এই ধাক্কা সাময়িক, আশ্বাস দিচ্ছে কেন্দ্র
সঙ্কটে মার্কিন ধাঁচেই ঐক্য চান মনমোহন-প্রণব

বারাক ওবামা, মনমোহন সিংহ, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
কথায় বলে, আমেরিকার হাঁচি হলে গোটা পৃথিবী সর্দি জ্বরে আক্রান্ত হয়। আমেরিকার চূড়ান্ত অর্থনৈতিক সমস্যা, কমবেশি গোটা পৃথিবীতেই উদ্বেগ সঞ্চারিত করেছে। দিল্লি দরবার থেকে মহাকরণ এই ঘটনার কী প্রভাব পড়বে তা ঠাহর করতে প্রণব মুখোপাধ্যায় থেকে অমিত মিত্র সকলেরই ভ্রূ কুঞ্চিত। এত বছরের ডলার নামক ‘মিথ’ কি এ বার সত্যিই আক্রান্ত? নাকি অচিরে পরিস্থিতি সামলে নেবেন ওবামা? অন্য দিকে, ভারতীয় অর্থনীতিবিদরা বলছেন, আমেরিকা ও গোটা ইউরোপ আবার মন্দায় আক্রান্ত হলেও ভারত কিন্তু সে ভাবে গভীর দুর্ভোগে পড়বে না। বরং মার্কিন ঋণে ভারতের অবদান দাঁড়িয়েছে ৪১০০ কোটি ডলার। যা টাকার অঙ্কে ১.৮৩ লক্ষ কোটি।
নর্থ ব্লকে অর্থমন্ত্রী প্রণব মুখোপাধ্যায় পরিস্থিতি পর্যালোচনা করতে জরুরি বৈঠক করলেন। রিজার্ভ ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়া পরিস্থিতি নজরে রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ঠিক হয়েছে, উদ্ভূত অবস্থা অনুসারে তারা কিছু জরুরি সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবে। প্রণববাবু এবং তাঁর মুখ্য অর্থনৈতিক উপদেষ্টা কৌশিক বসু অভয়বাণী দিয়েছেন যে, আমেরিকার এই আর্থিক সঙ্কটের পরিণতি যা-ই হোক না কেন, এখনই তা ভারতে কোনও বিপদ ডেকে আনছে না। মন্দা মোকাবিলায় এর আগে বারাক ওবামা এবং মনমোহন সিংহ, দু’জনকেই ‘স্টিমুলাস প্যাকেজ’ ঘোষণা করতে হয়েছিল।
সম্প্রতি পশ্চিমবঙ্গের জন্য আর্থিক প্যাকেজ ঘোষণা করেছেন কেন্দ্র, যদিও তার সঙ্গে মন্দার কোনও সম্পর্ক নেই। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় রাজ্যের ঘোরতর অর্থনৈতিক সঙ্কটে কেন্দ্রের ‘স্টিমুলাস প্যাকেজ’-এ খুশি নন। তবে ‘নেই মামা’-র থেকে ‘কানা মামা’-কে গ্রহণ করেছেন মন্দের ভাল হিসেবে।
ওবামা এবং মনমোহন দু’জনেই তাঁদের শাসনকালের মধ্যদশায় পৌঁছেছেন। দু’জনেই এক চূড়ান্ত প্রতিষ্ঠান-বিরোধিতার শিকার। কিন্তু মমতার সুবিধা, তাঁর রাজ্যাভিষেক সবে হয়েছে। এখন তাঁর জনপ্রিয়তা তুঙ্গে। কিন্তু বিশ্বায়নের এই দুনিয়ায় আর্থিক মন্দার সুনামি যদি আবার আছড়ে পড়ে, তবে ভারতের অঙ্গরাজ্য হিসেবে পশ্চিমবঙ্গও কি মানচিত্রের বাইরে থাকবে? মমতা কেন্দ্রকে এটা বোঝাতে সক্ষম হয়েছেন যে, রাজ্যের এই হাঁড়ির হালের জন্য আর যা-ই হোক, তিনি দায়ী নন। অর্থ কমিশনও জানিয়েছে, অর্থনৈতিক ভাবে দেশের সব চেয়ে বিপর্যস্ত রাজ্যগুলির মধ্যে পশ্চিমবঙ্গ অন্যতম। কিন্তু রাজনৈতিক জনপ্রিয়তা রক্ষার অর্থনীতিই কি বাংলাকে বাঁচাতে পারে?
