|
|
|
|
|
|
|
সিনেমা সমালোচনা... |
|
এসএমএস পৌঁছল |
আর বাধ্য করল নিজের মুখোমুখি দাঁড়াতে। লিখছেন জাগরী বন্দ্যোপাধ্যায় |
এসএমএস-কে কি উড়ো চিঠি বলা যায়? এক অর্থে তো যায়ই! তরঙ্গের মধ্য দিয়ে উড়ে এসেই তো ঘাপটি মেরে বসে থাকে এই লিখিত বার্তা। আবার এ-ও সত্যি যে, এসএমএস ঠিক চিঠি নয়। এ বরং লিখন আর কথনের এক আশ্চর্য সংশ্লেষ! ‘উড়ো চিঠি’ ছবিটা অনিকেতের জীবনের বারোটা মাসের গল্প। সেই বারোমাস্যায় সূত্রধরের ভূমিকায় থাকে বারোটি এসএমএস। জীবনের সব গল্প এসএমএসে ধরা থাকে না। আবার সব এসএমএসের কথা অনিকেত নিশ্চয় আমাদের বলেও না। বাছাই করা এক ডজন এসএমএসের সূত্র ধরে কাহিনি যে ক’টি গলিঘুঁজিতে যতখানি প্রবেশ করে, ততখানিই আমরা দেখতে পাই। তা সত্ত্বেও অবশ্য এ ছবিতে অনিকেতের বারো মাস খুব বিচ্ছিন্ন, খণ্ডচিত্র হয়েও থেকে যায় না। অজস্র আলো-অন্ধকার নিয়ে প্রায় পূর্ণাঙ্গ এক জীবনকাহিনিই হয়ে ওঠে যেন! সেটা এ ছবির শক্তি। হয়তো দুর্বলতাও বলতে পারেন কেউ! তর্ক আর ভাবনার অবকাশ রইল।
তর্কের কথা যখন উঠলই, তখন বরং পরিচালকের প্রতি অনুযোগগুলো আগে সেরে ফেলি। তিনটি কথা বলার আছে এখানে। এক, এসএমএসগুলো যে এ ছবির সূত্রধর, সেটা খুব স্পষ্ট করে অনিকেতের মুখ দিয়ে বলানোর দরকার ছিল কি? দর্শক যদি ছবি দেখতে দেখতে এই গঠনটা নিজে আবিষ্কার করে নেওয়ার সুযোগ পেত, বেশি জমত না? দুই, কাশ্মীরে জঙ্গি সংঘর্ষের একটা উল্লেখ আছে। টিভিতে চলছে নিউজ চ্যানেল। ধারাভাষ্যটা ইংরেজি, ‘স্ক্রল’ যাচ্ছে বাংলায়। তিন, লিলেটকে মারণরোগে আক্রান্ত দেখানোটা একটু বেশি নাটকীয় হয়ে গেল নাকি? লিলেট আর অনিকেতের বিচ্ছেদ সম্পর্কের নিজস্ব আবর্তের মধ্য দিয়েই ঘটলে বেশি বাস্তবসম্মত হত বোধহয়! |
|
উড়োচিঠি
ইন্দ্রনীল, রুদ্রনীল, বিশ্বনাথ, শ্রীলেখা, লকেট |
এই নালিশটুকু সেরে নিয়ে গলা খুলে বলা যাক, পরিচালক কমলেশ্বর মুখোপাধ্যায়কে ধন্যবাদ!!
