নিজস্ব সংবাদদাতা • ময়ূরেশ্বর |
কেউ বাস করেন পাকা বাড়িতে। কারও রয়েছে জমি-জমা, ট্রাক্টর, সাবমার্সিবল পাম্প। আর্থিক সঙ্গতিসম্পন্ন ওই সব ব্যক্তিরা দারিদ্রসীমার নীচে বসবাসকারী হিসেবে চিহ্নিত হয়েছেন। আবার অনেক পরিবার আছে যাঁদের মাটির কুঁড়ে ঘরের চাল দিয়ে জল পড়ে, কার্যত ভিক্ষাবৃত্তি করে তাঁদের পেট চলে। ওই সব হতদরিদ্র সহায়-সম্বলহীনদের দারিদ্রসীমার নীচে বসবাসকারী হিসেবে স্বীকৃতি মেলেনি। এমনই চিত্র ধরা পড়েছে ময়ূরেশ্বর থানার দক্ষিণ গ্রাম পঞ্চায়েতের পাখুরিয়া গ্রামের বিপিএল তালিকায়।
ওই তালিকার সৌজন্যে যথেষ্ট অবস্থাপন্ন পরিবারের লোকেরা সরকারি সুযোগ-সুবিধা হাতিয়ে নিচ্ছেন। আর প্রকৃত দুঃস্থরা তার নাগাল পাচ্ছেন না বলে অভিযোগ। সম্প্রতি গ্রামবাসীদের একাংশ জেলাশাসকের কাছে ওই বিপিএল তালিকা বাতিল করে প্রকৃত দুঃস্থদের তালিকাভুক্ত করার দাবি জানিয়েছেন। |
প্রশাসন ও স্থানীয় সূত্রে জানা গিয়েছে, ২০০৫ সালে ওই গ্রামের আংশিক বিপিএল তালিকা প্রকাশিত হয়। সেই সময় পঞ্চায়েতে ক্ষমতায় ছিল সিপিএম। ২০০৮-এ ক্ষমতায় আসে বিজেপি-তৃণমূল জোট। তার পরে প্রকাশিত হয় পূর্ণাঙ্গ তালিকা। সেই তালিকা প্রকাশিত হওয়ার পরে এলাকায় হইচই পড়ে যায়। দেখা যায় গ্রামের ১৭০টি পরিবারের মধ্যে ১০৫টি পরিবার দারিদ্রসীমার নীচে বসবাসকারী হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। কিন্তু তাদের অধিকাংশের আর্থিক অবস্থা ভাল বলে গ্রামবাসীদের একাংশের দাবি। তালিকায় ৫২ নম্বরে রয়েছে মনসা পালের নাম। তাঁদের টিনের চালের মাটির বাড়ি। ১৪ বিঘা জমি। দু’টি সাবমার্সিবল পাম্প, ধানকল রয়েছে। বাড়িতে আছে ধানের মড়াই। তবু বিপিএল তালিকায় নাম থাকার সুবাদে সম্প্রতি খরার জন্য বিনামূল্যে ১৮ কেজি চাল ত্রাণ হিসেবে পেয়েছেন। এই তথ্যের সত্যতা স্বীকার করেও মনসাবাবু দাবি করেন, “পরিবারের একমাত্র ছেলে হলেও জমিজমা সবই বাবার নামে। আমার কিছু নেই। আমি তো দুঃস্থ।”
একই ভাবে নিজেকে দুঃস্থ বলেছেন তালিকার ৫৩ নম্বরে থাকা কাঞ্চন রায়ও। একান্নবর্তী পরিবারের সদস্য কাঞ্চনবাবুর বাবা সেচ দফতরের প্রাক্তন কর্মী। এক বৌদি পঞ্চায়েতের অস্থায়ী কর্মী। রয়েছে দোতলা পাকাবাড়ি। বিঘে ছয়েক জমিও। ১৮ বিঘা জমি, দু’টি সাবমার্সিবল পাম্প, ১টি ট্রাক্টর, পাকা বাড়ির মালিক হয়েও তালিকার ৫৭ নম্বরে ঠাঁই মিলেছে রাম দাসদের। পেয়েছেন খরার জন্য বরাদ্দ ১৮টি চালও। তিনি বলেন, “কী করে আমার নাম তালিকাভুক্ত হল বলতে পারব না। যাঁরা তালিকা করেছেন তাঁরাই বলতে পারবেন।”
