|
|
|
|
প্রবন্ধ ২... |
আমার প্রাণের ’পরে
প্যারিসের অতিথিশালায় |
১৬ সেপ্টেম্বর ১৯২০। রবীন্দ্রনাথের মুখোমুখি কঁতেস দ্য নোয়াই। ফরাসি
সাহিত্যজগতের এক অ-সামান্য নারী। প্রাচ্যের কবিকে জয় করতে এসেছিলেন
তিনি। ফিরে গেলেন
যখন, তখন তিনি গীতাঞ্জলির স্রষ্টার ভক্ত। চিন্ময় গুহ |
“যা কিছু মহৎ ও তীব্র তাকে আমি ভালবাসি...”
|
তিনি এসেছিলেন ঝড়ের মতো। থরথরকম্পিত মর্মরমুখরিত। ফরাসি কবিতার এক কিংবদন্তি কঁতেস দ্য নোয়াই (১৮৭৬-১৯৩৩)। রবীন্দ্রনাথ চিনতে পারেননি তাঁর রাগমালা।
তাঁর রূপের ভাস্কর্য আবহমান কালের জন্য ধরে রাখতে চেয়েছেন স্বয়ং রদ্যাঁ। মৃত্তিকারূপটি আছে প্যারিসের রঁদ্যা প্রদর্শশালায়, শ্বেতপাথরের আবক্ষ মূর্তিটি নিউ ইয়র্কের মেট্রোপলিটন মিউজিয়মে। আর তাঁর প্রেমিকেরা? তাঁদের মধ্যে ছিলেন বিশ শতকের শ্রেষ্ঠ কয়েকজন সাহিত্যিক, মার্সেল প্রুস্ত, আঁদ্রে জিদ, পল ভালেরি, গাব্রিয়েল দান্নুনৎসিয়ো আর জাঁ ককতো! ইসাডোরা ডানকান তাঁকে অভিহিত করেছেন ‘the inspired face of the Sappho of France’ বলে। ‘Comme une fleur ouverte où logent les abeilles...’(উন্মুক্ত ফুলের মতো, যেখানে বাসা বাঁধে মৌমাছিরা/ আমি ছড়িয়ে দিয়েছি সুগন্ধি ও সুর)।
ফরাসি গদ্যের সর্বকালের সেরা রূপকার প্রুস্ত তাঁর ‘intoxicated admirer’, তাঁর ‘অপরূপ আঁখিপাতের’ কথা ভেবে মৃত্যুশয্যা থেকেও তাঁকে চিঠি লেখেন, বুনে তোলেন ওই রহস্যময়ীকে নিয়ে এক ভিন্ন সুরের রচনা Les éblouissements. মুগ্ধ অনুরাগীদের মধ্যে আরও ছিলেন পিয়ের লোতি, ফ্রেদেরিক মিস্ত্রাল, ফ্রাঁসিস জাম,
মাক্স জাকব।
১৯২০ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর ফরাসি ধনকুবের ও শিল্পরসিক আলবের কান প্যারিসের উপকণ্ঠে বুলন-স্যুর-সেন-এর অতিথিশালা ওত্যুর-দ্যু-মঁদ-এ কঁতেস দ্য নোয়াই-কে নিয়ে এলেন রবীন্দ্রনাথের কাছে, তাঁকে পরিচয় করিয়ে দিলেন ফরাসি দেশের শ্রেষ্ঠ কবি ‘The Poet’ হিসেবে। হাতে তাঁর কুসুমধনু। রথীন্দ্রনাথ তাঁর দিনপঞ্জিতে লিখলেন: ‘Her appearance, her dress, her very first words with father brought out the coquette in her. ... Her vivacity of conversation was remarkable. But her movements and manners seemed unnatural and calculated to produce effect. But after she had been with father for some time she soon quietened down and then her own true self came out.’ |
|
প্রভাতকুমার ‘রবীন্দ্রজীবনী’তে লিখেছেন, ‘এই বিদুষীর কথাবার্তা মনস্বিতা কবিকে খুবই আশ্চর্য ও মুগ্ধ করে।’ তাঁর স্মৃতিকথা On the Edges of Time-এ রথীন্দ্রনাথ যোগ করেছেন: ‘Before she left she confessed to father that she had come to conquer but all her vanity had vanished on meeting him, and she was going away a devotee and a worshipper.’ তিনি রবীন্দ্রনাথকে বলেছিলেন, প্রথম মহাযুদ্ধে জার্মানির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণার দিন তিনি ফরাসি প্রধানমন্ত্রী জর্জ ক্লেমাঁসো-র সঙ্গে ছিলেন, তাঁরা কথা বলার অবস্থায় ছিলেন না বলে খুলে বসেছিলেন ‘গীতাঞ্জলি’, আর যতই পড়ছিলেন, ততই যুদ্ধের কথা ভুলে যাচ্ছিলেন তাঁরা। সে দিন রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে বাগানে হাঁটতে হাঁটতে আনা বলে উঠেছিলেন, রবীন্দ্রনাথ তাঁকে আলো দিয়েছেন, দিন ও রাত্রির আলো।
