|
|
|
|
নিছক গুন্ডামি না তরুণ প্রজন্মের হতাশা, উত্তর খুঁজছে ব্রিটেন |
নিজস্ব প্রতিবেদন |
তুলনাটা আসছে বারবারই।
ফের কি ‘ব্রিক্সটন দাঙ্গার’ পুনরাবৃত্তি দেখছে লন্ডন? বা ‘ব্রডওয়াটার ফার্ম সংঘর্ষে’র? প্রায় তিন দশক আগে রাজপরিবারে দুনিয়ার নজর কাড়া বিয়ের পরে লন্ডন কাঁপিয়ে দিয়েছিল পুলিশ-কৃষ্ণাঙ্গ জনতার ওই সব সংঘর্ষ। এ বারও তাই। সে বারও আর্থিক মন্দায় হাঁসফাঁস করছিল ব্রিটেন। আর অর্থনৈতিক দিক থেকে পিছিয়ে পড়া বা মিশ্র জাতি গোষ্ঠী অধ্যুষিত যে সব এলাকায় সংঘর্ষ হয়েছিল, এ বারও মোটামুটি সেই সব বা সেই রকম এলাকাতেই ছড়াচ্ছে আগুন।
পুলিশের গুলিতে এক কৃষ্ণাঙ্গ যুবক মার্ক ডুগ্গানের মৃত্যুকে কেন্দ্র করে অশান্তির সূত্রপাত এ বার। পূর্ব লন্ডনের টটেনহ্যাম এলাকা থেকে শুরু হয়ে যা ছড়িয়ে পড়েছে লন্ডনের বাইরেও। উপ-প্রধানমন্ত্রী নিক ক্লেগ বা লন্ডন পুলিশের তরফে দাবি করা হয়েছে, পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে লুঠতরাজ চালাচ্ছে গুন্ডারা। একটি জায়গায় যে কায়দায় গোলমাল পাকানো হচ্ছে, ঠিক তারই নকল করে অন্য জায়গায় ছড়ানো হচ্ছে অশান্তি। সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং সাইট টুইটার বা মোবাইলে মেসেজের মাধ্যমে সংঘর্ষ ছড়ানোর ডাক দেওয়া হচ্ছে। তরুণ-তরুণীরা শপিং মলে ঢুকে লুঠতরাজ চালাচ্ছে। ফ্ল্যাট স্ক্রিন টিভি, মোবাইল ফোন, আইপড হাতে করে বেরিয়ে আসছে, তা নিয়ে হাসিমুখে ছবি তুলছে, এমনকী সোশাল নেটওয়ার্কিং ওয়েবসাইটে সেই ছবি পোস্টও করছে। ইলিং-এর এক বাসিন্দা বলছিলেন, “শ-দেড়েক ছেলে গাড়ির কাচ ভাঙতে ভাঙতে চলে গেল। বিনা কারণে হিংসা ছড়াচ্ছে এরা।”
তবে বিশ্লেষকদের ব্যাখ্যা বা সাধারণ মানুষের অভিজ্ঞতা বলছে, বিষয়টা এত সোজাসাপ্টা নয়। গুন্ডারা পরিস্থিতির সুযোগ নিচ্ছে ঠিকই, তবে এই অশান্তি অনেকটাই হতাশ যুব সমাজের ক্ষোভের প্রকাশ। এবং লুঠতরাজের মধ্যেও ‘লুঠের আনন্দের’ পাশাপাশি সেই পিছিয়ে পড়া মানুষের মনস্তত্ত্বও দেখছেন অনেকে।
৩০ বছর আগে শ্বেতাঙ্গ পুলিশের সংঘর্ষ ছিল মূলত কৃষ্ণাঙ্গদের সঙ্গে। ছিল তীব্র বর্ণবিদ্বেষ। এ বার বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর লোককেও দেখা গিয়েছে রাস্তায় নামতে। ইনস্টিটিউট অফ কমিউনিটি কোহেশন-এর শিক্ষক মাইক হার্ডির সাফ কথা, “বর্ণ, ধর্ম, জাত নয়। যাঁরা বঞ্চিত, এ লড়াই তাঁদেরই।” তাঁর মতো অনেকেরই বক্তব্য, ব্রিটেনে ধনী এবং নিম্নবিত্তের ফারাক দিন দিন বেড়েই চলছে। শুধু গত বছরেই ব্রিটেনের ১০০০ জন সব থেকে ধনী মানুষের সম্পদ ৩০ শতাংশ বেড়েছে। অথচ মন্দার জের সামলাতে, বাজেট ঘাটতি সামলাতে ব্রিটেনের নতুন সরকার বিভিন্ন সামাজিক সুরক্ষা বা যুব সহায়তা প্রকল্পে কাটছাঁট করেছে। শিক্ষাসংক্রান্ত অনুদান কমানো হচ্ছে। যার জেরে ভুগছে তরুণরা। তবে ঘটনা এটাই, কৃষ্ণাঙ্গ অধ্যুষিত টটেনহ্যাম লন্ডনের দরিদ্রতম বরোগুলোর অন্যতম। সেখানে বেকারত্বের হার লন্ডনে সর্বোচ্চ। তাই পুলিশের সঙ্গে প্রথমে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে কৃষ্ণাঙ্গ তরুণরাই। যে সব এলাকায় সব থেকে বেশি সংঘর্ষ হচ্ছে, তার অন্যতম পূর্ব লন্ডনের হ্যাকনির বাসিন্দা ই নানের ক্ষোভ, “চাকরি নেই। টাকা নেই। অথচ আমরা দেখছি, অন্য লোকরা বিনা পয়সায় অনেক সুবিধা ভোগ করছে। আমরা তা পাব না কেন?”