এমনকী তালিকার ৬৭ নম্বর রয়েছে সিপিএমের প্রাক্তন পঞ্চায়েত সদস্য অরুণ দে’র নামও। তাঁর বিঘে ১২ জমি আছে। সাবমার্সিবল পাম্পের মালিক অরুণবাবুর এক ছেলে পুলিশ কর্মী। আর বাড়িতেই ধানের বিশাল মড়াই রয়েছে। অথচ তিনি রেশন থেকে তুলেছেন খরা ত্রাণের জন্য বিনামূল্যে ১৮ কেজি চাল। ওই প্রসঙ্গ তুলতেই দৃশ্যত বিব্রত অরুণবাবু। তিনি দাবি করেছেন, “ওই চাল তুলে আমি এক জন দুঃস্থকে দান করে দিয়েছি। আমার নাম বিপিএল তালিকাভুক্ত হওয়ার যোগ্য নয় এ কথা সত্য। তাই নাম বাদ দেওয়ার জন্য লিখিত ভাবে প্রশাসনকে জানিয়েছি। আসলে আমাকে হেনস্থা করতেই বিজেপি পরিচালিত পঞ্চায়েত আমার নাম বিপিএল তালিকায় তুলে দিয়েছে।” কিন্তু পঞ্চায়েতে সিপিএম ক্ষমতায় থাকার সময়ে এই তালিকা তৈরি হয়েছিল। এ ব্যাপারে অরুণবাবু বলেন, “সেই তালিকায় অবস্থাপন্ন পরিবারের নাম ছিল না। যদি ১০৫টি পরিবারের মধ্যে ঠিক মতো সমীক্ষা করা হয় তা হলে দেখা যাবে ১৫টির বেশি পরিবার দারিদ্রসীমার নীচে বসবাসকারী হিসেবে চিহ্নিত হবেন না। ৭টি পরিবারের নাম দু’বার করেও রয়েছে।” |
অন্য দিকে, বিধবা নির্মলা বাগদি, অপ্সরী বাগদিরা থাকেন মাটির কুঁড়েঘরে। কার্যত ভিক্ষাবৃত্তি করে চলে তাঁদের সংসার। তাঁদের কথায়, “গ্রামের অবস্থাপন্নরা বিভিন্ন সরকারি সাহায্য পান। কী অপরাধে আমাদের নাম বিপিএল তালিকায় ওঠেনি বুঝতে পারছি না!” নির্মলাদেবী অবশ্য মাসে ৪০০ টাকা ভাতা পান। কিন্তু ওই টাকায় ওষুধ কিনতে খরচ হয়ে যায় বলে তিনি জানিয়েছেন। তৃণমূলের স্থানীয় গ্রাম কমিটির সভাপতি এবং যুব সভাপতি যথাক্রমে বাণীপ্রসাদ ভট্টাচার্য এবং তাপস বাগদি। তাঁদের অভিযোগ, “পঞ্চায়েতের যোগসাজোসে গ্রামের অধিকাংশ অবস্থাপন্ন পরিবারের নাম বিপিএল তালিকায় রয়েছে। এর ফলে তাঁরা দারিদ্রসীমার নীচে বসবাসকারীদের জন্য বরাদ্দ ইন্দিরা আবাস, চাল, গম-সহ বিভিন্ন সরকারি সুযোগসুবিধা হাতিয়ে নিচ্ছেন। আবার অনেকে হাতিয়ে নেওয়ার তালেও রয়েছেন। অথচ প্রকৃত দুঃস্থরা বঞ্চিত হচ্ছেন।”
দক্ষিণ গ্রাম পঞ্চায়েতের প্রধান বিজেপির অপর্ণা ধীবর অবশ্য বলেন, “পঞ্চায়েতের ক্ষমতায় থাকাকালীন সিপিএম ওই তালিকা তৈরি করেছিল। ক্ষোভের আঁচ পেয়ে অবস্থাপন্ন পরিবারের নাম বাদ রেখে আংশিক ভাবে তালিকা প্রকাশ করে। ক্ষমতায় আসার পরে আমরা তাদেরই করা পূর্ণাঙ্গ তালিকা প্রকাশ করি। তালিকায় অসঙ্গতির অভিযোগ পাওয়ার পরে অবস্থাপন্নদের নাম বাদ দেওয়ার জন্য ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছি।” জেলাশাসক সৌমিত্র মোহন বলেন, “ওই অভিযোগের কথা জানা নেই। কী করে এমন হল খতিয়ে দেখে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হবে। সেপ্টেম্বর মাসে বিপিএল তালিকার জন্য সমীক্ষা শুরু হবে। তখন প্রকৃত দুঃস্থদের তালিকাভুক্ত করা হবে।”
ছবি: অনির্বাণ সেন। |