পুরনো বাড়ি নতুন ফ্ল্যাট
চৌকাঠ টপকালেই পায়ের নীচে মাটির স্পর্শ। ভোরবেলা জানলা খুললেই সূর্যের আলো এসে ঝাঁপিয়ে পড়ত বিছানার ওপর। তিন কাঠার জমিতে কত বিচিত্র রকমের না গাছগাছড়া। আম-নারকেল-পিয়ারার সঙ্গে গা ঘেঁষাঘেঁষি করে ছিল টগর-গন্ধরাজ আর জবা গাছেরা। আর ছিল গাছের ডালে ডালে পাখিদের আনাগোনা, তাদের কিচিরমিচির। রোজ সকালবেলা কলতলায় পাখিদের জন্য মুঠো মুঠো মুড়ি ছড়িয়ে দিত পুপুন। ভুলে গেলেও রেহাই মিলত না। মুড়ির আশায় জড়ো হওয়া পক্ষধরেরা রীতিমত হইচই বাঁধিয়ে দিত। দুর্বোধ্য ভাষায় তারা যেন বলতে চাইত কী হল ভাই, আমাদের বরাদ্দটা কই? কিন্তু পুপুনের বাবা প্রমোটারের কাছে বাড়িটা বেচে দেওয়ায় গোটা ছবিটাই হারিয়ে গেল! পুপুনদের সাম্প্রতিক ঠিকানা আকাশদীপ অ্যাপার্টমেন্ট। ছ’তলা অ্যাপার্টমেন্টের পাঁচ তলায় ওদের ফ্ল্যাট। এখানে জানলা দিয়ে হাত বাড়ালেও কোনও গাছের পাতার নাগাল পাওয়া যায় না। পাখি না থাকায় পাখিদের কিচিরমিচিরও নেই এখানে। নেই ফেরিওয়ালাদের কোনও হাঁকডাকও। আগে ইচ্ছে হলেই একছুটে রাস্তায় চলে যেতে পারত পুপুন। বাড়ির সামনের ছোট্ট উঠোনটায় বন্ধুদের সঙ্গে ক্রিকেট-ব্যাডমিন্টন নিয়ে হুল্লোড়ে মেতে উঠতে পারত। কিন্তু এখানে সে সবের কোনও বালাই নেই। এখানে সে ফ্ল্যাটবন্দি!
দিন কয়েক আগে কী এক খেয়াল হওয়ায় লিফ্ট চেপে একা একাই নীচে নামতে গিয়েছিল পুপুন। কিন্তু হঠাৎ কারেন্ট অফ হয়ে যাওয়ায় লিফ্ট-এর মধ্যে আটকে পড়ল। বন্ধ লিফ্ট-এর মধ্যে নিজেকে ভীষণ অসহায় লাগছিল পুপুনের। মনে হচ্ছিল ধাতব দেওয়ালগুলি ক্রমশ যেন তার দিকে এগিয়ে আসছে। আগুয়ান দেওয়ালগুলির চাপে অচিরেই সে মারা পড়বে! শেষমেশ আতঙ্কের আতিশয্যে কান্নায় ভেঙে পড়েছিল পুপুন। ওর কান্নার শব্দে হুলস্থুল পড়ে গিয়েছিল অ্যাপার্টমেন্টে। খবর পেয়ে ওর মা-ও উড়েফুড়ে চলে এলেন অকুস্থলে। গলা চড়িয়ে বললেন, ক্লাস সিক্সে পড়িস, এখন আর তুই ছোট নোস পুপুন। কান্নাকাটি বন্ধ কর। কারেন্ট এলেই লিফ্ট চালু হবে। চিন্তা কীসের!
সে-দিন প্রায় মিনিট কুড়ি লিফ্ট-এর মধ্যে আটকে ছিল পুপুন। কারেন্ট আসার পর যখন সে বাইরে এল, তখন ভয়ে টেনশনে তার সমস্ত শরীর কাঁপছে। ঘামে ভিজে জবজব করছে জামা। সে-দিন সন্ধ্যাবেলাতেই ঝাঁপিয়ে জ্বর এল তার। তিন-চার দিন পর জ্বর কমলে বাবা বললেন, পুপুন, তুই কী চাস বল। ক্যারম বোর্ড না দাবা?
পুপুনের উদাস গলা, আমি কিছুই চাই না!
বাবা তবু নাছোড়, যদি বলিস টিনটিনের দু’খানা বইও এনে দিতে পারি।
না, দরকার নেই! ক্লান্ত চোখে বাবার দিকে তাকাল পুপুন, বাবা, আমাদের পুরনো বাড়িটায় আবার ফিরে গেলে হয় না?
বাবা হতচকিত। কিছুক্ষণ নীরব থাকার পর ভাঙা ভাঙা গলায় বলে উঠলেন, না রে পুপুন, তা আর সম্ভব নয়!