এই ধরনের বক্তব্যের উল্লেখ করে লিডস বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজতত্ত্বের শিক্ষক পল বাগ্গুলে বলছেন, “৮০র দশকের সংঘর্ষের সঙ্গে তুলনা করলে দেখব, এখন ফ্ল্যাটস্ক্রিন টিভি, মোবাইল ফোন, এমন অনেক জিনিস সহজে লুঠ করা যায়। অনেকে হয়তো এই কাজ আগে করেওনি। যেমন অল্পবয়সী মেয়েরা। এদের অনেকেই ভাবছে, এই জিনিসগুলো তো আমি আর কোনও ভাবে পাব না। তাই যখন পাচ্ছি, নেব না কেন? ধনীরাই কেন শুধু এগুলো ভোগ করবে?”
যারা রাস্তায় টায়ার পোড়াচ্ছে, পুলিশের সঙ্গে মারামারিতে জড়িয়ে পড়ছে, তাদের অনেকের সঙ্গে কথা বলে সংবাদসংস্থা রয়টার্স জানাচ্ছে, বেকারত্বের হার বেশি, এমন এলাকা থেকেই এরা এসেছে। মূল সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন। শিক্ষাগত যোগ্যতা বেশি নয়। সামাজিক সুরক্ষা পরিষেবায় কাটছাঁট হওয়ার পরে এদের প্রশ্ন, সরকার কি আমাদের কথা কিছুই ভাববে না? ব্রিটেনের একটি দৈনিকে বিশ্লেষক মেরি রিডেল বলছেন, ‘লস্ট জেনারেশন। যুদ্ধে নেমেছে এক হারিয়ে যাওয়া প্রজন্ম।’
আবার সেটাই সব নয়। কোনও কোনও মহল থেকে বলা হচ্ছে, ৩০ বছর আগে কৃষ্ণাঙ্গদের বিরুদ্ধে শ্বেতাঙ্গ পুলিশের যে বৈষম্যমূলক আচরণ থেকে সংঘর্ষের সূত্রপাত, তা আজ আর সে ভাবে খাটে না। গত কয়েক দশকে ওই আচরণ অনেকটাই শুধরানো গিয়েছে। কিন্তু যে সব এলাকায় সংঘর্ষ চলছে, সেখানকার যুবকরা কিন্তু পুলিশের উপর প্রায় একই রকম ক্ষিপ্ত। ডুগ্গানের মৃত্যুকে কেন্দ্র করে সেই ক্ষোভ ফুটে বেরিয়েছে। টটেনহ্যামের ৪৩ বছর বয়সী মিশেল জ্যাকসন চাকরি করেন। তাঁর প্রশ্ন, “পুলিশ সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলতে ব্যস্ত। ডুগ্গানের পরিবারের সঙ্গেই তো তাঁরা কথা বলেনি।”
টটেনহ্যামের বাসিন্দা, সাউথ ব্যাঙ্ক বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ২৮ বছর বয়সী জেক মানুর কথায়, “পুলিশ তো আমাদের মানুষ বলেই মনে করে না। আমাদের সঙ্গে কথাই বলে না। আপনার গায়ের রং যদি কালো হয় বা যদি হুডওলা জ্যাকেট পরেন, রাস্তায় আপনাকে জিজ্ঞাসাবাদ করবে।” কৃষ্ণাঙ্গ তরুণ বা যুবকদের এই যখন-তখন রাস্তায় দাঁড় করিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ নিয়ে পুলিশের বিরুদ্ধে ক্ষোভ কিন্তু জমেই আছে তলায় তলায়।
পুলিশের তরফে অবশ্য বিবৃতি দিয়ে দাবি করা হচ্ছে, স্থানীয় বিভিন্ন জাতি-গোষ্ঠীর মানুষকে নিয়ে গঠিত কমিটিই পুলিশকে তল্লাশি-নীতির ব্যাপারে পরামর্শ দেয়। স্থানীয় মানুষের একটা বড় অংশ আবার এই ব্যাখ্যা মানতে রাজি নন।
মিশেলই বলছেন, “যখন তখন আমাদের গাড়ি থেকে টেনে নামানো হয়। যেন আমরা ড্রাগ বেচি। তাই যা ঘটছে, তা ঘটারই ছিল। এই রকম করলে যদি আমাদের কথা কেউ শোনে!” |
|
|
 |
|
|