বৃষ্টি পড়ুক বা না পড়ুক আজ পাত জুড়ে তুমিই
যে সব বেআক্কেলে বদমাশ খিচুড়ি খায় না, তাদের ইমিডিয়েটলি দ্বীপান্তর হওয়া উচিত। মেনল্যান্ডে তাদের রাখার গ্রহণযোগ্য কারণ আমি এই মুহূর্তে খুঁজে পাচ্ছি না। কালাপানি পার করিয়ে দিলে আর একটা সুবিধে আছে, তাদের বদসঙ্গ থেকে অপাপবিদ্ধ কয়েকজনকে এখনো বাঁচানো যেতে পারে। আমি কিন্তু নানা প্রকারের বাঙালি খিচুড়ির প্রসঙ্গেই এতটা মারমুখি, উত্তর ভারতের রোজকার সাধারণ খিচড়ি নামক যে বস্তুটি সকলেই আহ্লাদ করে খেয়ে থাকেন, সেটি কে খেলো কে না খেলো তা নিয়ে আমার বিন্দুমাত্র মাথা ব্যাথা নেই। দেরাদুনে থাকার সময় হাতে কলমে এক্সপেরিমেন্ট করে দেখেছি, টমেটো গাছের গোড়ায় থালা ভর্তি সে পদার্থ ঢেলে দিলে ফল পুরুষ্ট হয়। আর তার পর দিন দশেক মন যে কী ভাল থাকে সে আর কী বলব, হৃদয়ের অন্তঃস্থলে না কোথায় যেন কেমন একটা গান্ধীজির সঙ্গে চরকা কেটে অনশন করেছি ভাব ফুলে ফুলে ওঠে।
আমায় অবশ্যি নিমন্ত্রণ বাড়িতে গিয়ে গৃহস্বামীর মন রাখার জন্য ওর পর বুন্দি না খোদায় মালুম কী একটা দিয়ে রায়তা নামক টক দই ঘাঁটা খেতে হয় - তাতে আবার শুকনো লঙ্কার গুঁড়ো ছড়িয়ে আহ্লাদ করা হয়েছিল। একেবারে গা-পিত্তি জ্বালানো ব্যাপার। আমি খুব আশা করেই গেছিলাম। ভেবেছিলাম নেমন্তন্ন করে খাওয়াচ্ছেন যেখানে, চার-পাঁচ রকমের ভাজা তো থাকবেই, যখন এমনি বর্ষার দিনে গেরস্ত বাড়িতে খিচুড়ির পাতে থরে থরে ভাজা এসে পড়ার ব্যবস্থা না থাকলে সকলের মুখই কেমন গোমড়া মতো দেখায়। আর লাবড়ার কথা না হয় নাই বা বল্লেম। তা ও পদার্থটি যে আমি প্রবাসে আশা করেছিলেম, তা একেবারেই নয়। তাই বলে ওই চিজ? খানিকটা সরু চাল-ডাল দিয়ে সেদ্ধ করেছে এমন যে ঘেঁটে পাক মেরে গেছে। কোথায় আগে গোবিন্দভোগ বা কালো নুনিয়া চাল ধুয়ে শুকিয়ে নেবে, মুগডাল ঘি-এ ভেজে তুলে রাখবে আলাদা করে, মশলা করবে মাপ মতো যাতে কম-বেশি হয়ে গিয়ে চাল ডালের গন্ধ মেরে না দেয়, তা নয়, চাড্ডি চাল-ডালের লাপসি রেঁধেছে।
আরে বাবা খিচুড়ি রাঁধতে হয়, চোখ গোল গোল করে পাকায়েঙ্গে বলে এক গাল হেসে কেবল মাত্র টিকি নাড়লে যে ঘ্যাঁট পাকিয়ে যাবে তাতে আর সন্দেহ কী! ওই মশলার কথায় মনে পড়ল, বাড়িতে শীতের রাতে ঝেঁপে বৃষ্টি নামলে গোটা রসুন খোসা সমেত দেওয়াটা রেওয়াজ- খাওয়ার সময় চটকে চিপে নিয়ে খোসা ফেলে দিলেই হল। ওভারপাওয়ারিং গন্ধ বেরোয় সন্দেহ নেই, তবে দারুণ লাগে ফুলকপি ডিমের গোলায় চুবিয়ে কড়কড়ে করে ভাজা পকোরার সঙ্গে। শ্রীক্ষেত্রে যেমন নিরামিশ খিচুড়ি রাঁধে, তেমনটিও আমার খুব পছন্দ। বর্ষার দুপুরে সাবুর পাঁপড়, বড়ি, আলু, বেগুন, পটল ইত্যাদি ভাজা থাকবে। তবে মন্দিরের চাতালে