|
|
|
|
|
|
|
পুস্তক পরিচয় ১... |
|
কবির মন সাময়িকপত্রের কিস্তি নয় |
আশিস পাঠক |
কালানুক্রমিক রবীন্দ্র-রচনাবলী ১-৪, সাধারণ সম্পা: উপাচার্য, বিশ্বভারতী,
কার্যনির্বাহী সম্পা: গৌতম ভট্টাচার্য। বিশ্বভারতী, চার খণ্ডের মোট দাম ২৫০০.০০ |
কবিতাসমগ্র ১-৫, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, সম্পা: অনাথনাথ দাস।
আনন্দ পাবলিশার্স, পাঁচ খণ্ড একত্রে ২৫০০.০০ |
রবীন্দ্রনাথের ‘কালানুক্রমিক’ রচনাবলি আগেও বিশ্বভারতী থেকে প্রকাশিত হয়েছে। ১৯৩৯-এ প্রথম প্রকাশিত এবং তার পরে প্রকাশিত ‘সুলভ’ রচনাবলিও ‘কালানুক্রমিক’। কিন্তু তা একই সঙ্গে বিষয়ানুসারীও। এই নতুন রচনাবলি তা নয়, কেবল কালানুক্রমিক। এখানে ‘কাল’ পূর্বতন রচনাবলির মতো গ্রন্থপ্রকাশের কাল নয়, প্রথম প্রকাশকাল, পত্রিকায় বা গ্রন্থাকারে।
কালানুক্রমের এই নিরিখ ধার্য করে সেই ক্রমে এই রচনাবলিতে থাকবে রবীন্দ্রনাথের সব ভাষার সব রচনা, জীবনকালে বা মরণোত্তর প্রকাশিত। থাকবে পত্রাবলিও। এবং অনুক্রমেই সজ্জিত হবে পাঠান্তর। অর্থাৎ, রচনার পরেই তার পাঠান্তর থাকবে না, পরিবর্তিত পাঠটি যখন প্রকাশিত হয়েছিল সেই হিসেবে তা স্থান পাবে।
এই ‘অভিনব’ রচনাবলির প্রথম চারটি খণ্ডের ‘পরীক্ষামূলক সীমিত সংস্করণ’-এ আছে ১২৮০-১২৯০ বঙ্গাব্দের মধ্যে প্রকাশিত রবীন্দ্রনাথের সব রচনা। মোটামুটি আশি খণ্ডে শেষ হতে পারে এই বিপুল কর্মযজ্ঞ। কী এর উদ্দেশ্য? বিশ্বভারতীর প্রাক্তন উপাচার্য তথা এই রচনাবলির সাধারণ সম্পাদক রজতকান্ত রায় প্রাক্কথনে লিখছেন, ‘ইহা হইতে কী লাভ হইবে? ... ইহাতে পাঠকবর্গ রবীন্দ্রনাথের মানস, সৃষ্টিপ্রচেষ্টা, চিন্তাজগৎ, ভাবজগৎ, জীবনধারা, ব্যক্তিত্ব বিকাশ, আবেগ ধারা ইত্যাদি অনুসরণ করিতে পারিবেন।’
কিন্তু ব্যাপারটা কি এতই সহজ? এই রচনাবলির লেখকের নাম যে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। কবিতা, গান, ছড়া, নাটক, প্রহসন, উপন্যাস, ছোটগল্প, প্রবন্ধ ইত্যাদি নানা সাহিত্যসংরূপে লিখেছেন তিনি, একই লেখা বহু বার কাটাছেঁড়া করেছেন, নামে, অ-নামে, বেনামে, আদ্যনামে লিখেছেন। বহু পত্রিকায় তাঁর লেখা প্রকাশিত হয়েছে, সরাসরি গ্রন্থাকারেও, এবং নিজের প্রকাশিত অনেক লেখাকেই তিনি ভুলে যাওয়াই মঙ্গল বিবেচনা করেছেন। রবীন্দ্র-রচনাবলির এই বিপুল বিশ্বকে প্রকাশের কালানুক্রমে বেঁধে ফেলার কাজটি দু-একটি ব্যতিক্রমের সঙ্গে আপস করে নিলে হয়ত সম্ভব, কিন্তু তার ভিত্তিতে রবীন্দ্রমানসের বিকাশ অনুসরণ কী ভাবে সম্ভব তা দুর্বোধ্য। কারণ এই রচনাবলির সাহায্যে তা করতে গেলে ছ’জনায় মিলে পদে পদে পথ ভোলাবে। ধরা