কে এই রহস্যরূপিণী? বাবা ছিলেন রুমানীয় রাজকুমার গ্রেগোয়ার বিবেসকো-বাসারাবা আর মা ছিলেন এক গ্রিক গায়িকা, যাঁকে গানের অর্ঘ্য নিবেদন করতেন গীতিকারেরা। ফরাসি দেশের বনেদি পরিবারে রাজকুমার মাতিয়্য দ্য নোয়াই-এর সঙ্গে বিয়ের পর, বিশেষত বিবাহ-বিচ্ছেদের পর, রাজকুমারী আনা হয়ে উঠলেন ফরাসি অভিজাত সমাজের মক্ষিরানি। শুধু প্রধানমন্ত্রী ক্লেমাঁসো নন, কুখ্যাত জাতীয়তাবাদী লেখক ও রাজনীতিবিদ মরিস বারেস-এরও বান্ধবী হয়ে উঠলেন তিনি।
অন্তত তিনটি উপন্যাস ও স্মৃতিকথা ছাড়াও তিনি লিখেছিলেন কয়েকটি অসামান্য কবিতার বই। বিশের দশকে তাঁর কবিতা হয়ে উঠছিল তীব্র ও যন্ত্রণাক্ত, যেখানে জাঁ রসতাঁ খুঁজে পেয়েছিলেন ‘প্রুস্তের অভিজ্ঞান, মিরাবোর ধার আর জ্যুল র্যনার-এর নির্মম নিখুঁত আঙ্গিক।’ ১৯৬৫ সালেও বিশিষ্ট সমালোচক শার্ল দ্যু বো স্মরণ করেছেন তাঁর অমিত শক্তি আর বিদ্যুৎচমকের মতো অন্তর্দৃষ্টির কথা। ফরাসি কবিতার প্রায় সব বিশিষ্ট সংকলনেই তাঁর কবিতা আছে। ফ্রান্সের প্রথম নারী কমান্ডার অব লেজিয়ঁ দনর
তিনি, পেয়েছিলেন আকাদেমি ফ্রাঁসেজ-এর গ্রাঁ প্রি, ছিলেন শিল্পী ভাস্কর লেখক ও সংগীতকারদের জন্য ব্লুমাঁতাল পুরস্কারের অন্যতম বিচারক।
যাঁর সঙ্গে সৌন্দর্য, প্রতিভা আর প্রতিপত্তিতে তাঁর বিস্ময়কর মিল, তিনি ভিক্তোরিয়া ওকাম্পো। ৩৪ বছর বয়সী যে আর্জেন্টিনীয় নারী ১৯২৪-২৫ সালে অসুস্থ রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে গিয়েছিলেন তাঁর প্রাসাদোপম সান ইসিদ্রো-তে। আনার মতোই বিবাহ-বিচ্ছেদের পর তিনিও ক্রমশ হয়ে উঠেছিলেন সাহিত্যজগতের রানি। বাঙালি জেনেও জানতে চায়নি রবীন্দ্রনাথের ‘বিজয়া’ এক পুরুষ-শিকারি, অর্তেগা ই গাসেত, কাউন্ট কাইজারলিঙ্ থেকে বোরহেস পর্যন্ত যাঁর বন্ধু। দান্তের ‘দিভিনা কম্মেদিয়া’-র ভাষ্যকার ভিক্তোরিয়া তাঁর ‘সুর’ পত্রিকায় একে একে প্রকাশ করেছিলেন বোরহেস, কাম্যু, দ্রিও লা রশেল, সেজারেস-এর রচনা।
রবীন্দ্রনাথ কি অনুধাবন করতে পেরেছিলেন ইতিহাসের কোন আশ্চর্য মোচড়ে কঁতেস দ্য নোয়াই আর ভিক্তোরিয়া ওকাম্পো গ্রথিত হয়ে যাবেন এক ফুলমালায়? ১৯৩০ সালের মে মাসে প্যারিসের গ্যালারি পিগাল-এ তাঁর ছবির প্রথম প্রদর্শনী প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন ভিক্তোরিয়ার পাশাপাশি ‘কঁতেস দ্য নোয়াই-র চারি দিক সরগরম করে তোলার’ কথা।
ভিক্তোরিয়া নয়, আনা দ্য নোয়াই লিখেছিলেন প্রদর্শনীর ব্রশিয়র। তিনিই জিদ আর ভালেরিকে টেনে আনতে পেয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথের সেই প্রদর্শনীর তুলিরেখার তটে। রবীন্দ্রনাথের ছবির এক অন্তর্দীপ্ত আলোচনার পর (‘বিস্ময়কর এই সৃষ্টিগুলি যা একাধারে চোখ জুড়োয় আর আমাদের টেনে নিয়ে চলে বহু দূরের সেই সব দেশে, যেখানে কাল্পনিক বস্তুই বাস্তবের চেয়ে বেশি করে বাস্তব ভেবে চমৎকৃত হতে হয় কী করে যুক্তিবাদী স্বপ্নপ্রেমিক রবীন্দ্রনাথ এই সৃষ্টির দ্বার খুলে দিলেন!’) তিনি লিখেছিলেন: ‘I love you and have more admiration for you, Tagore, since when you made to us such rich and sometimes such cruel confidences; but would I ever find again the great ingenuous angel that you were, when your silent feet, on the garden gravel, made me think of my sins, imaginary perhaps, and of your sublime innocence?’ ‘Your silent feet, on the garden graval, made me think of my sins ... and of your sublime innocence’ কি আনারই জীবনকাহিনির সারাৎসার? আর কেউ না বুঝুক, ভিক্তোরিয়া কি আনার সঙ্গে প্রদর্শনীর কাজ করতে গিয়ে ধরতে পেরেছিলেন সেই মঞ্জীরগুঞ্জর রাগমালা? প্রুস্ত, ভালেরি, রদ্যাঁ, ককতো বা দান্নুনৎসিয়ো নন, রবীন্দ্রনাথই কি আনা দ্য নোয়াই-এর জীবনে জ্বালিয়ে দিয়েছিলেন এক আকাশপ্রদীপ? |
|
|
|
|
|