বসে খাওয়ার মজাই আলাদা। এক এক জায়গার, এক এক পার্বণের এক এক রকম গন্ধ খিচুড়ির গন্ধের সঙ্গে মিশে থাকে। ঈশ্বর বিশ্বাসী হই বা না হই, একটু দূরে ঢাক,কাঁসর বাজছে, ধুপ-ধুনোর ধোঁয়ার পাতলা আস্তরণ ভেসে বেড়াচ্ছে শরীরের চারদিকে, নতুন কাপড় পরে পরিবেশনকারীরা বালতি হাতা টমেটোর চাটনির ডেকচি নিয়ে ছুটোছুটি হাঁকেডাকে মহা গোলমাল পাকিয়ে তুলেছে আর তার মধ্যে কোথাও একটা পাত পেড়ে সবাই মিলে খিচুড়ি খাওয়া হচ্ছে - এর তো কোন বিকল্প হতে পারে না, মনে এমনিই কেমন একটা রিলিজিয়াস ভাব এসে যায়, শেষ পাতে পায়েস থাকলে তো প্রায় এঁটো হাতেই লোকজনকে প্রণাম করে ফেলি।
কোন টি-এস্টেট এখন আর মনে নেই, ছেলেবেলায় এক বার ইশকুলের বন্ধুদের সঙ্গে চলেছি বেড়াতে। ভয়ানক বৃষ্টির দিন। আমরা সবাই বাসেই ভিজে চুপ্পুর। এগারোটা নাগাদ শালুগাড়াতে নেমে পড়লাম, বাস আর যাবে না, যন্ত্র বিকল হয়ে গেছে। দৌড়ে সবাই একটা চালার তলায় আশ্রয় নিলাম। চায়ের দোকান। মালিকটি আমাদের অবস্থা দেখে দয়া করে গামছা দিলেন, তার পর সামান্য পয়সার বিনিময়ে দুপুরে খিচুড়ি রেঁধে খাওয়াবেন জানিয়ে কোথায় হাওয়া হয়ে গেলেন। তখন লোকজন কম ছিল। আমরা বেঞ্চিতে বসে হইচই করছি, খানিক পরে উনি ফিরলেন, সঙ্গে অনেকগুলি হাতা, খুন্তি সমেত ওঁর স্ত্রী, একটা তরকারির ঝুড়ি মাথায় ওঁর মেয়ে - তপন ইন্সট্যান্টলি মেয়েটির দিকে চেয়ে দিলরুবা হয়ে গেল - আর আমাদের চেয়ে বছর খানেকের ছোট মহা বিচ্ছু দুটো ছেলে। দোকানে যত ক্ষণ খিচুড়ি আর লাবড়া রান্না হচ্ছিল, ছেলে দু’টি আমাদের প্রথমে নানাবিধ অদ্ভুত এবং অত্যাশ্চার্য রকমের ভয়ানক সমস্ত প্রশ্ন করে জ্বালিয়ে খাচ্ছিলো ঠিকই, তবে তা’ও সহ্যের সীমার ভেতর বলে গা’য়ে লাগছিল না তেমন। রাজুর কানগুলো বড় বড় বলে কি সে অনেক দূরের শব্দও শুনতে পায় - এই যেমন এন জি পি স্টেশনে সকালে ট্রেন এসে দাঁড়ালে কি ও পরিষ্কার শোনে জাতীয় প্রশ্ন তবু বরদাস্ত করছিলাম হাসিমুখে - রাজুর মুখটা অন্যদের তুলনায় একটু কম বিগলিত দেখাচ্ছিল ঠিকই, তবে যখন একটা রবারের বল জুটিয়ে এনে আমাদের হাত ধরে টানাটানি শুরু করে দিল বাইরে বৃষ্টির মধ্যে গিয়ে খেলায় যোগ দেওয়ার জন্য, তখন প্রমাদ গুণলাম। তার পর আবার মাঝেমাঝে চিমটি কেটে কাতুকুতু দেওয়ার চেষ্টা করছিল। সে যাক। দুপুরে খেয়েছিলাম সবাই ওই দোকানে। ভদ্রলোক বৃষ্টি মাথায় কলাপাতা কেটে আনলেন। আমরা কলাপাতায় খিচুড়ি, লাবড়া আর বাড়িতে তৈরি আচার খেয়ে সারা দুপুর রাস্তার পাশে ফাঁকা জমিতে ফুটবল খেলে সারা গা’য়ে কাদা মেখে সন্ধের সময় বাড়ি ফিরেছিলাম।
Previous Item Utsav Next Item



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.