যাক, কেউ এই রচনাবলির সাহায্যে রবীন্দ্রনাথের কাব্যোপন্যাস বন-ফুল পড়তে শুরু করলেন। প্রথম সর্গ (রচনাবলির সূচির বানানে অবশ্য ‘স্বর্গ’) পড়ার পরে পড়তে হবে যথাক্রমে ‘জ্বল জ্বল চিতা...’, সরোজিনী নাটকের অংশ, তার পরে দ্বিতীয় সর্গ, তার পরে ‘প্রলাপ সাগর’-এর কয়েকটি উচ্ছ্বাস, তার পরে তৃতীয় সর্গ এবং ক্রমশ...। এই প্রকারে ‘মানস, চিন্তাজগৎ, ভাবজগৎ, জীবনধারা, ব্যক্তিত্ব বিকাশ, আবেগ ধারা’ ইত্যাদির অনুসরণ সম্ভব হয় না। কারণ কবির মন সাময়িকপত্রের কিস্তি নয়। তা ছাড়া, রচনার প্রথম প্রকাশের কাল অনুসারে কবির মন ও মননের বিকাশ ধরার পথটাও অযৌক্তিক। তার জন্য রচনাকাল বিচার করা দরকার। কিন্তু সাধারণ সম্পাদক লিখছেন, ‘প্রথম প্রকাশের কাল নির্ধারণ করা মোটামুটি ভাবে সম্ভব, কিন্তু সর্বক্ষেত্রে প্রথম পাণ্ডুলিপির রচনাকাল গণনা করা বর্তমানে সম্ভব নহে।’ তবে ‘ইহা হইতে কী লাভ হইবে?’ |
|
|
কবিতাসমগ্র-র প্রচ্ছদ থেকে
গণেশ পাইন অঙ্কিত রবীন্দ্র-প্রতিকৃতি |
কালানুক্রমিক রবীন্দ্র-রচনাবলীর
প্রচ্ছদ থেকে রবীন্দ্র-স্বাক্ষর |
|
এই প্রকল্পের গুরুত্ব বিবেচনা করে যদি ধরেও নিই যে প্রকাশের কালানুক্রমে বিন্যস্ত রচনা পড়তে পড়তে পদে পদে হোঁচট খেতে খেতেও পাঠকবর্গের মনে খণ্ড খণ্ড ‘ক্রমবিকশিত’ এক রবীন্দ্রনাথ জমা হতে থাকবেন তবু কয়েকটা প্রশ্ন ওঠে। এক, রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুর পরে যে সব লেখা প্রথম প্রকাশিত হয়েছে সেগুলি প্রকাশের কালানুক্রমে রচনাবলিতে জায়গা পাবে কেন? তাহলে তো পাঠকবর্গকে ‘রবীন্দ্রনাথের মানস... ইত্যাদি অনুসরণ’ করানোর চেষ্টায় জল ঢেলে দেওয়া হল। দুই, এখনও পর্যন্ত অপ্রকাশিত রচনা পাণ্ডুলিপির কাল অনুযায়ী যথাস্থানে সন্নিবিষ্ট হবে কেন? তিন, কেনই বা প্রকাশিত চিঠিপত্রগুলি গ্রন্থাকারে প্রকাশের তারিখ অনুযায়ী সংকলিত হবে? তা হলে তো আবার, রবীন্দ্রবিকাশটি ধারা-বাহিক থাকল না! চার, অপ্রকাশিত রচনা যদি রচনাবলিতে স্থান পায় তবে অপ্রকাশিত পত্র নয় কেন? রবীন্দ্রনাথের সব ভাষার সব রচনা ধারাবাহিক সংকলন করতে চেয়েই তো এই রচনাবলির জন্ম! ‘কালানুক্রম’-এর নিরিখ বাস্তব সমস্যার মুখে পড়ে বার বারই পরিবর্তিত হতে চলেছে এই রচনাবলিতে। অথচ সাধারণ সম্পাদক প্রাক্কথনে লিখছেন, ‘কালানুক্রম রক্ষা করিতে গেলে সমস্ত কালক্রম একটি মাত্র নিরিখে বিন্যাস করিতে হয়। মাঝপথে নিরিখ পরিবর্তন করিলে কালক্রম রক্ষা হয় না। যেমন, প্রথমে পাণ্ডুলিপি-কালকে নিরিখ রূপে গ্রহণ করিলে মাঝপথে প্রথম প্রকাশ কাল ধার্য করা চলিবে না।’ সুতরাং ফের প্রশ্ন ওঠে, ‘ইহা হইতে কী লাভ হইবে?’