প্রণববাবু বোঝাতে চাইছেন, অতীতের বাম সরকার ওভারড্রাফট নিয়ে রাজ্য চালিয়েছে বলেই নতুন সরকারকেও ভাতা আর ভর্তুকির অর্থনীতি কায়েম করতে হবে, এমনটা ঠিক নয়। মন্দার সময় আমেরিকার মতো মনমোহনকেও ‘স্টিমুলাস প্যাকেজের’ ব্যবস্থা করতে হয়েছে ঠিক, কিন্তু ভারত ধীরে ধীরে সেই অর্থনৈতিক ছাড়ের রাজনীতি থেকে সরে এ বার বৃদ্ধির দীর্ঘমেয়াদি লক্ষ্যে এগোতে চাইছে। কেন্দ্রের বক্তব্য, বিষয়টি তৃণমূল এবং কংগ্রেস নয়। এই আর্থিক সঙ্কটে হাতে হাত ধরে চলাটা সময়ের দাবি। কৌশিক বসু মনে করেন, এক এক দেশে অর্থনীতির মডেল এক এক রকম হতে পারে। কিন্তু আর্থিক পরিস্থিতি গোটা বিশ্বে আজ একটি সুতোয় গাঁথা।
আমেরিকায় হয়েছেটা কী?
আর্থিক মন্দা আবার আসতে পারে এই আশঙ্কায় ওবামা দেশের জন্য আরও ঋণ নিতে চান। সে জন্য মার্কিন কংগ্রেসে তিনি প্রস্তাব অনুমোদন করাতে চেয়েছিলেন। কিন্তু রিপাবলিকান দল ওবামার ডেমোক্র্যাট শাসক গোষ্ঠীর সঙ্গে এক অভূতপূর্ব স্নায়ুযুদ্ধে অবতীর্ণ হয়। ফলে ওবামার প্রস্তাব প্রথমে সবুজ সঙ্কেত পায়নি সংখ্যাগরিষ্ঠতার অভাবে। পরে অবশ্য রিপাবলিকানদের সমর্থন আদায় করে বিলটি সর্বসম্মতিক্রমে পাশ করাতে সমর্থ হন ওবামা। অর্থনীতিবিদ অভিরূপ সরকার বলেন, “সবটাই কিন্তু আশঙ্কা। আমেরিকায় আবার আর্থিক মন্দা আসতে পারে, এটা একটা আশঙ্কা। তার জন্য ঋণ নেওয়ার প্রস্তাবটিও ভবিষ্যতের কথা ভেবে। আর আমেরিকার আশঙ্কায় গোটা দুনিয়ার শেয়ার বাজারে আশঙ্কা ছড়িয়ে পড়েছে। এই ধস যে সামগ্রিক ভাবে বিশ্ব অর্থনীতির উপরেই বিরাট প্রভাব ফেলবে, সেটা না-ও হতে পারে। ফলে ওয়াল স্ট্রিটের এই অধোগতির প্রভাব খতিয়ে দেখার দরকার আছে। আমেরিকাও পরিস্থিতি সামলে উঠতে পারছে কি না, সেটার দিকেও নজর রাখতে হবে।”
তাৎপর্যপূর্ণ হল, অর্থনৈতিক সঙ্কটে দুই দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি। আমেরিকার ক্ষেত্রে রিপাবলিকান ও ডেমোক্র্যাটদের মধ্যে যতই মতপার্থক্য থাক, দেশের আর্থিক স্বার্থ রক্ষায় তারা সহজে এককাট্টা হয়ে যান। সব থেকে বড় কথা, আমেরিকার রাজনৈতিক মডেল দু’টি দলের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। কিন্তু ভারতের জোট রাজনীতি, শুধু জটিলই নয়, তা বিবিধ সংঘাতের মধ্যে তৈরি একটি খিচুড়ি। জয়তীর্থ রাওয়ের মতো অর্থনৈতিক বিশ্লেষক বলেন, “আমেরিকার রাজনৈতিক শ্রেণি ঋণগ্রহণে বোঝাপড়া সহজে করে নিতে অভ্যস্ত। কিন্তু আমাদের দেশে রাজনৈতিক শ্রেণি মতৈক্য তো দূরের কথা, আরও সংঘাত তৈরি করে।”
