|
|
|
|
বাঁধ ভাঙা জলে বিপন্ন হাজার হাজার পরিবার |
অর্ঘ্য ঘোষ • লাভপুর |
টানা বৃষ্টির জেরে জেলার কোথাও ভেঙে গিয়েছে নদীবাঁধ, কোথাও রাস্তা-কজওয়ের উপর দিয়ে প্রবল বেগে জল বইছে। এর ফলে যোগাযোগ তো বিচ্ছিন্ন হয়েছে। বাড়ির মধ্যে জল ঢুকে যাওয়ায় উনুন পর্যন্ত জ্বালাতে পারছেন না বেশকিছু এলাকার বাসিন্দারা। সবচেয়ে খারাপ অবস্থা লাভপুরের থিবা পঞ্চায়েত এলাকায়।
জলের চাপে কুয়ে নদীর বাঁধ ভেঙে জলমগ্ন হয়ে পড়েছে থিবা পঞ্চায়েতে বেশ কিছু গ্রাম। ওই এলাকার বেশ কিছু রাস্তা জলে নীচে চলে যাওয়ায় যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। বাড়ি-ঘরে জল ঢুকে যাওয়ায় অধিকাংশ পরিবারে উনুন জ্বলেনি। কিন্তু প্রশাসনের তরফ থেকে দুর্গত পরিবারগুলির কাছে ত্রাণ সামগ্রী পৌঁছে দেওয়া হয়নি বলে অভিযোগ উঠে। প্রশাসন ও স্থানীয় সূত্রে জানা গিয়েছে, ১৯৯৮ সালের বন্যায় লাভপুরের মিরিটী গ্রামের কাছে কুয়ে নদীর বাঁধ ভেঙে যায়। তার পর থেকে প্রতি বছর কম বেশি নদীর জলে প্লাবিত হয় ওই এলাকা। গত বছর বর্ষার থিবা পঞ্চায়েত ১০০ দিন কাজের প্রকল্পে প্রায় ১১ লক্ষ টাকা ব্যায়ে ওই বাঁধ পুননির্মাণের কাজ শুরু করে। কিন্তু অর্থাভাবে সংস্কারের কাজ সম্পূর্ণ করা যায়নি বলে পঞ্চায়েত সূত্রে জানানো হয়েছে। |
 |
রানিগঞ্জ-মোরগ্রাম সড়ক উপচে বইছে শাল নদীর জল।
দুবরাজপুরের গড়গড়া ঘাটের কাছে দয়াল সেনগুপ্তের তোলা ছবি। |
মঙ্গলবার সকাল সাড়ে ৭টা নাগাদ ফের ওই একই জায়গায় প্রায় ৭০ মিটার নদী বাঁধ ভেঙে যায়। এর ফলে জলমগ্ন হয়ে পড়ে থিবা পঞ্চায়েত এলাকার ৭-৮টি গ্রাম। দুর্গত হন ১৮ হাজারের বেশি মানুষ। প্রশাসনের তরফে অবশ্য দাবি করা হয়েছে, এলাকার চরাটি গ্রামের প্রায় ৫ হাজার মানুষ বন্যা কবলিত হয়েছেন। এ দিন সকাল ১০টা নাগাদ গিয়ে দেখা গেল কীর্ণাহার-বলরামপুর সড়কের উপর দিয়ে কোথাও ৬ ফুট, কোথাও ৩ ফুট উঁচু হয়ে জল বইছে। জল পৌঁছে গিয়েছে কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী প্রবণ মুখোপাধ্যায়ের মিরাটীর বাড়ির দোড়গোড়ায়। তাঁর বাড়ির দুর্গামণ্ডব চত্বরেও ছুঁয়েছে জল। গ্রামবাসীরা কোথাও সাঁতার আবার কোথাও কোমর সমান জলে ঝুঁকি নিয়ে যাতায়াত করছেন।