ছবি: ওঙ্কারনাথ ভট্টাচার্য
বাবার কথায় পুপুনের শুকনো মুখটা আরও যেন শুকনো হয়ে গেল।
পর দিন ছুটির দিন। সকালবেলা মায়ের সঙ্গে খানিক গুজগুজ ফুসফুস করে কোথায় যেন বেরিয়ে গেলেন বাবা। ফিরলেন যখন, তখন সঙ্গে গাদাগুচ্ছের টবের গাছ। একটু পরেই ভ্যানওয়ালার সাহায্যে ছোট্ট বারান্দাটাকে টবের গাছে গাছে সাজিয়ে তুললেন। চোখের সামনে ঝাউ, টগর, গোলাপ, জবা আর পাতাবাহারদের বিচিত্র সমারোহ দেখে পুপুনের চোখে খুশি ঝিলিক দিয়ে উঠল। সে ছোটাছুটি ফেলে দিল। ছেলের ঝলমলে মুখের দিকে তাকিয়ে পুপুনের বাবার আনন্দ আর ধরে না। হেসে বললেন, বিকেলবেলা তোর জন্য আরও বড় একটা সারপ্রাইজ আছে!
দুপুরবেলা খাওয়াদাওয়ার পর ‘আনন্দমেলা’ পড়তে পড়তে কখন যেন ঘুমিয়ে পড়েছিল পুপুন। ঘুম ভাঙল পাখির ডাকে। বাবা-মায়ের ঘর থেকে নানা রকম পাখির ডাক ভেসে আসছে! কখনও বউ কথা কও, কখনও কোকিল, কখনও বা ঘুঘুএকের পর এক ডেকেই চলেছে। এত পাখি একসঙ্গে সব এল কোথা থেকে! তাও আবার ঘরের মধ্যে! কৌতূহল মেটাতে বিছানা থেকে লাফ দিয়ে নেমে পাশের ঘরের দরজা ঠেলল পুপুন। দেখল সোফায় বসে এক জন মানুষ মুখ দিয়ে নানা রকম পাখির আওয়াজ করে চলেছে। বাবা-মা খাটে একমনে তা শুনছে। পুপুনকে দেখতে পেয়ে চোখ নাচিয়ে হাসলেন বাবা। বললেন, দেখছিস কী, প্রণাম কর। ইনি আমার বন্ধু দয়াল। লোকে বলে দয়াল হরবোলা। তোকে পাখির ডাক শোনাবে বলে চলে এল।
প্রণাম পর্ব মিটলে পুপুনকে কাছে টেনে নিলেন দয়াল হরবোলা। হেসে বললেন, এ বার তোমায় পায়রার ডাক শোনাই। পায়রার ডাকের পর আরও অনেক পাখির ডাক শোনালেন ভদ্রলোক। শেষে শোনালেন রেলগাড়ির শব্দ। যাওয়ার সময় পুপুনের পিঠ চাপড়ে দিয়ে ভদ্রলোক বললেন, আবার আসব আমি। এ বার এলে কয়েকটা পাখির ডাক তোমায় শিখিয়ে দেব।
দয়াল হরবোলার কথায় খুশিতে আটখানা পুপুন। ভদ্রলোককে এগিয়ে দিতে মা-বাবা লিফ্ট-এ চেপে নীচে নেমে গেলে অনেক দিন পর আনন্দে গুনগুনিয়ে উঠল সে আহা কী আনন্দ আকাশে বাতাসে...।
প্রিয় গানটার দু’লাইন গাইতে না গাইতেই হঠাৎ কানে এল পাখির কিচিরমিচির। পুপুন থমকে গেল। ব্যাপারটা কী হল? শব্দটা বারান্দার দিক থেকে আসছে না? তবে কি দয়াল হরবোলা ফিরে এল? বিস্মিত পুপুন মা-বাবার ঘরের মধ্যে দিয়ে পা টিপেটিপে গিয়ে বারান্দায় উঁকি মারল। দয়াল হরবোলা নয়, বারান্দায় টবের গাছগুলোতে হুড়োহুড়ি ফেলে দিয়েছে চার-পাঁচখানা চড়ুইপাখি! কিচিরমিচিরগুলো ওরাই করছে। পুপুন রান্নাঘরের দিকে দৌড় লাগাল। পাখিগুলো উড়ে যাওয়ার আগেই ওদের সামনে এক মুঠো মুড়ি ছড়িয়ে দিতে হবে। রান্নাঘরে ঢুকে কাঁপা কাঁপা হাতে মুড়ির পাত্রের ঢাকনা খুলতে গিয়ে এত দিনে ওর মনে হল, পুরনো বাড়িটা ভালই ছিল, তবে এ ফ্ল্যাটটাও খারাপ নয়! এখানেও বেশ মজা আছে!
Magazine Rabibasariyo Anandamela


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.