তবে একটি লাভ হতে পারে। যে সব গবেষক রবীন্দ্রনাথের রচনার প্রতিটি শব্দের প্রতিটি পাঠ খুঁজে পেতে চাইবেন তাঁদের সঙ্গী হবে এই ‘কালানুক্রমিক রচনাবলি’। কিন্তু সে সঙ্গ কতটা সৎসঙ্গ হবে তা নির্ভর করবে মুদ্রণের যাথার্থ্যের উপরে। যে-রচনাবলির প্রথম খণ্ডের আখ্যাপত্রে ‘বন্দোপাধ্যায়’, সূচিপত্রে ‘ভূবন’, তার উপরে সেই নির্ভর কতটা করা যাবে তা নিঃসংশয়ে বলা যাচ্ছে না। বিশ্বভারতীর পুরনো রচনাবলিতে কিন্তু এত মুদ্রণ-প্রমাদ ছিল না। তার উপর ২৬ পৃষ্ঠার একই পূর্ব-পাঠ (প্রাক্-কথন, মুখবন্ধ, নিবেদন, প্রকাশকের নিবেদন) চারটি খণ্ডেই থাকবে কেন? আশিটি খণ্ডেই থাকবে নিশ্চয় এ লেখা। অর্থাৎ ২০৫৪ পৃষ্ঠা ছাপিয়ে জলে ফেলে দেওয়া হল।
তবু এই রচনাবলি অভিনব, কারণ সত্যই এ ভাবে অন্তত ভারতে আর কোনও লেখকের রচনাবলি প্রকাশিত হয়নি। অভিনব এ কারণেও যে, শুধু মুষ্টিমেয় গবেষকের জন্য সরকারি অর্থে এমন বৃহৎ প্রকল্প এর আগে হয়েছে কি না সন্দেহ। সম্পাদকমণ্ডলী একে ‘সাধারণ পাঠকের জন্য’, ‘প্রয়োগকুশল’, ‘ব্যবহার-বৎসল (user-friendly)’ ইত্যাদি আখ্যা দিয়েছেন। অথচ এমন জটিল সংকলনের প্রতি খণ্ডে একটি শিরোনামসূচিও দেওয়ার কথা ভাবেননি।
কবিতাসমগ্র কেবল গবেষকের জন্য নয়, সাধারণ পাঠকের জন্যও। বিশ্বভারতীর পুরনো রচনাবলি থেকে এর পরিকল্পনা বিশেষ আলাদা নয়। সে রচনাবলিও ছিল বিষয়ানুক্রমে বিন্যস্ত, গ্রন্থপ্রকাশের কালানুক্রমে সজ্জিত। সমগ্র রবীন্দ্ররচনা প্রকাশের যে উদ্যোগের প্রথম ফসল এই কবিতাসমগ্র তার পরিকল্পনাও একই রকম। শুধু এখানে প্রতি খণ্ডে সাহিত্যের সব সংরূপের কিছু কিছু রচনা নয়, আলাদা আলাদা সমগ্রে আলাদা আলাদা সংরূপের সমস্ত। সে ভাবেই এই কবিতাসমগ্রের প্রথম চার খণ্ডে বন-ফুল থেকে শেষ লেখা রবীন্দ্রনাথের ৫৭টি কাব্যগ্রন্থ সংকলিত। পঞ্চম খণ্ডে রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুর পরে সংগ্রথিত কিছু কাব্য এবং তাঁর প্রায় সব প্রকীর্ণ কবিতা। গান এই সমগ্রে নেই, তবে রবীন্দ্রনাথের প্রথম গীতিগ্রন্থ রবিচ্ছায়া আছে, ‘তাঁর প্রথম প্রয়াসের একটি দৃষ্টান্ত হিসেবে।’ প্রতিটি গ্রন্থের সবিস্তার পরিচয় আছে, তার গঠন বিশ্বভারতীর পুরনো রচনাবলির মতোই, তথ্য অনেক বেশি।
