|
|
|
|
সোনার আঁচে ঝলসাচ্ছে ব্যবসা, মধ্যবিত্তের স্বপ্ন |
প্রজ্ঞানন্দ চৌধুরী • কলকাতা |
মেয়ের বিয়ের গয়না কেনার পরিকল্পনা ঢেলে সাজতে বসেছেন যাদবপুর কারজু নগরের ভাস্কর ভাদুড়ি। সোনার দামের উল্কার গতিই তাঁকে বাধ্য করেছে এটা করতে। ভাস্করবাবুর আক্ষেপ, “এক মাত্র মেয়ের বিয়ে। ইচ্ছে ছিল ১০-১২ ভরির মতো গয়না দেব। কিন্তু এখন দেখছি, সাত-আট ভরির বেশি কেনা সম্ভব হবে না।”
একই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন শ্যামবাজারের সন্তোষ কুণ্ডু। “মেয়ের বিয়ের গয়না কেনার জন্য একটা টাকা ধরে রেখেছিলাম। কিন্তু প্রায় রাতারাতিই হু হু করে সোনার দাম বেড়ে গেল। বাজেট তো আর টেনে বাড়ানো যাবে না। তাই এখন সোনার পরিমাণ কমিয়েই অবস্থা সামাল দিতে হবে,” আক্ষেপ তাঁর গলাতেও।
মাত্র মাস ছয়েকের মধ্যে এ দেশের বাজারে ১০ গ্রাম পাকা সোনার দাম বেড়ে গিয়েছে সাত হাজার টাকার কাছাকাছি! তাই শুধু ভাস্করবাবু বা সন্তোষবাবু নন, সিংহভাগই বাধ্য হচ্ছেন মেয়ের বিয়ের গয়নার পরিমাণে কাটছাঁট করতে। আর এ ধরনের বাধ্যবাধকতা যাঁদের নেই, তাঁরা তো সোনার দোকানের ধারেকাছেই যাচ্ছেন না! |
|
ক্রেতা নেই। ঘুমোচ্ছেন বিক্রেতা। কলকাতার একটি সোনার দোকানে শুক্রবার ছবি তুলেছেন সুদীপ আচার্য। |
আর এ সবের প্রত্যক্ষ প্রভাব পড়েছে শহরের গয়না ব্যবসায়। ক্রেতার অভাবে মাছি তাড়াচ্ছে সোনার দোকানগুলি। গিনি এম্পোরিয়ামের কর্তা তথা ‘স্বর্ণশিল্প বাঁচাও কমিটি’র কার্যকরী সভাপতি বাবলু দে বলেন, “স্বাভাবিক বাজারে রাজ্যে প্রতি দিন গড়ে প্রায় ২০০ কিলোর মতো সোনা বিক্রি হত। এখন সেটা কমে দাঁড়িয়েছে ৫০ কিলোর আশেপাশে! এই অবস্থা চলতে থাকলে ব্যবসা চালানোই মুশকিল হবে।”
কেবল বিয়ের গয়না নয়, উপহারের গয়নারও একটা বড় বাজার রয়েছে। গড়িয়াহাটের প্যাক্স জুয়েলারি হাউসের কর্তা তপন সরকারের কথায়, “উপহারের জন্য গয়না বছরের প্রায় সব সময়েই বিক্রি হত। সেই বাজার প্রায় পুরোটাই শেষ হয়ে গিয়েছে। সোনার দাম অত্যাধিক বেড়ে যাওয়ায় উপহার হিসেবে সাধারণ মানুষ এখন অন্য জিনিসের দিকে ঝুঁকেছেন। আমাদের ব্যবসা মার খাচ্ছে।”
সোনার দাম ক্রমশ আকাশছোঁয়ায় আরও একটি সমস্যা তৈরি হয়েছে। বৌবাজারের রাখালচন্দ্র দে জুয়েলার্সের অংশীদার নবীন কুমার চন্দ্রের কথায়, “প্রতি দিন দাম লাফিয়ে বাড়ায় গয়নার দাম ঠিক করতে গিয়ে আমরা সমস্যায় পড়ছি। ধরুন, আজ একটা দামে বরাত নিলাম। কাল বাজারে গিয়ে দেখি সোনার দাম লাফ দিয়ে বেড়ে গিয়েছে। এর জন্যও আমরা অনেক সময়ে লোকসানের মুখে পড়ছি।”
অবস্থা সামাল দিতে বাজারে কম সোনার নতুন গয়না এসেছে। বাবলুবাবু জানান, “টাকার অঙ্কটা ঠিক রেখে ক্রেতারা সোনার পরিমাণ কমাচ্ছেন। কিন্তু পছন্দের ব্যাপারটাও তাঁরা ঝেড়ে ফেলতে পারছেন না। তাই কম সোনার অনেক নতুন নতুন গয়না বাজারে আসছে।” উদাহরণ দিতে গিয়ে তিনি জানান, ‘সলিড’ সোনার চুড়ি বা বাউটির বদলে এখন ‘সকেট’ বাউটি বাজারে এসেছে। এই পদ্ধতিতে ব্রোঞ্জের বাউটি তৈরি করে তার উপর পাতলা সোনার চাদর ক্লিপ দিয়ে ঢেকে দেওয়া হয়। এই ধরনের গয়না দেখতে অনেকটা পুরনো গয়নার মতোই, কিন্তু এতে সোনা লাগে কম। এ ছাড়া নেকলেস, মান্তাসা ইত্যাদির ক্ষেত্রে এখন ‘রেজি’-র কাজের পরিবর্তে ছাঁচ ব্যবহার করা হচ্ছে। এতেও গয়না দেখতে প্রায় একই রকম লাগলেও সোনা কম লাগে।
গয়নার চাহিদা কমায় প্রচণ্ড সমস্যায় ছোট দোকানগুলিও। মধ্য কলকাতার পায়েল জুয়েলারির মালিক অরুণ চক্রবর্তীর কথায়, “বিক্রি প্রায় নেই বললেই চলে। দোকান চালানোর খরচ তোলাই এখন দায় হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই অবস্থা আরও কিছু দিন চললে দোকানের ঝাঁপ বন্ধ করা ছাড়া উপায় থাকবে না।”
পাশাপাশি চূড়ান্ত সমস্যায় পড়েছেন সোনার কারিগররা। কারিগরদের দুর্দশার কথা বলতে গিয়ে ‘বঙ্গীয় স্বর্ণশিল্পী সমিতি’র সাধারণ সম্পাদক টগর পোদ্দার বলেন, “১৯৬৩ সালে স্বর্ণ নিয়ন্ত্রণ আইন চালু হওয়ার পর প্রায় ৯০ শতাংশ গয়নার কারিগর বেকার হয়ে পড়েছিলেন। অভাবের তাড়নায় সেই সময়ে অনেকে আত্মহত্যা করতে বাধ্য হন। এখন ফের সেই রকম অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। কারিগরদের হাতে কাজ প্রায় নেই বললেই চলে। এই অবস্থা চলতে থাকলে এ বারও আত্মহত্যার ঘটনা ঘটলে অবাক হব না।” তিনি জানান, সমস্যাটি নিয়ে আলোচনার জন্য চলতি মাসেই সমিতির বিশেষ বৈঠক ডাকা হয়েছে। |
|
|
|
|
|