|
|
|
|
|
|
|
পুস্তক পরিচয় ২... |
|
উপন্যাসের কেন্দ্র আসলে সোনার হরিণ |
গৌতম চক্রবর্তী |
দ্য নেইভ অ্যান্ড দ্য সেন্টিমেন্টাল নভেলিস্ট, ওরহান পামুক। হেমিশ হ্যামিল্টন, ৪৫০.০০ |
কী ভাবে উপন্যাস লেখেন এক জন ঔপন্যাসিক? তথ্য জোগাড় করার পর তাঁর চোখের সামনে শুধুই ঘুরঘুর করতে থাকে কিছু চরিত্র? কোনও পাঠকের ছবি কি থাকে তাঁর মনের আয়নায়? নাকি অমোঘ প্রেরণার বশে ভরিয়ে চলেন পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা?
উপন্যাস লেখা এবং পড়া নিয়ে ২০০৯-এ হার্ভার্ড-এ চার্লস এলিয়ট নর্টন বক্তৃতামালায় এমনই কয়েকটি প্রসঙ্গের অবতারণা করেছিলেন তুরস্কের নোবেলজয়ী লেখক ওরহান পামুক। এর আগে এলিয়ট, পাজ, বোর্হেজ, ক্যালভিনো, একো অনেকেই ওই বক্তৃতা দিয়েছেন। পামুকের বক্তৃতাগুলি এ বার দ্য নেইভ অ্যান্ড দ্য সেন্টিমেন্টাল নভেলিস্ট নামে প্রকাশিত হয়েছে।
নামকরণে ‘নভেলিস্ট’ বা ঔপন্যাসিকের গুরুত্ব লক্ষণীয়। নভেল কী এবং কেন, ছাপাখানার উদ্ভব, পত্রপত্রিকা ও ‘প্রিন্ট ক্যাপিটালিজম’-এর ফলে উপন্যাস কী ভাবে গুরুত্ব পেল, তা নিয়ে ইতিমধ্যেই নানা সন্দর্ভ লেখা হয়েছে। কিন্তু পামুক সে সব তাত্ত্বিক লেবু কচলাতে নারাজ। ঔপন্যাসিক এবং উপন্যাস-পাঠকই তাঁর কাছে আসল। ‘যৌবনে উপন্যাসকে সিরিয়াসলি নিয়েছিলাম বলে হয়তো জীবনকেও আজ সিরিয়াসলি নিতে শিখেছি,’ এই বইয়ে জানিয়েছেন পামুক। ‘নেইভ’ এবং ‘সেন্টিমেন্টাল’-এর এই দ্বিকোটিক বিভাজনটি উনিশ শতকের জার্মান কবি শিলারের থেকে ধার করেছেন পামুক। দুই ধরণের কবির কথা বলেছিলেন শিলার। এক দল ‘নেইভ’ বা সরল। তাঁরা প্রকৃতির মতোই স্বাভাবিক। সাহিত্যের টেকনিক বা কৃত্রিমতা নিয়ে মাথা ঘামান না। অন্য দল ‘সেন্টিমেন্টাল’। তাঁরা রীতিমতো আত্মসচেতন। কবিতার ভাষা ও প্রকরণ নিয়ে চিন্তা করেন, জগৎ এবং কবিতার ব্যাখ্যান দুই নিয়েই তাঁরা মেধাবী সংশয়ে। বাঙালি পাঠকের মনে পড়তে পারে, তুলনামূলক সাহিত্যে একদা বুদ্ধদেব বসু এই বিভাজনটি আরও স্পষ্ট করে দিয়েছিলেন। কিট্স অশিক্ষিত, ‘নেইভ’ কবি। তাঁর পাশে শেলি অনেকাংশেই মেধাবী ‘সেন্টিমেন্টাল’।
পামুকের বক্তব্য, ঔপন্যাসিকরাও ওই দুই ধরণের। কিন্তু যথার্থ ঔপন্যাসিক দুইয়ের মিশ্রণ। আর সেই মিশ্রণ ঘটাতে গেলে প্রথমেই উপন্যাসের চরিত্রকে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভাবার ছক থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। ১৯২৭ সালে কেমব্রিজের ট্রিনিটি কলেজের বক্তৃতায় ই এম ফরস্টার বলেছিলেন, ‘চরিত্রগুলিই লেখককে চালনা করে।’ আর পামুক পূর্বসূরির বিপরীত মেরুতে দাঁড়িয়ে জানান, ‘চরিত্র-টরিত্র নয়, ঔপন্যাসিকের মনে প্রথমে আসে একটা ‘টপিক’ বা বিষয় নিয়ে অনুসন্ধিৎসা।’ প্রায় হাসতে হাসতে লেখেন তিনি, ‘উপন্যাসে যত ক্যারেক্টার দেখা যায়, বাস্তব মোটেও সে রকম নয়। ৫৭ বছর বয়স হল। এখনও কোনও উপন্যাস, থুড়ি, ইউরোপীয় উপন্যাসের চরিত্রের সঙ্গে নিজেকে মেলাতে পারলাম না।’
