সম্পাদক সমীপেষু...
‘পুলিশ’ কাকে বলে? দু’টি পৃথক অভিজ্ঞতা
মাসখানেক হল আমেরিকা এসেছি। চাকুরি সূত্রে প্রবাসী পুত্রের কাছে। পূর্বেও এসেছি একাধিক বার। এখানকার এ সময়ের আবহাওয়া, দূষণমুক্ত পরিচ্ছন্ন পরিবেশ, সুন্দর রাস্তাঘাট, গাছপালা, সবুজ ঘাসে ঢাকা উন্মুক্ত প্রান্তর আর ভোগ্যপণ্যের প্রাচুর্যে উপচে পড়া বিপণি প্রাণভরে উপভোগ করার মতো। কিন্তু সবচাইতে বেশি মুগ্ধ করে এ দেশের মানুষজনের নিয়মনিষ্ঠা, কতর্ব্যপরায়ণতা আর সৌজন্যপূর্ণ ব্যবহার। উদাহরণস্বরূপ একটি ঘটনার কথা জানাই।
সে দিন ১৯ জুলাই, ২০১১। সকাল দশটা (ভারতীয় সময় সন্ধ্যা সাড়ে আটটা)। দেশে পরিজনদের সঙ্গে কথা বলার জন্য টেলিফোনের কর্ডলেস হ্যান্ডসেট হাতে নিয়ে ডায়াল করতে আরম্ভ করি। ভারতে দিল্লির নম্বরে কল করতে হলে প্রথম ০১১-৯১১১ করে তার পর স্থানীয় ল্যান্ডলাইন নম্বরটি ডায়াল করতে হয়। অসাবধানতাবশত ০১১ না করেই পরবর্তী সংখ্যার বাটনগুলি প্রেস করতে আরম্ভ করেছি। স্ক্রিনে ৯১১১ দেখেই ভুল বুঝতে পারি ও সংশোধন করার জন্য ‘অফ’ বাটনও প্রেস করেছি। কিন্তু তার আগেই সম্ভবত ‘টক’ বাটনটির উপর সামান্য চাপ পড়ে গিয়ে থাকবে। তখন আমি তা খেয়াল করিনি। যাই হোক, এর পর যত্ন সহকারে ঠিক সংখ্যাগুলি পূরণ করে যোগাযোগ স্থাপন করে কথা বলছি, মিনিট দশেক হবে, বাইরের দরজায় করাঘাত, ঠক-ঠক-ঠক। সন্তর্পণে দরজা খুলে চমকে উঠি। অতি সুদর্শন, দীর্ঘকায়, মাথায় টুপি, কোমরে রিভলভার, কেতাদুরস্ত ফিটফাট পোশাক পরিহিত এক পুলিশ অফিসার। আমায় দেখে বলেন ‘গুড মর্নিং, আপনাদের কী সমস্যা হয়েছে?’ আমি তো আকাশ থেকে পড়লাম। ‘কই না তো, আমাদের কোনও সমস্যা হয়নি।’ আবার প্রশ্ন, ‘আপনি কি ৯১১১-এ ফোন করেছেন?’ বললাম, ‘না’। ৯১১ সমগ্র আমেরিকান যুক্তরাষ্ট্রে সিকিউরিটি অর্থাৎ পুলিশ বিভাগের এমার্জেন্সি নম্বর। পরক্ষণেই আমার মনে পড়ল ৯১১ ‘কি ইন’ করেছিলাম বটে, কিন্তু সেটি যে ‘কল’-এ পরিণত হয়ে গিয়েছিল তা বুঝতে পারিনি। খুবই বিব্রত বোধ করলাম। হাতে কর্ডলেস হ্যান্ডসেটটি ধরাই ছিল। ওঁকে বোঝালাম আমার কী ভুল হয়েছিল। অনিচ্ছাকৃত ভাবে অসুবিধা সৃষ্টি করার জন্য আন্তরিক দুঃখপ্রকাশ ও ক্ষমা প্রার্থনা করলাম। অফিসারটি কোনও রকম বিরক্তি বা উষ্মা প্রকাশ না-করে স্মিত হাস্যে ঘাড় নেড়ে ‘ইটস অলরাইট’ বলে গটগট করে গিয়ে গাড়িতে উঠে বেরিয়ে গেলেন।
অতীত। লালগড়ের গোহমিডাঙ্গা হাইস্কুলে পুলিশের লাঠি। ১০ ডিসেম্বর, ২০০৯