আমেরিকায় তিনটি রেটিং এজেন্সির অন্যতম স্ট্যান্ডার্ড অ্যান্ড পুওর’স সে দেশের সরকারের দীর্ঘমেয়াদি ঋণ সম্পর্কে যে মতামত দিয়েছে, তা সম্পর্কে অন্য দু’টি সংস্থা কী বলছে, তা জানার জন্যও ভারতের অর্থনীতিবিদরা অপেক্ষা করছেন। মন্টেক সিংহ অহলুওয়ালিয়া থেকে শুরু করে সি রঙ্গরাজনের মতো ব্যক্তিত্ব একটি বিষয়ে একমত যে, এই পরিস্থিতিতে ভারত বরং দুনিয়ার কাছে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার সুযোগ নিতে পারে। এ দেশের কিছু অর্থনীতিবিদ বলছেন, আমেরিকার সর্বনাশে এমন রণকৌশল নেওয়া উচিত, যা ভারতের জন্য পৌষ মাস হয়। যদিও চিন এর মধ্যেই আমেরিকা প্রতি হুঙ্কার দিয়ে বলেছে, প্রয়োজনে ডলারের পরিবর্তে নতুন একটি আন্তর্জাতিক মুদ্রা চালু করা হোক। আমেরিকার রাজকোষে রাখা চিনের অর্থ যেন সুরক্ষিত থাকে। কিন্তু এটাও ঠিক, আমেরিকায় চিনের বিনিয়োগের বাজারদরও অধোগতিপ্রাপ্ত। আমেরিকার বিরাট বাজার চিনের বড় ভরসাস্থল। তাই চিন যে এই ঘটনায় একতরফা আহ্লাদিত, এমনটা নয়। এই পরিস্থিতিতে দিল্লি যদি একটি সঠিক অভিমুখ তৈরি করতে পারে, তা হলে ভারত জগৎসভায় আবার শ্রেষ্ঠ আসন লাভের চেষ্টা করতে পারে।
তবে সেই পথে মূল বাধা রাজনীতি। আমেরিকা যেখানে লড়ছে অর্থনৈতিক দিক থেকে, ভারতকে সেখানে পরীক্ষা দিতে হয় রাজনৈতিক ক্ষেত্রে।
আমেরিকার কথা প্রথম ধরা যাক। সে দেশে সত্তর দশকের পর থেকে ধনী ও গরিবের ব্যবধান বাড়ছে, এ কথা জানিয়ে দিল্লি স্কুল অফ ইকনমিক্সের অধ্যাপক পরীক্ষিত ঘোষ বলেন, “আমেরিকা স্বল্পমেয়াদি লক্ষ্য ও দীর্ঘমেয়াদি লক্ষ্যের ভারসাম্য রক্ষা করতে গিয়ে সমস্যায় পড়ছে। দীর্ঘমেয়াদি লক্ষ্য হল খরচ কমাও, সঞ্চয় বাড়াও, কর চাপাও, ভর্তুকি কমাও, যাতে আর্থিক শ্রীবৃদ্ধি হয়। আর আর্থিক মন্দায় স্বল্পমেয়াদি লক্ষ্য হল তিরিশের দশকের অর্থনীতিবিদ কেইনসের মন্ত্র উচ্চারণ করে খরচ বাড়াও, টাকা ছাপাও, উপভোক্তা বাড়াও।”
