টিভিতে রাত দিন চোখ আটকে বসে থাকা ডানপিটে ছেলে। কল্পবিজ্ঞান বলতে অজ্ঞান। স্টার ওয়ার্স, সুপারম্যান সিরিজ শুরু হলেই নাওয়া-খাওয়া গুবলেট। ভিনগ্রহী জীবগুলোকে দেখে দেখে আশ মেটে না॥
দেশে বিদেশে
বাণিজ্য বিভাগে স্নাতক পড়ার পাশাপাশি চলল ফ্যাশন নিয়ে পড়াশুনা। তাঁর পোশাকে র্যাম্প মাতালেন মুম্বইয়ের তৎকালীন র্যাম্প নক্ষত্ররা। পুরস্কাররাও আসতে লাগল একে একে দেবারুণ মুখোপাধ্যায়, বেস্ট ক্রিয়েটিভ ডিজইনার। কিন্তু তৃপ্তি এল কই? আরও শেখার ইচ্ছেয় ভিড়ে গেলেন ডিজাইনার আকি নারুলা-র টিমে। তার পরই পাড়ি দিলেন লন্ডন।
লন্ডন কলেজ অব ফ্যাশন-এর ডিগ্রি-র পাশাপাশি বায়োডেটায় জুড়ে নিলেন এক্সপোর্ট হাউস-এ কাজের অভিজ্ঞতা। আর মনে জুড়ে নিলেন দেশ-বিদেশ ভ্রমণের অভিজ্ঞতা। লন্ডনে গিয়ে আলেকজান্ডার ম্যাককুইন-এর ফ্যাশন হাউসেও কাজ করলেন কয়েক দিন। ইউরোপ-এশিয়া-আফ্রিকার শহর-গ্রাম ঘুরে মনের মধ্যে গেঁথে নিলেন তাদের জীবন সংস্কৃতি, নানা ধরনের সুূতোর কাজ, ভিনধারার বিচিত্র সব পরিধানের খুঁটিনাটি। মিশেল বাস, নাগরিক বা লোকায়ত বিবিধ সংস্কৃতিজাত বিশ্বব্যাপী পোশাক বৈচিত্র্য বিষয়ে তখন ধারণাটা বেশ স্পষ্ট।
ফ্যাশন কিন্তু বিলাস নয়
প্রস্তুতিপর্ব মনের মতো হলে শুরু করলেন নিজের ব্র্যান্ড ‘দেবারুণ’। সালটা ২০০৬। ফ্যাশন মানে কি শুধুই বিলাস? শুধুই কল্পনা? দেবারুণ এই ধারণাটাকেই ভাঙতে চেষ্টা করলেন। ইন্ডাস্ট্রি’তে বাণিজ্য ও বিনিয়োগের সুযোগও তো নেহাত কম নয়। কত সাধারণ মানুষের রুজি-রোজগার জড়িত এই ইন্ডাস্ট্রির সঙ্গে। ফ্যাশন এ দেশের অর্থনীতির অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ। তাঁর পোশাক শুধু মানুষটার চেহারাটাকেই বদলে দেয় না, একটা প্রজন্মের চিন্তা-ভাবনাকেও অনেকখানি পালটে দেয়।
গল্প শুনে
শেষ কথাটা একটু শক্ত ঠেকল। একটা উদাহরণ দিয়ে দেবারুণ তাঁর চিন্তাটাকে স্পষ্ট করে মেলে ধরলেন। কিছু দিন আগেই দেবারুণ ল্যাকমে ফ্যাশন উইকে দেখিয়েছেন তাঁর নতুন কালেকশন। ওপিউলেন্ট অ্যান্ড চেস্ট। বাংলা করলে দাঁড়ায় বিলাসবৈভব আর পবিত্রতা, সারল্য। এই দুটো ধারণার সহাবস্থান খুব আশ্চর্যের। দেবারুণের কালেকশনের অনুপ্রেরণা ছিল ভাই শুভারুণের লেখা একটা ছোট্ট প্রেমের গল্প। ওপিউলেন্ট এক রাজার ছেলে, সোনায় মোড়া তার জীবন। তার প্রেয়সী চেস্ট হল এক আশ্রমিক মেয়ে। তার মনটা এতই পবিত্র যে রক্তের রং সাদা। কাহিনির শেষটা বিয়োগান্তক। কিন্তু তাদের প্রেম ঐশ্বরিক, চিরন্তন। এই রূপকথাই দেবারুণ ফুটিয়ে তুলেছেন তাঁর সৃষ্টিতে। খুব স্নিগ্ধ ক্রিম রঙা কটন কোরা ফেব্রিকের ওপর সোনালি সুতো দিয়ে অ্যাপ্লিকের অলঙ্করণ। রাজৈশ্বর্য আর নির্মল মনকে পাশাপাশি রাখলে বুঝি এমন স্বর্গীয়ই দেখায়। পোশাকের ওপর ফুলের নকশা। প্রেমের স্মারক। এই কালেকশনের চরিত্রটা পুরোদস্তুর ভারতীয়। মেয়েদের পরিধানে প্লিটেড ড্র স্ট্রিং প্যান্টস, শাড়ি, ছোট ঝুলের ব্লাউজ ও লেহেঙ্গা আকৃতির ক্যানক্যান (ঘেরওয়ালা লম্বা স্কার্ট), এলাইন লেহেঙ্গার সঙ্গে পাফড স্লিভস ব্লাউজ, সঙ্গে দোপাট্টা। স্কার্ট-এর সঙ্গে চুড়িদার, আর লেহেঙ্গা টপ। ছেলেদের জন্য ছিল লম্বা ঝুলের কুর্তা, স্টিচড ধোতি প্যান্টস, স্লিভলেস জ্যাকেট, সাইড বক্স প্লিটেড ট্রাউজার্স।
কখন যে কী দেখে...