দরজা বন্ধ করে ধপাস করে বসে পড়লাম। জানি না, ছেলেদের জন্য আবার কী সমস্যার সৃষ্টি করলাম এই বিদেশ বিভুঁইয়ে। বসে বসে ভাবছি আর হাঁপাচ্ছি। পাঁচ মিনিটও হয়নি এ বার টেলিফোন বেজে উঠল। রিসিভার তুলে বলি, হ্যালো। অপর প্রান্তে এক মহিলা কণ্ঠ ‘গুড মর্নিং স্যার, সিকিউরিটি থেকে বলছি, আপনি কি ৯১১-এ ডায়াল করেছিলেন?’ বললাম, ‘হ্যাঁ, অসাবধানতাবশত নম্বরটা সম্ভবত প্রেস হয়ে গিয়েছিল। ত্রুটির জন্য ক্ষমা করবেন।’ ‘ও. কে কোনও অফিসার কি আপনার বাড়িতে এসেছিলেন’? বললাম, ‘হ্যাঁ’। ‘আপনার বাড়ির নম্বর কি এই’? বললাম, হ্যাঁ। ‘রাস্তার নাম কী এই?’ ‘হ্যাঁ’। ‘অমুক শহর’? ‘হ্যাঁ’। ফের তাঁর কাছে অনুশোচনা প্রকাশ করায় তিনি বললেন, ‘ঠিক আছে। নাগরিকদের সুরক্ষা নিশ্চিত করাই আমাদের কাজ। আপনি কোনও অন্যায় করেননি। ভবিষ্যতেও কোনও অসুবিধা হলে অবশ্যই ৯১১-এ আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করবেন। বাই বাই’।
ফোনটি রেখে স্তম্ভিত হয়ে ভাবছিলাম, এদের সনিষ্ঠ সুন্দর নাগরিক সুরক্ষা পরিষেবা ও কর্ম তৎপরতার কথা। শুধু মাত্র ৯১১ নম্বরটি মুহূর্তের জন্য আমার ফোনের সঙ্গে যুক্ত হয়ে গিয়েছিল। কোনও বার্তালাপ হয়নি, কোনও ঘটনার বিবরণ দেওয়া হয়নি, নাম ঠিকানা দেওয়া হয়নি। কালব্যয় না-করে নিজেদের তৎরপরতায় কলার আই ডি থেকে ডাটা বেস-এ গিয়ে নাম ঠিকানা সংগ্রহ করে দশ মিনিটের মধ্যে তদন্ত করার জন্য পুলিশ অফিসার দরজায় এসে হাজির। শুধু তা-ই নয়, আরও পাঁচ মিনিটের মধ্যে কন্ট্রোল থেকে ফোন করে ঘটনার সত্যাসত্য সুনির্দিষ্ট করে নেওয়া। সবার উপরে সহানুভূতি ও সৌজন্যপূর্ণ ব্যবহার। একমাত্র এদের মতো সভ্য দেশেই সম্ভব। চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের বলেই এই দেশ প্রভাব প্রতিপত্তিতে বিশ্বের শীর্ষে।
প্রসঙ্গত আরও একটি করুণ ছবিও মানসপটে ভেসে উঠল।
১২ এপ্রিল, ২০১১। পর্ণশ্রী বেহালা, কলকাতা বেলা একটা-দেড়টা, বাগানের কাজ করতে এসে মালি দেখে দরজা খোলা। বর্ষীয়সী গৃহকর্ত্রী বনানী চট্টোপাধ্যায়ের রক্তাক্ত দেহ রন্ধনশালায় পড়ে। সংবাদ পেয়ে প্রতিবেশীরা ছুটে আসেন। মহিলার স্বামী সে সময় গৃহে ছিলেন না। বিশেষ কাজে অন্যত্র গিয়েছিলেন। প্রতিবেশীরাই ডাক্তার ডেকে আনেন। জানা যায়, কোনও ভারী বস্তু দ্বারা মাথায় বারংবার আঘাত ও প্রচুর রক্তপাতের ফলে তিনি প্রাণ হারিয়েছেন। আপাতদৃষ্টিতে হত্যার ঘটনা মনে হওয়ায়, থানায় ফোন করা হয়। থানা থেকে নির্লিপ্ত কণ্ঠে উত্তর আসে বডি নিয়ে থানায় আসুন, তার পর হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে। ঘটনার গুরুত্বের কথা জানিয়ে তাঁদের আসার জন্য অনুরোধের উত্তরে বলা হয়, ‘এখন কাউকে পাঠানো সম্ভব নয়’। ঘটনাক্রমে প্রতিবেশীদের মধ্যে একজন উপস্থিত ছিলেন যিনি ফোনটি হাতে নিয়ে তাঁদের বলেন যে, তিনি দেশের প্রধানমন্ত্রীর নিকটাত্মীয়। অবিলম্বে যদি কোনও অফিসারকে না-পাঠানো হয়, তিনি ব্যাপারটি উচ্চতর কর্তাদের গোচরে নিয়ে যাবেন। যাই হোক, এতে কাজ হয়। তাঁরা এসে উপস্থিত হন এবং প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেন।
