সিনেমা সমালোচনা...
অপর্ণার সেরা চিঠি
‘ইতি মৃণালিনী’ দেখে অন্য রকম অনুভূতি জড়িয়ে রইল অনেক ক্ষণ। এই আমি, এতগুলো বছর যে জীবন কাটিয়েছি, সেই আমি কতটা সঠিক ছিলাম? এই এক জীবনে আমি কখনও ইমতিয়াজ, কখনও সিদ্ধার্থ আবার কখনও চিন্তনের ভূমিকায় অভিনয় করে গিয়েছি। অথচ কী আশ্চর্য এ কথা কেউ যেমন আমায় বলেনি, নিজেও বুঝতে পারিনি। অপর্ণা সেনের এই ছবি আমাকে সত্যিটার সামনে দাঁড় করিয়ে দিল।
‘ইতি মৃণালিনী’ দেখে বিষাদে ডুবে যেতে যেতে যে বেদনা বুক চেপে ধরে, তা এক সময় সয়ে যায়। সয়ে যায় বলেই মৃণালিনীর সঙ্গে আমরা মিশে যেতে পারি। তখন তার বেদনাটা তার ধার এবং ভার হারায় এবং মৃণালিনীর মতোই চার পাশের পৃথিবীটাকে আমরা ক্ষমা করে
দিতে পারি।
‘৩৬ চৌরঙ্গী লেন’ থেকে ‘পারমিতার একদিন’, অপর্ণা সেনকে সত্যজিৎ পরবর্তী পরিচালকদের মধ্যে অন্যতম হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছিল। এই ছবিতে মৃণালিনী তাঁর কাছে অভিনয়ের প্রস্তাব নিয়ে আসা পরিচালক ইমতিয়াজকে ঠাট্টা করে বলেছেন, ‘ও সব ফেস্টিভ্যালে পুরস্কার পেয়ে কী লাভ যদি নিজের দেশের মানুষ ছবিটা না দ্যাখে?’ এ তো আমাদেরই কথা। এই সময়ে কলকাতা শহরে পৃথিবীর প্রায় সব ফেস্টিভ্যালে বিখ্যাত এমন কিছু পরিচালক আছেন যাঁদের ছবি শেষ কবে দর্শক হলে গিয়ে দেখার সুযোগ পেয়েছেন মনে করা যাবে না। স্বীকার করতে দ্বিধা নেই এ যাবৎ অপর্ণা যত ছবি তৈরি করেছেন, ‘ইতি মৃণালিনী’ তাদের একটু পিছনে ফেলে দিয়েছে। কাহিনির ভাবনা, বিশ্লেষণ এবং টান টান কৌতূহল রেখে সিনেমার ভাষায় তার বিস্তারে এমন পর্যায়ে নিয়ে যেতে পেরেছেন যা আমাদের শুধু মুগ্ধ করে না, বিস্মিতও করে।
এই ছবি এক জন অভিনেত্রীর অভিজ্ঞতার কাহিনি যা অধিকাংশ সময়ই রক্তাক্ত। ছাত্রী মৃণালিনী পড়াশুনো শেষ করে জীবনের মূলস্রোতের বিভিন্ন কাজের যে কোনও একটা করতেই পারত। তা না করে সে সিনেমায় অভিনয়ের প্রস্তাব মেনে নিল। খুব কম ক্ষেত্রে যা ঘটে, তা ঘটল তার বেলায়। প্রথম ছবিতেই সে ঊর্বশী পুরস্কার পেয়ে বিখ্যাত হয়ে গেল। তার পর শুরু হল বিশ্বাস এবং বিশ্বাসহীনতার অভিজ্ঞতা। পুরনো শিল্পীর ঈর্ষার শিকার থেকে বিবাহিত পরিচালকের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা, পরিচালকের কাছ থেকে প্রতিশ্রুতি ও আইনি বিয়ে ছাড়াই সন্তান গর্ভে এল তার। মৃণালিনীর মায়েরও আইনি বিয়ে হয়নি। বাবাকে ছাড়াই তিনি উত্তর কলকাতার একটি ঘিঞ্জি বাড়িতে থাকেন। মেয়ের গর্ভবতী হওয়ার খবরে তিনি বলেছিলেন, ‘তুইও একই ভুল করলি!’ কেন?
ইতি মৃণালিনী
অপর্ণা, কঙ্কণা, কৌশিক, রজত, প্রিয়াংশু, লকেট, গার্গী
সুস্থ পরিবারের মেয়ে হলে কী তফাত হত?