মিরাটীর প্রভাত মণ্ডল, নারায়ণ মণ্ডল, ব্রাহ্মণপাড়ার সুনিতা বাগদি, অজিত দাস এবং বেনেপাড়ার সন্তু দাস, সমীর দাসদের বাড়ির উঠোনে জল বইছে। মাটির দেওয়ালে সজোরে ঝাপটা মারছে নদীর জল। যে কোনও সময় বাড়ি ভেঙে পড়তে পারে এই আশঙ্কায় ওই সব বাসিন্দারা বাড়ির জিনিসপত্র, গবাদি পশু তুলে নিয়ে গিয়েছেন অপেক্ষাকৃত নিরাপদ স্থানে। কিন্তু নিরাপদ স্থানই বা কোথায়? এর আগে অন্য বার বন্যায় গ্রামের দুঃস্থ মানুষেরা বেনেপাড়ার কালীমন্দির কিংবা প্রণববাবুর দুর্গামণ্ডপে আশ্রয় নিতেন। কিন্তু এ বারে ওই দুই মন্দির চত্বরে পৌঁছে গিয়েছে বন্যার জল। সন্তু দাস, সমীর দাসদের কথায়, “ভাগ্যিস সকালে বাঁধ ভেঙেছিল। তাই গবাদি পশু, জিনিসপত্র বাঁচাতে পেরেছি। রাতে বাঁধ ভাঙলে দেওয়াল চাপা পড়ে মরতে হত সবাইকে।” সুনিতা বাগদি, কাজল বাগদিরা বলেন, “বাড়ি-ঘরে জল ঢুকে যাওয়ায় উনুন জ্বালাতে পারিনি। তাই রান্না হয়নি। বাচ্চাদের সঙ্গে মুড়ি চিবিয়ে রয়েছি। প্রশাসন এখনও পর্যন্ত কোনও ত্রাণ সামগ্রী পাঠায়নি।”
স্থানীয় বাসিন্দা তথা সংশ্লিষ্ট লাভপুর পঞ্চায়েত সমিতির সদস্য কংগ্রেসের গৌতম সরকার বলেন, “থিবা পঞ্চায়েত এলাকায় ৬-৭টি গ্রাম আংশিক অথবা সম্পূর্ণ জলমগ্ন হয়ে পড়েছে। দুর্গত প্রায় ১৮ হাজার মানুষ। ত্রাণ বলতে এখনও পর্যন্ত মিলেছে এক কুইন্টাল চিড়ে, ২৫ কেজি গুড়, ১০০টি ত্রিপল। যৎসামান্য ওই ত্রাণ সামগ্রী কাকে বাদ দিয়ে কাকে দেব ভেবে পাচ্ছি না।” যদিও বোলপুরের মহকুমাশাসক দেবাশীস নন্দী বলেন, “মহকুমায় বন্যাত্রাণ কেন্দ্রগুলি চালু করা হয়েছে। দুর্গত মানুষদের সেখানে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। কুয়ে নদীর বাঁধ ভেঙে মিরাটী, ব্রাহ্মণপাড়া, জয়চন্দ্রপুর এবং বেনেপাড়ার প্রায় ৫ হাজার মানুষ বন্যা কবলিত হয়ে পড়েছেন। তাঁদের কাছে শুকনো খাবার, ২ হাজার ত্রিপল পাঠানো হয়েছে।”
এ দিকে, প্রবল বৃষ্টির জন্য নদী কিংবা বিভিন্ন জলাশয়ে জল বেড়ে যাওয়ায় কোথাও সেতু বা রাস্তা তলিয়ে গিয়েছে। মঙ্গলবার সকাল থেকেই লাভপুরের লাঘাটার সড়ক সেতু কুয়ে নদীর জলে তলিয়ে যাওয়ায় সিউড়ি-কাটোয়া সড়কে সরাসরি যানচলাচল বন্ধ হয়ে গিয়েছে। দুই পারে বাস বদল করে গন্তব্যে পৌঁছতে হচ্ছে যাত্রীদের। কিন্তু প্রশাসন নদী পারাপারের জন্য এ দিন দুপুর পর্যন্ত কোনও নৌকার ব্যবস্থা করে দেয়নি। কার্যত প্রাণ হাতে নিয়ে লাগোয়া রেল সেতুর উপর দিয়ে যেতে হচ্ছে যাত্রীদের। |
|
সিউড়ি-কাটোয়া সড়কে লাভপুরের লাঘাটা সেতু উপচে বইছে কুয়ে নদীর জল। ফলে ওই সেতুর দু’পাশে
