|
|
|
|
সম্পাদকীয় ১... |
আপসের ভুল চেষ্টা |
শিরোনাম প্রকৃত সংবাদ নহে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সরকারি ঋণের ‘রেটিং’ বা মান ‘ট্রিপল এ’ হইতে ‘ডাবল এ প্লাস’-এ নামিয়াছে ইহা শিরোনাম। আন্তর্জাতিক ক্রেডিং রেটিং সংস্থা স্ট্যান্ডার্ড অ্যান্ড পুয়োরস এই রায় ঘোষণার পর হইতে দুনিয়া জুড়িয়া শেয়ার বাজারে ধস নামিয়াছে, বিদেশি মুদ্রার বাজারে টালমাটাল চলিতেছে। ঘোষণাটির মূল অর্থ নিতান্ত সরল: মার্কিন সরকারকে ঋণ দেওয়া এ যাবৎ সম্পূর্ণ নিরাপদ ছিল, এস অ্যান্ড পি’র সংশোধনীর অভিঘাতে সেই নিরাপত্তা টোল খাইয়াছে। যে পড়ুয়া বরাবর একশোয় একশো পায়, তাহার নম্বর কমিয়া গেলে শোরগোল উঠিবেই, বিশেষত সে-ই যদি হয় বিশ্ব অর্থনীতির এক নম্বর শক্তি এবং তাহার জাতীয় মুদ্রাটিই হয় বিশ্ব বাজারের সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ মুদ্রা। কিন্তু তথাপি শিরোনাম প্রকৃত সংবাদ নহে। প্রকৃত সংবাদ রহিয়াছে শিরোনামের আড়ালে। সংবাদ দুইটি। একটি রাজনীতির, অন্যটি অর্থনীতির। তবে বিচ্ছিন্ন নহে, তাহারা পরস্পর অন্বিত।
মার্কিন অর্থনীতির অন্তর্নিহিত সমস্যাটি কী? এক কথায়, আয় এবং ব্যয়ের ভারসাম্য নাই। কী সরকারি কোষাগার, কী বেসরকারি পরিসর সর্বত্রই আয় অপেক্ষা ব্যয় অনেক বেশি। বস্তুত, অমিতব্যয়িতা সর্বগ্রাসী। এক দিকে, মার্কিন সমাজে সঞ্চয়ের হার কম। সুদের হার অত্যন্ত কম হওয়ার ফলে ঋণ করিয়া ব্যয়ের প্রবণতা অতিমাত্রায় বাড়িয়াছে। অন্য দিকে, গত এক দশকে মার্কিন সরকারের ব্যয় বিপুল ভাবে বাড়িয়াছে, আয়বৃদ্ধি তুলনায় অনেক কম। ব্যয়বাহুল্যের একটি বড় কারণ নিশ্চয়ই একাধিক ‘সন্ত্রাসবিরোধী’ যুদ্ধ, কিন্তু তাহার সহিত সামাজিক ব্যয়বৃদ্ধিও যুক্ত হইয়াছে। পাশাপাশি, রিপাবলিকান জর্জ ডব্লিউ বুশের আট বছরের জমানায় সম্পন্ন বর্গের নাগরিকদের নানাবিধ কর-ছাড় দেওয়া হইয়াছে, তাহার ফলে রাজস্ব সীমিত, সংকুচিত। ফলে ঋণের বোঝা উত্তরোত্তর বাড়িয়া চলিয়াছে। আশির দশকে মার্কিন জাতীয় আয়ের অনুপাতে দেশের মোট ঋণ ছিল চল্লিশ শতাংশের কাছাকাছি, একুশ শতকের গোড়ায় তাহা ষাট শতাংশে পৌঁছয়, এখন অনুপাতটি প্রায় একশো শতাংশ ছুঁইয়াছে। ঋণ করিয়া ঘৃত পানের উপদেশটি সদুপদেশ নহে, বিষ পানের কথা বলিলেই বরং অমিতব্যয়ীদের উপকার হইত। এখন কোষাগার যেখানে পৌঁছাইয়াছে, তাহাকে খাদের কিনারা বলিলে অত্যুক্তি হয় না। শেষ মুহূর্তে ঋণের সীমা বাড়িয়াছে, কিন্তু অর্থনীতির ভারসাম্য যে তিমিরে ছিল, সেই তিমিরেই। ঋণের বাজারে নম্বর হয়তো অচিরেই বাড়িবে, কিন্তু মূল সমস্যার সমাধান সুদূরপরাহত। বারাক ওবামা এই সমস্যা সৃষ্টি করেন নাই। যুদ্ধ, অমিতব্যয় এবং কর ছাড়, সকলই তাঁহার পূর্বসূরির কীর্তি। কিন্তু তিনি সেই উত্তরাধিকারের প্রকোপ কমাইবার সুযোগ পাইয়াছিলেন। তাঁহার দেশেরই এক নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ, মিল্টন ফ্রিডম্যান বলিয়াছিলেন, নির্বাচনের পর প্রথম এক বছর ক্ষমতাসীন রাজনীতিকের পক্ষে ‘মধুচন্দ্রিমার কাল’, সাহসী এবং জন-অপ্রিয় পদক্ষেপগুলি তখনই করিতে হয়। কর বৃদ্ধি এবং ব্যয়সংকোচের জরুরি সিদ্ধান্তগুলি ওবামা সময় থাকিতে বলবৎ করিতে পারিতেন, করিলে সংক্রান্তি তাঁহার শিরে উপনীত হইত না। এখানেই তাঁহার রাজনৈতিক ব্যর্থতা। তিনি আপসের পথে চলিতে চাহিয়াছিলেন, বিপক্ষীয় রিপাবলিকানদের স্বমতে আনিতে চাহিয়াছিলেন। আদর্শ হিসাবে চমৎকার, কিন্তু মার্কিন রাজনীতি আপাতত সেই আদর্শ হইতে বহুদূরবর্তী দুই তরফেই, বিশেষত রিপাবলিকান দলের ‘টি পার্টি’ নামে অভিহিত চরমপন্থী শিবিরে বীজমন্ত্র একটিই: বিনা যুদ্ধে নাহি দিব সূচ্যগ্র মেদিনী। ওবামা বলিতেই পারেন, এই আপসহীন দলতন্ত্র মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্বধর্ম নহে, ‘বাইপার্টিজান’ নীতিতে অর্থাৎ দুই দলের সমন্বয়ের পথেই সেই দেশের রাজনীতির চলা উচিত। কিন্তু কে শুনিবে তাঁহার কথা? চাপের মুখে নতজানু প্রেসিডেন্টের সদুপদেশ? |
|
|
 |
|
|