প্রথম জীবনে নকশাল হতে চাওয়া দেবের সঙ্গে সখ্য হয়েছিল মৃণালিনীর। সিনেমায় আসার পর পরিচালক সিদ্ধার্থ এবং সেই সূত্রে সন্তান। সিদ্ধার্থই ওর সঙ্গে আলাপ করিয়ে দেন দক্ষিণী লেখক চিন্তনের। চিন্তনকে বন্ধু হিসেবে মেনে নিতে বাধ্য হয় মৃণালিনী। চিন্তন তাকে বোঝায়, ‘তুমি এই যে দুই রকমের ভালবাসার কথা জান, তার বাইরেও ভালবাসা আছে।’
তবু কাজ ছেড়ে বসে থাকা মৃণালিনীর জীবনে ইমতিয়াজ আসে। তাকে রক্তকরবীর নন্দিনী করার স্বপ্ন দেখায়। কিন্তু ভুল ভেঙে যায় অল্প দিনেই। ইমতিয়াজ অল্পবয়সী সুন্দরী অভিনেত্রীকে ওই চরিত্রে বেছে নেয়। বারংবার প্রতারিত হতে হতে শেষ পর্যন্ত মৃণালিনী আত্মহত্যার সিদ্ধান্ত নেয়। এক রাতে সে একাকী তার অতীত নিয়ে বসে।
মৃণালিনীর প্রেম শরীর বাদ দিয়ে নয়। একমাত্র চিন্তনই ব্যতিক্রম। সিদ্ধার্থ বিবাহিত, সন্তানের বাবা জেনেও তার প্রেমে পড়েছে সে। পরিচারিকা পরামর্শ দিয়েছিল, আর একটা সংসার না ভেঙে সরে আসতে, কান দেয়নি মৃণালিনী। বরং সিদ্ধার্থকে আরও আঁকড়ে ধরেছে। ইমতিয়াজ তার থেকে বয়সে অনেক ছোট হলেও শারীরিক ঘনিষ্ঠতা এড়াতে পারেনি। এইখানে অপর্ণা সেন মুখোশ পরেননি।
ছবির সব থেকে সুন্দর মুহূর্তগুলো তৈরি হয়েছে মৃণালিনী ও তার মেয়ে সোহিনীকে ঘিরে। টরন্টোয় মামা-মামির কাছে মানুষ সোহিনী ওইটুকু বয়সে জেনে গিয়েছিল সে কে এবং কী! সমুদ্রের ধারে মা এবং মেয়ে যখন ‘এই আকাশে আমার মুক্তি’ গাইছিল, কী জানি কেন, ‘মেঘে ঢাকা তারা’র ভাই-বোনের কথা মনে এল। কোনও মিল নেই, কিন্তু মহৎ কাজগুলো একই সম্মান পেয়ে থাকে।
ছবির শেষে চিন্তনের এসএমএস এল। ঠিক তখনই যখন মুঠোমুঠো ঘুমের ওষুধ খেতে যাচ্ছিল মৃণালিনী। চিন্তনের ‘আমি আসছি’ শোনামাত্র সে কি অন্য রকম ভালবাসার স্বাদ নিয়ে বাঁচতে চাইল? ওষুধগুলো কৌটো ভর্তি করে সে যখন প্রিয় কুকুরকে সঙ্গে নিয়ে বাড়ি থেকে বের হল, তখন সবে ভোর হচ্ছে, মর্নিংওয়াকাররা তাকে গুড মর্নিং বলে ব্যস্ত হয়ে চলে যাচ্ছে। প্রায় ফাঁকা রাস্তায় মৃণালিনীকে শুদ্ধ করে দিল এক দল কচি স্কুলের বাচ্চা।
তারা চেঁচিয়ে তাকে জানাল এখন সুপ্রভাত। ঠিক তখনই ছুটে যাওয়া এক তরুণের উদ্দেশে গুলি ছুটে গেল ধাবমান গাড়ি থেকে। আমরা দেখলাম মৃণালিনীর প্রাণহীন শরীর মাটিতে লুটিয়ে পড়ল। গুলি কি ছেলেটির বদলে তার শরীর বিদ্ধ করেছিল, না গুলির আওয়াজে তার হৃদযন্ত্র বন্ধ হয়ে গিয়েছিল? আমরা কোনও রক্ত ওর শরীরে দেখিনি। যে মেয়ে আর একটি সুন্দর সকালের দিকে পা বাড়িয়েছিল তার শরীর কেন গুলির কারণে মাটিতে লুটিয়ে পড়বে? জীবনে আচমকা কত কী ঘটে যায়, মানছি, এই ঘটনাটা সাহিত্যে বা চলচ্চিত্রে ঘটলে অস্বস্তি বেড়ে যায়। মৃণালিনীর মুখ সেই ভোরে জীবনের অবয়বে ভরপুর হয়ে ছিল, আমরা বিষাদ থেকে মুক্তি পাওয়ার আনন্দে বাহবা দিচ্ছিলাম। কিন্তু...এই ছবির চিত্রগ্রাহক সোমক মুখোপাধ্যায় অল্প বয়সে পৃথিবী থেকে চলে গেছেন। তাঁর কাজ দেখে মনে হচ্ছিল ভবিষ্যতে আমরা বঞ্চিত হব। রবিরঞ্জন মৈত্রের সম্পাদনা ছবিটিকে শুধু গতি দেয়নি, অর্থবহ করেছে। বোধহয় এই ছবিতেই প্রথম রবীন্দ্রনাথের বাইরে গান ব্যবহার করেছেন অপর্ণা। দেবজ্যোতি মিশ্রও চমৎকার কাজ করেছেন।
অভিনয় সবাই ভাল করেছেন। কঙ্কণা সেনশর্মা তো অনবদ্য। কৌশিক সেন আমাকে চমকে দিয়েছেন। দক্ষিণী হিসেবে একেবারে ঠিকঠাক। সামান্য মেক-আপ তাঁকে আমূল বদলে দিয়েছে। প্রিয়াংশু, রজত কপূর ঠিকঠাক। দ্বিতীয় জনকে সাহায্য করেছেন অঞ্জন দত্ত। খুব ভাল লেগেছে গার্গী রায়চৌধুরীকে। ওইটুকু চরিত্রে যা অভিনয় করলেন তা অনেক দিন মনে থাকবে।
সাহেব ভট্টাচার্য, দুলাল লাহিড়ী যথাযথ। সোহিনী চরিত্রের দুই শিশু তৃতি, অঞ্জলি এবং বালিকা অভিনেত্রী অনন্যাকে দিয়ে অপর্ণা যে অভিনয় করিয়ে নিয়েছেন, তাতে বারংবার সত্যজিৎ রায়ের কথা মনে পড়ে। অপর্ণা সেন। বারংবার নিজেকে প্রমাণিত করেছেন। ওঁর সম্পর্কে কোনও শংসাবাক্য লেখার চেষ্টা করার আর কী দরকার!
Previous Item Patrika First Page


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.