|
|
|
|
|
|
|
চিত্রকলা ও ভাস্কর্য ১... |
|
শৈশব স্মৃতিতে এখনও সেই সন্ত্রাসের ছবি |
সিমায় চলছে কিংশুক সরকারের একক প্রদর্শনী ‘কিংশুক থ্রু দ্য ওয়ার্ল্ড ডার্কলি’। লিখছেন
মৃণাল ঘোষ |
কিংশুক থ্রু দ্য ওয়ার্ল্ড ডার্কলি এই শিরোনামে সিমা গ্যালারিতে অনুষ্ঠিত হল কিংশুক সরকারের প্রথম একক প্রদর্শনী। হিংসা ও সন্ত্রাসদীর্ণ তমসালীন বিশ্ব পরিস্থিতির ভিতর দিয়ে শিল্পী জীবনের দিকে তাকিয়েছেন। সেই সংক্ষুব্ধ আলোড়নের প্রতীক নির্মাণ করতে চেষ্টা করেছেন। তীব্র গতিময় অভিব্যক্তিবাদী বিমূর্ততার আঙ্গিকে যে শিল্পভাষা তৈরি করেছেন, তা প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য দু’টি ঐতিহ্যের সংশ্লেষে গড়ে উঠেছে। সামান্য আখ্যান সম্পৃক্ত অবয়বী প্রতিমাকল্প এসেছে কখনও কখনও। আবার তা ভেঙে গিয়ে চেতনার আর্তনাদ রূপে বিস্ফারিত হয়েছে। মোট ২৯টি নানা মাধ্যম ও আঙ্গিকের কাজ নিয়ে এই প্রদর্শনী। ক্যানভাস ও কাগজের উপর আঁকা ছবি ছাড়াও রয়েছে কয়েকটি ভাস্কর্যধর্মী রচনা, যার ভিতর চিত্রের আদল-ই প্রাধান্য পেয়েছে। এ ছাড়া প্রদর্শনীর বিশেষ আকর্ষণ তিনটি ভিডিও। ‘আ ব্ল্যাক ব্লো’ ও ‘আ বিগিনিং’ শীর্ষক ভিডিও দু’টি থেকে অনুধাবন করা যায় শিল্পীর সৃজন প্রক্রিয়া। বোঝা যায় ‘অ্যাকশন পেইন্টিং’ এর শরীরময়তাকে তিনি কী ভাবে ব্যবহার করেছেন। আর মানুষের আর্ত চিৎকারকে বিশ্লেষণ ও ঘনীভূত করে গড়ে উঠেছে ‘শ্রিল ক্রাই’ শীর্ষক ভিডিওটি। |
|
শিল্পী: কিংশুক সরকার |
যদিও এটি তাঁর প্রথম একক তবু শিল্পী হিসেবে তাঁর প্রকরণ ও আঙ্গিকের ও অভিনবত্বের জন্য কিংশুক ইতিমধ্যেই যথেষ্ট পরিচিত। তাঁর শিল্পী-সত্তার বিকাশে তিনটি উৎসের গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব রয়েছে। অসমে তাঁর জন্ম (১৯৭২)। শৈশব, কৈশোর কেটেছে সেখানে। তখন অসম ছিল সন্ত্রাসবাদী আন্দোলনে বিধ্বস্ত। হিংসা ও সন্ত্রাসের সেই শৈশব-স্মৃতি তাঁর মনে স্থায়ী ভাবে দাগ রেখে যায়। সেই ক্ষত আজও তাঁর সৃজন প্রক্রিয়াকে নিয়ন্ত্রণ করে। শিল্পকলার পাঠ নিতে তিনি শান্তিনিকেতনে আসেন। কলাভবন থেকে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর শিক্ষা শেষ করেন ১৯৯৭ ও ১৯৯৯-তে। বিশ্বভারতী তাঁকে উদ্বুদ্ধ করে বিশ্ব সংস্কৃতির সারাৎসারকে আত্মস্থ করতে। ২০০১ থেকে ২০০৩ তিনি জাপানের দু’টি বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়ন ও গবেষণা করেন। জাপানের পরম্পরাগত ও আধুনিক শিল্প প্রক্রিয়া ও প্রকরণ তিনি শেখেন এই সময়ে। বিশেষত ‘ইওয়া-এনোগু’ নামে জাপানের টেম্পারাধর্মী রং তৈরির প্রক্রিয়া আয়ত্ত করেন।