পাঁচ খণ্ডের অসাধারণ নির্মাণে এই সমগ্র পাঠকের সামনে হাজির করেছে রবীন্দ্রনাথের প্রায় সমস্ত কবিতাকে। অসাধারণ এই কারণে যে, গণেশ পাইনের আঁকা ছবি, সুন্দর গ্রন্থাধার এবং পাঁচ খণ্ডের পুট জুড়ে স্বর্ণাক্ষরে রবীন্দ্রস্বাক্ষর সাম্প্রতিক কালের কোনও রবীন্দ্ররচনাবলিতে এত সযত্ন নির্মাণ দেখেছি বলে তো মনে পড়ে না। বিশ্বভারতী-র প্রচলিত রচনাবলিতে নেই এমন অনেক প্রকীর্ণ কবিতাই স্থান পেয়েছে এখানে। সবচেয়ে বড় কথা, রবীন্দ্রনাথের বিভিন্ন কাব্যগ্রন্থের প্রথম সংস্করণে যে ছবিগুলি ছিল তার প্রায় সব এই সমগ্রে আছে। পাঠকের কাছে এ এক অসাধারণ প্রাপ্তি। অলংকরণ রচনাবলিতে গ্রহণ করা সঙ্গত কি না তা নিয়ে প্রশ্ন থাকতে পারে, কিন্তু রবীন্দ্রনাথ যেহেতু তাঁর সব বই প্রকাশের প্রতিটি স্তর নিজে খেয়াল রাখতেন তাই ধরে নেওয়া যায় অলংকরণগুলি তাঁর অভিপ্রেত। সে ক্ষেত্রে তাঁর গ্রন্থ রচনাবলিতে প্রকাশকালেও অলংকরণগুলি বাদ দেওয়া উচিত নয়। তা ছাড়া বিচিত্রিতা বা ছড়ার ছবি-র মতো বইয়ের ক্ষেত্রে ছবিগুলি বাদ দিলে বইটিই খণ্ডিত হয়ে যায়, সম্ভবত কবিতাগুলিও। কারণ ছবিগুলি সেখানে কবিতার অলংকরণ নয়, প্রেরণা। বিশ্বভারতী রচনাবলিতে ছবিগুলি অনিবার্য কারণে বাদ দেওয়া হয়েছিল। এই কবিতাসমগ্র চিরাচরিত সেই ‘অনিবার্য’ কারণটিকে নিবারণ করতে পেরেছে, এটি বিশেষ ভাবে প্রশংসার যোগ্য।
তবে বন-ফুল-কে ‘কবিতা’ বলা কতটা সঙ্গত? বইটি ‘কাব্যোপন্যাস’ আখ্যায় প্রথম প্রকাশিত হয়। তাকে বোধহয় উপন্যাসের অন্তর্ভুক্ত করা উচিত। কারণ গদ্য ছাড়া উপন্যাস লেখা যায় না এমন ধারণা ভুল। আর কবিতায় উপন্যাস লেখার রবীন্দ্রনাথের সেই ‘বাল্যকীর্তি’ সাহিত্যে এক নিরীক্ষা বলেও বিচার করা যায়। সমগ্রের সম্পাদক বলতে পারেন, রবীন্দ্রনাথই ‘জীবনস্মৃতি’র পাণ্ডুলিপিতে একে ‘কবিতা’ বলেছেন। তা বলুন, রবীন্দ্রনাথের সব কথা মেনে কবেই বা আর তাঁর রচনাবলি তৈরি হয়েছে!
তা যদি হত তবে তাঁকে আর এত অজস্র রচনাবলির অসংখ্য খণ্ডের জঙ্গলে ‘কর্ম্মফল’ ভোগ করতে হত না, কুঠারের আঘাতে জঙ্গল সাফ হয়ে অরণ্যটি স্পষ্ট হয়ে উঠত। তবু এই উদ্যোগগুলি এই সার্ধশতবর্ষে আক্ষরিক অর্থেই ‘সমগ্র’ রবীন্দ্রনাথকে ধরে রাখছে, এও বড় প্রাপ্তি নিঃসন্দেহে। |
|
|
|
|
|