দেবারুণের অনুপ্রেরণাগুলো বরাবরই এই রকম অভিনব। এক বার ছিল চানাচুর। রঙের খেলা, আড্ডা মেজাজ, মুখরোচক স্বাদের রেশ ছিল পোশাকেও। এক বার উদ্বুদ্ধ হয়েছিলেন ডিয়ার ইমাজিনেশন নামের একটা এনজিও-র কাজের দ্বারা। কখনও সামনে পড়ে থাকা খবরের কাগজ, কখনও চায়ের কাপ, কখন যে কী দেখে মাথায় সৃষ্টি ঝলসে ওঠে, নিজেও জানেন না।
সৃষ্টির বিপণিতে
তাঁর কালেকশনের বেশির ভাগটাই মেয়েদের পোশাক, পুরুষ পোশাক সংখ্যায় কম। প্রেট লাইনে রয়েছে টিউনিক, সালোয়ার, ঊর্ধ্ববাস বা টপ এবং অনেক অনেক শাড়ি। এই সব পোশাকের দাম শুরু মাত্র চার হাজার টাকা থেকে। তাঁর ডিফিউশন লাইনটা এখনও সে ভাবে প্রস্তুত নয়। তবে অর্ডার দিলে বানিয়ে দেন অনুষ্ঠান বা পার্টিতে পরার সুদৃশ্য পোশাক। ‘এক্সক্লুসিভ’ তো, তাই মূল্যটাও একটু বেশির দিকে। ছেলেদের জন্যও বানিয়ে দেন কুর্তা, শেরওয়ানি, বন্ধগলা বা জ্যাকেট। কোনও বিশেষ রঙে আটকে রাখেন না সৃষ্টিকে। বলেন, ‘এ দেশে সে সুযোগটাও তো নেই। আবহাওয়ার মর্জি মেনে চলি। চেনা ছক। গরমে মিহি নরম রং, আর শীতে একটু ঝলমলে। উৎসবের মরশুম যে। পেস্টাল শেড, প্রাকৃতিক ফেব্রিক নিয়েও কাজ করি। অদ্ভুত একটা মাধুর্য আছে ওই মোলায়েম রংগুলোর।’ তার পর বলেন, ‘আর একটা বিষয়ও খুব খেয়াল রাখি। আমার পোশাক যিনি পরবেন তাঁর স্বভাব আর জীবনবোধ।’
রাজপুরুষ এবং সবার জন্য
এ বারের ফ্যাশন উইকে শো স্টপার ছিলেন তরুণ অভিনেতা আদিত্য রয় কপূর। আর্য, অভিজাত চেহারা। দেবারুণ বললেন, ‘আদিত্য স্বভাবে একেবারে মাটির মানুষ। জাঁকজমক ঠাসা নবাবি পোশাক ও পরতে চাইবে না কিছুতেই। ওর জন্য সেমি ফর্মাল পোশাক বানিয়েছিলাম। লিনেন ট্রাউজার্স-এর ওপর অ্যাপ্লিক শার্ট, তার ওপরে টোন অন টোন জ্যাকেট। আর সঙ্গে স্লিপার। পোশাক ওর স্বাভাবিক সৌন্দর্যকে ছাপিয়ে যায়নি একটুও, বরং আরও আকর্ষণীয় করে তুলেছিল। ঠিক এই লক্ষ্যটাকেই সামনে রেখে পোশাক বানাই আমি, সবার জন্য।’
|