এই প্রাচ্য উত্তরাধিকার সত্ত্বেও এই সময়ের ব্যাপ্ত আলোড়নকে ধরতে তিনি পাশ্চাত্যের অভিব্যক্তিবাদী রীতি, বিশেষত আমেরিকান অ্যাকশন পেইন্টিং-এর বৈশিষ্ট্যগুলি আয়ত্ত করেন। জাপানেরও রয়েছে এরকম শরীরী চিত্র ও নির্মাণরীতি। সেটাকেও তিনি মিলিয়ে নেন পাশ্চাত্য এক্সপ্রেশনিজমের সঙ্গে।
তাঁর কয়েকটি অবয়বী ও সামান্য আখ্যানধর্মী কাজ আমরা প্রথমে দেখে নিতে পারি। ‘ডিসপার্স’ শীর্ষক ছবিটি কাগজের উপর গ্র্যাফাইট পেনসিল, লাল লঙ্কাগুঁড়ো ও লঙ্কাবীজ দিয়ে আঁকা। কাগজের সাদা জমির উপর ছড়ানো লঙ্কাগুঁড়োর লাল রং। সেখানে দাঁড়িয়ে একজন লোক মূত্রত্যাগ করছে। সেই মূত্রধারার সঙ্গে লঙ্কাবীজ এসে পড়ছে ভূমিতে। ‘বিগ বাইট’ ইওয়া-এনোগু বর্ণে আঁকা। গভীর কৃষ্ণ প্রেক্ষাপটে শরীর থেকে বিচ্ছিন্ন দু’পাটি দাঁত উপস্থাপিত। লোভ ও হিংসার বীভৎস প্রতীক হয়ে ওঠে তা। ‘ইডিয়ট’ রচনাটিতে সাদা-কালোতে আঁকা গো-জাতীয় একটি প্রাণীর মৃতদেহ পড়ে আছে ভূমিতে।
একেবারে বিমূর্ত রঙের বিচ্ছুরণে করা অ্যাকশন পেইন্টিং ধরনের অভিব্যক্তিবাদী রচনাও রয়েছে অনেক। ‘আ ব্ল্যাক ব্লো টু অ্যাচিভ লাইট’ শীর্ষক রচনাটি এর দৃষ্টান্ত। চারটি ক্যানভাস জুড়ে একটি বৃহত্তর চিত্রপট। শান্তিনিকেতনের জলাশয় ঘিরে সবুজ প্রান্তরের পরিচিত দৃশ্যটি চিনে নিতে পারি আমরা। চারটি শুভ্র ক্যানভাস বিছানো রয়েছে সেই প্রান্তরে। ক্যানভাসের উপরে দু’পাশে টানা দড়ি থেকে ঝুলিয়ে দেওয়া হয়েছে কালো রং ভর্তি পাতলা আবরণে তৈরি একটি পাত্র। দূর থেকে ফায়ার করে যেইমাত্র বিষ্ফারিত করা হল সেটিকে, সঙ্গে সঙ্গে কালো রং ছড়িয়ে পড়ল ক্যানভাসের উপর। ওর উপর কোথাও কোথাও সামান্য কাজ হয়তো করলেন শিল্পী। কিন্তু বিমূর্ত ছবিটি গড়ে উঠল আপতিক বিচ্ছুরণে। শান্তিনিকেতনের জল ও মাটির আবহমণ্ডলে জাপান ও আমেরিকার শরীরী চিত্রনির্মাণপদ্ধতি মিলে গিয়ে গড়ে উঠল এই ছবি। আবিশ্ব উত্তরাধিকারের সাম্প্রতিক সমন্বয় চেতনার একটি দৃষ্টান্ত। |
|
|
|
|
|