|
|
|
|
|
|
অব্যবস্থা চরমে |
চিকিৎসার নামে |
শান্তনু ঘোষ |
নামেই স্টেট জেনারেল হাসপাতাল। কিন্তু পরিকাঠামো ও পরিষেবার দিক থেকে কার্যত প্রাথমিক চিকিৎসাকেন্দ্রই বলা যায় বেলুড় স্টেট
জেনারেল হাসপাতালকে।
দামি যন্ত্রপাতি থাকলেও দিনের পর দিন অব্যবহারের ফলে সেগুলি নষ্ট হচ্ছে। শুধু তাই নয়, স্থানীয় বাসিন্দাদের কথায়, পুরো হাসপাতাল জুড়েই রয়েছে অজস্র সমস্যা। জ্বর, সর্দি-কাশি ও কাটাছেঁড়ার সেলাই ছাড়া অন্যান্য চিকিৎসা অমিল। কথায় কথায় ‘রেফার’ করা হয় হাওড়া জেলা কিংবা জয়সোয়াল হাসপাতালে। হাসপাতাল চত্বরে গবাদি পশুর অবাধ বিচরণ। যদিও হাসপাতালের উন্নয়নের জন্য দীর্ঘ দিন ধরেই উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে আবেদন জানাচ্ছেন বেলুড় হাসপাতালের সুপার।
বেলুড় স্টেশনের পাশেই রয়েছে এই হাসপাতাল। স্থানীয় সূত্রে জানা গিয়েছে, ১৯৪৩ সালে প্রথম ব্যক্তিগত মালিকানাধীন ওই জমিতে সেনা জওয়ানদের জন্য ক্যাম্প হাসপাতাল তৈরি হয়েছিল। ১৯৮৬ সালে হয় স্টেট জেনারেল হাসপাতাল। |
|
কিন্তু চিকিৎসা ব্যবস্থার আরও উন্নতির জন্য ১৯৯৩ সালে রাজ্য সরকার ওই জমি অধিগ্রহণ করে পুরনো হাসপাতাল ভবনের সংস্কার শুরু করে। এলাকার প্রবীণ নাগরিকদের অভিযোগ, সেই সময় রাজ্য সরকার ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (হু) কয়েক কোটি টাকা অনুদান দেয়। কিন্তু সামান্য কিছু কাজ হলেও পুরো কাজ হয়নি। স্টাফ কোয়ার্টার্স থেকে শুরু করে সীমানা পাঁচিল সব কাজই বাকি থেকে যায়।
স্টেট জেনারেল হাসপাতাল হলেও এখানে ১৫টির বেশি শয্যা নেই, যেখানে পঞ্চাশের বেশি শয্যা থাকা প্রয়োজন। হাসপাতালের সুপার অরুণ ভট্টাচার্য বলেন, “আমার জানা নেই, কোনও স্টেট জেনারেল হাসপাতালে মাত্র ১৫টি শয্যা থাকে কি না। শয্যা কম বলেই সরকারি অনুদানও কম আসে। বেড না বাড়ালে পরিকাঠামোর উন্নতি করার ইচ্ছা থাকলেও উপায় নেই।” স্থানীয় বাসিন্দাদের কথায়, এই হাসপাতালে শুধু মাত্র জ্বর-সর্দি ছাড়া আর অন্য কোনও চিকিৎসা পাওয়া যায় না। একটু বেশি পায়খানা-বমি হলেই রোগীকে স্থানান্তরিত করা হয় অন্য হাসপাতালে। এই কারণেই সাধারণ মানুষ খুব প্রয়োজন হলেও এই হাসপাতালে আসতে চান না। বাসিন্দাদের দাবি, হাসপাতালটির পরিকাঠামো ও পরিষেবার উন্নতি হলে বালি, বেলুড়, লিলুয়া ও বালি-জগাছা পঞ্চায়েত এলাকার অসংখ্য মানুষ উপকৃত হতেন। হাসপাতালের চার দিকে গজিয়েছে আগাছার জঙ্গল। সম্প্রতি সেই জঙ্গল সাফ করতে দলের কর্মীদের নিয়ে নিজেই উদ্যোগী হন স্থানীয় বিধায়ক সুলতান সিংহ। তিনি বলেন, “এত বড় জায়গা পড়ে রয়েছে। এখানে বড় মাপের একটা হাসপাতাল তৈরি করা যায়। কেন এখনও এই অবস্থা তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গেও বিষয়টা নিয়ে আলোচনা করব।” |
|
রোগী থেকে কর্মীদের একাংশ হাসপাতালের এই অব্যবস্থার জন্য উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের উদাসীনতাকেই দায়ী করেছেন। মাত্র ১৫ শয্যার এই হাসপাতালে শুধু সাধারণ ও দাঁতের চিকিৎসার বহির্বিভাগ রয়েছে। সকালে বহির্বিভাগে রোগীদের ভিড় থাকলেও ভিতরে মহিলা ও পুরুষদের ওয়ার্ড প্রায় ফাঁকা। ভর্তি থাকা রোগীদের অভিযোগ, এখানে ন্যূনতম খাবার সকালের চা-ও দেওয়া হয় না। সেখানে দুপুরের বা রাতের খাবার দূর অস্ৎ। শুধু স্যালাইন ও কয়েকটি সাধারণ ওষুধ ছাড়া অধিকাংশ ওষুধই কিনে আনতে হয় বাইরে থেকে। হাসপাতালের এক কর্মী বলেন, “কোনও ঠিকাদারই মাত্র ১৫ জনের জন্য খাবার দিতে রাজি নয়। আমরাও চাই হাসপাতালটির উন্নয়ন।”