আমেরিকা এই ভারসাম্যের পরীক্ষার মুখোমুখি হলেও তাদের থেকে ভারতের রাজনৈতিক সমস্যাটা অনেক গুণ বেশি। অর্থনীতি সম্পর্কে সরকারের রাজনৈতিক অভিমুখ এখনও সংশয়াচ্ছন্ন। এক দিকে কেন্দ্র-রাজ্য বিরোধ। অন্য দিকে কেন্দ্রের মধ্যেও নানা মুনির নানা মত। প্রণববাবু সংসদে ব্যাঙ্কিং, পেনশন, বিমা একটা বিলও পাশ করাতে পারছেন না। অথচ দলের কমর্সূচি অনুসারে কোটি কোটি টাকা ঢালতে হচ্ছে সামাজিক প্রকল্পে। তাতে যেমন গরিব মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বাড়ছে, তেমনই তৈরি হচ্ছে খাদ্য সঙ্কট। ঘটছে মূল্যবৃদ্ধিও। এ দিকে বিশ্ববাজারের সঙ্কটে দেশে-বিদেশি লগ্নি কমছে। ভারতীয় শিল্পপতিরা বিদেশে লগ্নি করতে ছুটছেন। কিন্তু রফতানির সুষ্ঠু নীতি নিয়ে এগোতেও ভারত ব্যর্থ হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রীর আর্থিক উপদেষ্টারা অর্থ মন্ত্রককে গাল দিচ্ছেন। অর্থ মন্ত্রক খাদ্য মন্ত্রককে। খাদ্য মন্ত্রক বাণিজ্য মন্ত্রককে। আর এই চূড়ান্ত বিশৃঙ্খলার মধ্যে রাজ্যের প্রতি বঞ্চনার আওয়াজ তুলছে পশ্চিমবঙ্গ সরকার। জনমুখী কর্মসূচির ঘোষণা চলছে একের পর এক।
এই পরিস্থিতিতে যেন ‘শাপে বর’ হয়ে দাঁড়িয়েছে কালো টাকা। সেন্ট স্টিফেন্স কলেজের অর্থনীতির অধ্যাপক কল্যাণ রায়চৌধুরী বলেন, “আসল সত্য হল ভারতে কালো টাকার সমান্তরাল অর্থনীতি এই আর্থিক মন্দার বাজারে শাপে বর হয়ে দেখা দিয়েছে। পশ্চিমের তুলনায় আমাদের দেশে কালো টাকার অর্থনীতি অনেক বেশি কায়েম বলে চাহিদা এবং জোগানের যে সমস্যায় আজ মার্কিন মুলুক পীড়িত, আমাদের তা নয়। নৈতিক দিক থেকে কালো টাকা দমন বিশেষ প্রয়োজন। কিন্তু বাস্তব হল, কালো তা সে যতই কালো হোক, আর্থিক মন্দায় বাজার তেজি রাখতে, উপভোক্তাবাদকে অক্সিজেন জোগাতে কালোটা টাকার সমান্তরাল অর্থনীতির কোনও জবাব নেই।”
সরকারি ভাবে অবশ্য কোনও দিনই মনমোহন সিংহ থেকে প্রণব মুখোপাধ্যায় কেউই এ কথা প্রকাশ্যে বলতে পারবেন না। আবার এ ভাবে সঙ্কট সামাল দেওয়া যে কাজের কথা নয়, তা-ও জানেন তাঁরা। তা হলে? নর্থ ব্লকের এক প্রবীণ আমলা বললেন, “অর্থনীতিবিদ পল স্যামুয়েলসন বলেছিলেন, ট্রাফিক সিগন্যাল কাজ না করলে চৌরাস্তায় সব গাড়ি একসঙ্গে যেতে চায়। আর তার পরিণতি চূড়ান্ত বিশৃঙ্খলা। তাই অ্যাডাম স্মিথ অবাধ অর্থনীতির কথা যা-ই বলুন না কেন, নিয়ন্ত্রণ কোনও না কোনও স্তরে প্রয়োজন।” হাডসন থেকে গঙ্গা হয়ে হুগলি নদী, এই চূড়ান্ত বিশৃঙ্খলার মধ্যেও চাই এক শৃঙ্খলার সূত্র।
প্রশ্ন হচ্ছে, সেই শৃঙ্খলার সূত্র কি খুঁজে বের করতে পারবে ওয়াশিংটন, বা দিল্লি?
Next Story



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.