দাঁড়িয়ে পড়ছে যাত্রীবোঝাই বাস। প্রশাসন নৌকার ব্যবস্থা না করেনি। বাধ্য হয়ে বাস থেকে নেমে প্রাণ হাতে
নিয়ে পাশের রেলসেতু দিয়ে গন্তব্যে পৌঁছতে হচ্ছে যাত্রীদের। মঙ্গলবার সোমানাথ মুস্তাফির তোলা ছবি। |
মুরারই যাওয়ার জন্য এ দিন বৃদ্ধা মাকে নিয়ে বাসে লাঘাটা পৌঁছে ছিলেন বর্ধমানের কেতুগ্রামের সুবীর চোধুরী। সিউড়ি যাওয়ার জন্য ওই জেলারই শ্রী গ্রামের পঞ্চান্ন বছরের শম্ভুরঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়ও এসেছিলেন। কিন্তু লাঘাটায় রেলসেতু পার হতে পারেননি তাঁরা। বাধ্য হয়ে বাড়ি ফিরে যেতে হয়েছে তাঁদের। আক্ষেপের সঙ্গে তাঁরা বলেন, “রেলসেতু পার হব কী? নিচের দিকে তাকালে মাথা ঘুরে যাচ্ছে। পা ফসকালেই তলিয়ে যেতে হবে নদীতে। প্রশাসন নৌকোর ব্যবস্থা করলে এমন হয়রানি হত না।” বোলপুরের মহকুমাশাসক বলেন, “ওই সব এলাকার জন্য লাভপুরের বিডিওকে ৩-৪টি নৌকার ব্যবস্থা করতে বলা হয়েছে।”
একই ভাবে শাল নদীর জলে বল্লভপুরের কাছে বেইলি সেতু তলিয়ে যাওয়ায় সিউড়ি-বোলপুর সড়ক, দুবরাজপুরের গড়গড়া ঘাটে সেতুর উপর দিয়ে শাল নদীর জল যাওয়ায় রানিগঞ্জ-মোরগ্রাম জাতীয় সড়কের সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়েছে।
এ ছাড়া, ময়ূরেশ্বরের কামড়াঘাটে দ্বারকা নদীর জলে কজওয়ে তলিয়ে যাওয়ায় সাঁইথিয়া-মল্লারপুর সড়ক, মুরারইয়ে ডুরিয়া সেতুর সংলগ্ন রাস্তায় পাগলা নদী এবং মাঠভাসি জল প্রবাহিত হওয়ায় নলহাটি-মুরারই সড়ক, মুরারইয়ের ভাদিশ্বর মসজিদের কাছে পুকুরের জমা জল বের করার জন্য স্থানীয় বাস্নিদারা রাস্তা কেটে দেওয়ায় মুরারই-রঘুনাথগঞ্জ সড়ক-সহ জেলার বেশ কিছু স্থানে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছে বলে প্রশাসন সূত্রে জানা গিয়েছে।
জেলাশাসক সৌমিত্র মোহন বলেন, “নদীবাঁধ ভেঙে লাভপুরের কয়েকটি এলাকা জলমগ্ন হয়ে পড়েছে। তবে একে বন্যা বলা যায় না। প্রতি বছরই ওই এলাকা এমনই ভাবে জলমগ্ন হয়। প্রচুর ত্রাণসামগ্রী মজুত রয়েছে। ইতিমধ্যে বিডিওর-র মাধ্যমে ওই এলাকায় ত্রাণ সামগ্রী বিলিও করা হচ্ছে। মুরারইয়ের কিছু এলাকা প্লাবিত হয়েছে বলে খবর পেয়েছি। এখনও পর্যন্ত নদীগুলির জল বিপদসীমার নীচে রয়েছে। তিলপাড়া জলাধারের জল কমের দিকে। সন্ধ্যা ৭টা থেকে সেখানে ১৬ হাজার ৬০০ কিউসেক জল ছাড়া হচ্ছে।” |
|
|
 |
|
|