বেলুড়ের এই হাসপাতালে সুপার-সহ মাত্র পাঁচ জন মেডিক্যাল অফিসার রয়েছেন। তবে তাঁরা সবাই জেনারেল ফিজিশিয়ান, এক জন দাঁতের চিকিৎসক। এখানে কোনও বিভাগেই বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক নেই। এক মাস আগে চক্ষু বিভাগে এক জন চিকিৎসক থাকলেও তাঁকে অন্য হাসপাতালে পাঠানোর ফলে বন্ধ চোখের চিকিৎসাও। এই হাসপাতালে প্রসূতিদের চিকিৎসা হলেও কোনও স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ নেই। চার বছর আগে স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ ডাক্তারকে হাওড়া হাসপাতালে বদলি করা হয়েছে। ফলে এখানে অস্ত্রোপচার করা যায় না। জেনারেল মেডিসিনের চিকিৎসকেরা নিজেদের ঝুঁকি নিয়ে সাধারণ প্রসব করান। নবজাতকদের জন্য বিশেষ কেয়ার সেন্টার তৈরি হলেও শিশু চিকিৎসকের অভাবে তাও বন্ধ। |
|
হাসপাতালে দু’টি শীতাতপনিয়ন্ত্রিত অপারেশন থিয়েটার থাকলেও স্রেফ সার্জেনের অভাবে সেগুলি দীর্ঘ দিন তালা বন্ধ। অভিযোগ, আল্ট্রাসোনোগ্রাফির ব্যবস্থা থাকলেও রেডিওলজিস্টের অভাবে সেটিও দীর্ঘ দিন ধরে বন্ধ। তবে এক্স-রে ও প্যাথোলজি, ফিজিওথেরাপি পরিষেবা চালু রয়েছে। এক জন ফার্মাসিস্টকে ওষুধ দেওয়ার পাশাপাশি স্টোরকিপারের দায়িত্বও সামলাতে হয়। এলাকার ভূদেব সরকার বলেন, “এক সময় এই হাসপাতালের উন্নতির জন্য অনেক লড়াই করেছি। প্রথমে কিছু কাজও হয়েছিল। অনেক ভাল চিকিৎসক আসতেন। কিন্তু এখন ন্যূনতম চিকিৎসাও পাওয়া যায় না।”
হাসপাতাল সূত্রে জানা গিয়েছে, এখানে কোনও স্টাফ কোয়ার্টার্স নেই। ফলে রাতে কর্মী ও চিকিৎসকদের থাকার কোনও উপায়ও নেই। চার জন সাফাইকর্মী থাকার কথা থাকলেও রয়েছেন তিন জন। এর মধ্যে এক জনকে রাখা হয়েছে চুক্তিভিত্তিক। এক সময় হাসপাতালের নিজস্ব অ্যাম্বুল্যান্স থাকলেও এখন শুধু গ্যারাজটাই পড়ে রয়েছে। নিরাপত্তারও কোনও বালাই নেই। সীমানা পাঁচিল না থাকায় হাসপাতাল চত্বর সবার কাছেই কার্যত অবারিত দ্বার। হাসপাতাল চত্বরেই তৈরি হয়েছে রিকশাস্ট্যান্ড। রাত হলেই বসে নেশার আসর।
সুপার অরুণবাবু বলেন, “স্টেট জেনারেল হাসপাতালের পরিকাঠামোর উন্নতির জন্য দীর্ঘ দিন ধরেই রাজ্য ও জেলা স্বাস্থ্য দফতরকে আবেদন জানিয়েছি। কিন্তু এখনও কিছু হয়নি কেন, তা উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষই বলতে পারবেন।” সমস্যার কথা স্বীকার করে জেলার মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিক স্বাতী দত্তর কথায়: “শুরু থেকে এ ভাবেই চলছে বেলুড় স্টেট জেনারেল হাসপাতাল। পরিকাঠামোর উন্নতির জন্য নতুন কোনও পরিকল্পনা এখনও হয়নি। তবে বিষয়টি উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়েছে।” এই হাসপাতালের বেহাল অবস্থা সম্পর্কে রাজ্যের স্বাস্থ্য অধিকর্তা শুভময় দত্ত চৌধুরী বলেন, “সব হাসপাতালের দিকেই এখন নজর দেওয়া হচ্ছে। ওই এলাকার মানুষের চাহিদার উপর নির্ভর করেই বেলুড় হাসপাতালের পরিকাঠামোর উন্নতির ব্যবস্থা করা হবে।” |
ছবি: রণজিৎ নন্দী |
|
|
|
|
|