এতগুলো চরিত্র এবং তাদের বিচিত্র যাপনকে এক চালচিত্রে ধরার কাজটা ভয়ানক কঠিন ছিল। আপনি পেরেছেন। প্রতিটি চরিত্র যে স্বকীয় ভাবে উজ্জ্বল হতে পেরেছে, এর কৃতিত্ব প্রাথমিক ভাবে আপনারই। আরও স্পষ্ট করে বললে, আপনার চিত্রনাট্যের। এবং অবশ্যই সম্পাদক অর্ঘ্যকমল মিত্রের।
আপনাকে ধন্যবাদ প্রায় প্রতিটি চরিত্রের মধ্যে অনন্ত ধূসরতা রেখে দেওয়ার জন্য। এবং একই সঙ্গে প্রায় প্রত্যেকটি চরিত্রকে তাদের দোষ-ত্রুটি-ক্ষুদ্রতা-সীমাবদ্ধতা সমেত ভালবাসতে বাধ্য করার জন্য। অনন্ত আশাবাদের কোনও সরল রূপকথা না আউড়েও বন্ধুতার প্রতি, সহিষ্ণুতার প্রতি এক চিলতে বিশ্বাস বাঁচিয়ে রাখার জন্য। অথচ একই নিশ্বাসে বারবার সব হিসেব গুলিয়ে দেওয়ার জন্য। কোন বিপ্লব কখন পরিণত হয় আপসে, কোন আপস কখন উস্কে দেয় বিপ্লব, কোন পাপের তলায় লুকিয়ে থাকে পুণ্য, কোন পুণ্যের নীচে চাপা পড়ে পাপ কে বলতে পারে?
আরও ধন্যবাদ, অনিকেতের মতো একটি চরিত্র নির্মাণ করার জন্য। এ ছবি অনিকেতের ছবি। জুয়াড়িপনা ধাত নয় তার, তবু তার মধ্যে আছে জীবন নিয়ে ফাটকা খেলার নেশা। সবাই তাকে চরিত্রবান বলেই জানে, তবু তার মধ্যে আছে এক বেপরোয়া প্রেমিক। ইন্দ্রনীল সেনগুপ্তের এ যাবৎ সেরা কাজ নিঃসন্দেহে।
শুধু ইন্দ্রনীল কেন? প্রায় প্রত্যেকেই মনে রাখার মতো অভিনয় করেছেন এ ছবিতে। গায়ে কোরেসিন ঢালার দৃশ্যে শ্রীলেখা মিত্র, বিউটি পার্লার খোলা লকেট চট্টোপাধ্যায়, রোগশয্যায় তনুশ্রী চক্রবর্তীর অভিনয় অসামান্য। অঞ্জন দত্ত, রজতাভ দত্ত, সুদীপ্তা চক্রবর্তী, বিশ্বজিৎ চক্রবর্তী খুব বেশি সময় ধরে পর্দায় নেই বটে, কিন্তু নিজেদের জাত চেনাতে ওঁদের জন্য ওই সময়টাই অনেক! রুদ্রনীল আছেন তাঁর স্ব-মেজাজেই। একটু ভিলেনির ছোঁয়াসম্পন্ন একটি চরিত্রে দুরন্ত অভিনয় করেছেন শাশ্বত চট্টোপাধ্যায়।
আর? এ ছবির সেরা চমক? সুহাসের ভূমিকায় বিশ্বনাথ বসু। বিশ্বনাথ এ ছবিতে স্পষ্ট বুঝিয়ে দিয়েছেন, টালিগঞ্জ যদি তাঁকে ব্যবহার করতে না পারে, ক্ষতি টালিগঞ্জেরই। কোনও প্রশংসাই তাঁর জন্য যথেষ্ট নয়। এবং আবারও ধন্যবাদ। বাংলা ছবির একটা বড় অংশ যখন ক্রমাগত উচ্চমধ্যবিত্তের ড্রয়িং রুমে আটকে যাচ্ছে, তখন সুহাস-সুধাদের মতো চরিত্রকে পুনর্বাসন দেওয়ার জন্য! কারখানা বন্ধ, বাড়ি বসে গঁদের আঠা তৈরির গল্প বাংলা ছবি অনেক দিন বলেনি!
কিছু ছবি ধারে কাটে, কিছু ছবি আবেগে সাঁতরায়। ‘উড়ো চিঠি’র কিন্তু ভার আছে। এ ছবি দেখলে মন ভারী হয়, নিজের সঙ্গে কথা বলার দরকার হয়। মনে পড়ে, আলো-অন্ধকারে মাথার ভিতরে স্বপ্ন নয়, প্রেম নয়, ভালবাসা নয়...কোন এক বোধ কাজ করে। এই ঝুঁকিটা যদি দর্শক নেন, তা হলে তাঁদেরও ধন্যবাদ! |
|
|
|
|
|