত্যিই কোনও মাইলফলক? প্রশাসনিক উৎকর্ষ লাভের সহজিয়া পথ নাকি ‘থোড় বড়ি খাড়া’র বদলে ‘খাড়া বড়ি থোড়’? প্রশ্ন সাউথ ব্লক ও নর্থ ব্লকের বহু পক্ককেশ আমলারই। |
|
|
|
|
|