|
|
|
|
সম্পাদকীয় ১... |
নূতন সূচনা? |
সরকার ও বিরোধী পক্ষের মধ্যে আলাপ-আলোচনা ও মত-বিনিময়ের গণতান্ত্রিক ঐতিহ্যটি কি পশ্চিমবঙ্গে ফিরিয়া আসিতেছে? এখনই তেমন আশাবাদে উজ্জীবিত হওয়া বোধহয় একটু হঠকারী চিন্তা হইবে। তবে লক্ষণ দেখিয়া এটুকু বলা চলে যে, অন্তত দুই পক্ষেই সেই অভিমুখে অগ্রসর হওয়ার তাগিদ লক্ষ করা যাইতেছে। যে-মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তৃণমূল কংগ্রেসের নেত্রী হিসাবে সি পি আই এমের সহিত কোনও সংস্রবই রাখিতেন না, এমনকী সরকারি আমন্ত্রণ গ্রহণ করিয়া শাসক দলের নেতা-মন্ত্রীদের সহিত তৃণমূল নেতাদের একই মঞ্চে হাজিরার উপরেও নিষেধাজ্ঞা জারি করিয়াছিলেন, তিনিই কিন্তু মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পর বিরোধীদের সহিত আলোচনার দরজা অর্গলমুক্ত রাখিয়াছেন। প্রশাসনকে দলতন্ত্রের ঊর্ধ্বে লইয়া যাওয়ার তাগিদ হয়তো এই পরিবর্তনের অনুঘটকের কাজ করিয়াছে। তবে বিরোধী বামপন্থীদেরও যে তাঁহার এই পরিবর্তিত মনোভাব কম- বেশি প্রভাবিত করিয়াছে, তাহাতে সংশয় নাই। সর্বদলীয় বৈঠকের মেজাজ এবং বৈঠকের পর মুখ্যমন্ত্রী ও বিরোধী নেতার যৌথ সাংবাদিক বৈঠক তাহারই ইঙ্গিত।
বাঙালি ঝগড়াপটু। রাজনীতির অঙ্গনে এই ঝগড়া-বিবাদ যে মুখ-দেখাদেখি বন্ধ হওয়ার বালখিল্যতায় পর্যবসিত হইতে পারে, প্রতিবেশী রাষ্ট্র বাংলাদেশে আওয়ামি লিগ বনাম বি এন পি-র কাজিয়ায় তাহা দেখা গিয়াছে। এক দল সরকার গড়িলে সেখানে অন্য দল সরকারের পুরা মেয়াদ সংসদ বয়কট করিয়া অচলাবস্থা সৃষ্টির আন্দোলনে প্রমত্ত থাকে। পশ্চিমবঙ্গে তৃণমূল কংগ্রেসের সহিত সি পি আই এমের মুখ-দেখাদেখি বন্ধের ঘটনাতেও দুই পক্ষেরই সমান দায় ও প্ররোচনা থাকিয়াছে। নিরবচ্ছিন্ন ক্ষমতায় থাকা সি পি আই এমের তরফে একটু বেশিই থাকিয়াছে। বিরোধী পক্ষের অসহযোগিতার ফলে প্রশাসনের উপর নজরদারিও হ্রাস পায়, দলতন্ত্র কায়েম হয়, শাসকের ঔদ্ধত্য সীমাহীন হইয়া ওঠে। সি পি আই এমকে অবশ্য এ জন্য প্রভূত মূল্যও দিতে হইয়াছে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় দলের প্রতি পক্ষপাত হইতে মুক্ত থাকিয়া প্রশাসনকে কাজ করার নির্দেশ দিতেছেন। বিরোধী নেতা সূর্যকান্ত মিশ্র তৃণমূল কংগ্রেসের আক্রমণে নিহত দলীয় কর্মীদের তালিকা পেশ করিলে পত্রপাঠ রাজ্য পুলিশের ডিজিকে ডাকিয়া বিস্তারিত ও দ্রুত তদন্তের নির্দেশ দিয়াছেন। বিরোধী পক্ষ মুখ্যমন্ত্রীর এই সাড়া দেওয়ার ভঙ্গিতে সন্তুষ্ট। তাঁহারা সরকার পক্ষে থাকাকালে যে বিরোধীদের অভিযোগ বা আর্তি উদ্ধত ভাবে উপেক্ষা করিয়াছেন, তৃণমূল নেত্রী ক্ষমতায় আসিয়াও তাহার প্রতিশোধ গ্রহণের কোনও চেষ্টা করিতেছেন না। তাঁহার এই নিরপেক্ষতাই বিরোধীদের সহযোগিতায় আকৃষ্ট করিতেছে।
সত্য, নিচু তলায় এখনও শাসক ও বিরোধী দলের সমর্থকদের মধ্যে মারামারি, হিংসার অবসান হয় নাই। কিন্তু উপরতলায় দুই পক্ষের নেতৃত্বের মধ্যে আলোচনার অলিন্দটি খোলা, একটা পারস্পরিকতা ও বিনিময়ের মনোভাব জাগিয়াছে। সর্বদল বৈঠকের পরও বিরোধী নেতাকে তাঁহার ঘরে ডাকিয়া একান্তে মুখ্যমন্ত্রীর দীর্ঘ বৈঠক, মহাকরণের ভি আই পি লিফ্ট পর্যন্ত বিরোধী নেতাকে আগাইয়া দেওয়া এ ধরনের সৌজন্য গত চৌত্রিশ বছরে এ রাজ্য দেখে নাই। অথচ এই সৌজন্য ও শিষ্টাচারের জন্য কোনও কিছু ব্যয় করিতে হয় না, কেবল বিরোধী নেতার ‘নাম মুখে আনিতেও ঘৃণা বোধ করা’র ঔদ্ধত্যটুকু বিসর্জন দিতে হয়। ইহাতে কি বিরোধীরা আর বিরোধী থাকিবেন না? সরকারের সব সিদ্ধান্তে সায় দিবেন? তাহার প্রশ্ন নাই, প্রয়োজনও নাই। গণতন্ত্রে গঠনমূলক বিরোধী রাজনীতির যে আবশ্যকতা, তাহা পূরণ হইতে পারে শাসক ও বিরোধী, উভয় পক্ষের সহযোগিতায়। নিছক বিরোধিতার জন্য বিরোধিতার নিষ্ফল রাজনীতি এত কাল রাজ্যের গঠন ও উন্নয়নে, নির্মাণ ও উজ্জীবনে অন্তর্ঘাত হানিয়াছে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ও সূর্যকান্ত মিশ্র ব্যক্তিগত অহমিকা সরাইয়া রাখিয়া রাজ্যের উন্নয়নের স্বার্থকে অগ্রাধিকার দিবেন, ইহাই প্রত্যাশা। |
|
|
|
|
|