ঘটনার সংবাদ সে দিন এবং পরবর্তী দু’ দিন ধরে প্রায় সব’কটি স্থানীয় টিভি চ্যানেল এবং সংবাদপত্রে গুরুত্ব সহকারে প্রচারিত হয়েছিল। (আ বা প ১৩ এবং ১৪ এপ্রিল ২০১১)। অবশ্য পরবর্তী কালে আগ্রহান্বিত হওয়ার মতো যথেষ্ট উপাদানের অভাবেই হয়তো তাঁরা উল্লেখনীয় ভাবে নীরব। ইতিমধ্যে শতাধিক দিবস অতিক্রান্ত। পঃ বঃ পুলিশ আজও সেই ঘটনার কোনও কিনারা করা দূরে থাক, তদন্ত এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার মতো কোনও সূত্র খুঁজে বার করে উঠতে পারেনি। সেটা তাঁদের গতানুগতিক ত্রুটিপূর্ণ ও দায়সারা প্রাথমিক তদন্ত। দীর্ঘসূত্রিতাদুষ্ট পরবর্তী অনুধাবন, দক্ষতা, নিষ্ঠা বা সদিচ্ছার অভাব, না কি অন্য কোনও কারণে, তা জানা নেই। নিজেরা সমাধান করে উঠতে না-পারলে কেনই বা গোয়েন্দা বা অন্য কোনও যোগ্যতর বিশেষজ্ঞ বিভাগের সাহায্য এ তাবৎ নেওয়া হয়নি, তারও কোনও ব্যাখ্যা মেলে না। তবে, সাধারণ গৃহবধূর মতো অরাজনৈতিক এক মহিলার সম্ভবত কোনও সমাজবিরোধী দুষ্কৃতীর দ্বারা প্রত্যক্ষ দিবালোকে, নিজ বাসভবনে নির্মম ভাবে নিহত হয়ে যাওয়া এবং সেই ঘটনার তদন্ত যথেষ্ট গুরুত্ব, নিষ্ঠা ও দ্রুততার সঙ্গে অগ্রসর না-হওয়া, রাজ্যের আইন শৃঙ্খলা ও নাগরিক সুরক্ষার ভার যাঁদের উপর ন্যস্ত তাঁদের দায়বদ্ধতা সম্পর্কে অবশ্যই আলোকপাত করে।
নিহত মহিলার বিদেশে কর্মরত একমাত্র পুত্র, তার সুস্থ সবল প্রাণপ্রাচুর্যে ভরপুর মাকে সহসা এ ভাবে হারিয়ে, বিহ্বল। তৎসহ হঠাৎ নিঃসঙ্গ হয়ে পড়া বর্ষীয়ান পিতার সুরক্ষার জন্যও উৎকণ্ঠিত। এমতাবস্থায়, বাধ্য হয় তাঁকে নিজের কাছে নিয়ে আসতে। বিদেশ থেকে বারে বারে থানায় ফোন করে খবর নেওয়ায় একই গতানুগতিক উত্তর মেলে ‘বিশ্বাস করুন আমরা সব রকম চেষ্টা করছি কোনও সূত্র পেলেই আপনাদের জানাব...’ ইত্যাদি। কিন্তু আশার আলোর ইঙ্গিত পাওয়া যায় না।
অস্বাভাবিক ভাবে স্ত্রী বিয়োগে মর্মাহত সত্তরোত্তর বরিষ্ঠ নাগরিক হতভাগ্য এই লেখক, উপরোক্ত দুটি ঘটনারই প্রত্যক্ষ সাক্ষী, হতাশ হয়ে ভাবেন কী আর বিশ্বাস করব? আমরা মুখে পরিবর্তনের ডাক দিই, লক্ষ লক্ষ মানুষের কর্মসংস্থানের আশ্বাস দিই, কলকাতাকে লন্ডন আর দার্জিলিংকে সুইৎজারল্যান্ড করে তোলার স্বপ্ন দেখি। কিন্তু সত্যিই কি পারি আমরা নিজেদের পরিবর্তন করতে, নিজেদের কর্মসংস্কৃতির পরিবর্তন করতে, আরও একটু কতর্ব্যনিষ্ঠ, নিয়মনিষ্ঠ করে তুলতে? আমরা পারি কি মানুষের জীবনের মূল্য, আরও একটু গভীর ভাবে উপলব্ধি করতে?


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.