আর তখনই মনে পড়ে যায় পামুকের উপন্যাস মাই নেম ইজ রেড। উপন্যাস তো শুধু ইউরোপের হাতফেরতা প্রকরণ নয়। এক এক দেশে এক-এক রকম ইতিহাস। ফলে সেখানে কথকের ভূমিকায় চলে আসে এক কুকুর। সে প্রশ্ন করে, ‘আমাদের দেখলে ইস্তাম্বুলের লোকেরা কেন যে এত মারমুখো! নমাজের সময় গা ঠেকে গেলেই তেড়ে মারতে আসে!’ তার পর জানায়, ‘যাক গে, আমাদের কুকুরত্ব এখনও অটুট। আমরা এখানে আজও দল পাকিয়ে শুয়ে থাকি, রাস্তায় লোক দেখলে ঘ্যাঁক ঘ্যাঁক করে তেড়ে যাই। আর বিধর্মী দেশে? কুকুরদের খুব কষ্ট। মানুষদের সঙ্গে এক ঘরে থাকতে হয়, মানুষেরা আবার ওদের গলায় শেকল লাগিয়ে টানতে টানতে বেড়াতেও নিয়ে যায়।’ ইউরোপীয় উপন্যাসের প্রথাসম্মত দন কিহোতে, ডেভিড কপারফিল্ড বা আনা কারেনিনা জাতীয় চরিত্রের বাইরে বেরিয়েই উত্তর-ঔপনিবেশিক যুগচরিত্রকে তুলে ধরেছিলেন পামুক।
পামুকের বইয়ের দুর্বলতা এবং শক্তিমত্তা দুই-ই এখানে। ফরস্টার বা লুকাচের মতো তিনি এখানে শুধুই উপন্যাসের তত্ত্বপ্রতিমা নির্মাণ করেন না। নিয়ে আসেন নিজেকেও। ‘আমি এ ভাবেই লিখি’... বারংবার জানান তিনি। আসলে ব্যক্তিগত উপলব্ধি থেকেই ঔপন্যাসিকের প্রকরণকে ছেনে দেখেছেন ওরহান পামুক। প্রথম জীবনে তিনি চিত্রশিল্পী হতে চেয়েছিলেন। ফলে, চিত্রকলার সঙ্গে উপন্যাসের তুলনা এসেছে বারংবার। লেখকের মতে, ভাল উপন্যাস ভাল শিল্পীর নিসর্গচিত্রের মতো। তবে, দেওয়ালে ছবি ঝোলানো থাকে, দর্শক বাইরে থেকে দেখে। ফ্রেমের মধ্যে সে ঢুকতে পারে না। আর উপন্যাস নিসর্গ আঁকে তার ভিতরে-থাকা চরিত্রদের চোখে। প্রতিটি চরিত্র, তাদের শ্বাসপ্রশ্বাস, হাঁটাচলা নিয়ে তৈরি হয় উপন্যাসের নিজস্ব ‘ল্যান্ডস্কেপ’।
টলস্টয়ের আনা কারেনিনা-র উদাহরণ দিয়েছেন পামুক। বিবাহিতা আনা মস্কোতে সেনাবাহিনির ক্যাপ্টেন ব্রনস্কির সঙ্গে নেচেছে। এ বার ট্রেনে চেপে ফিরে যাচ্ছে বাড়িতে। ট্রেন সজোরে ছুটছে, আনা হাতে-ধরা উপন্যাসে মন দেওয়ার চেষ্টা করে, পারে না। বাইরে তুষারপাত, কাচের জানলায় বরফ। এটাই চরিত্রের চোখ দিয়ে ল্যান্ডস্কেপ তৈরি। কুড়ি বছরের বড় কারেনিনের সঙ্গে বিয়েতে আনা অসুখী, সুপুরুষ ব্রনস্কিকে সে ভুলতে পারে না। সেই মানসিক ছটফটানি থেকেই উপন্যাসে মন বসাতে পারে না সে, চোখ পিছলে যায়। বাইরের তুষারঝড় তার মনেরই প্রতিচ্ছবি!
বইয়ের শেষ অধ্যায়টি মারাত্মক! তার নাম কেন্দ্র। পামুকের মতে, উপন্যাসের সঙ্গে কবিতা বা মহাকাব্যের তফাত এক জায়গায়। উপন্যাসে একটা কেন্দ্র থাকে। ‘কোনও অনিশ্চিত উৎস থেকে ঠিকরে-আসা আলো, সেই আলোয় উপন্যাসের প্রতিটি গাছ, লতাপাতাকে চেনা যায়, মাথায় হঠাৎ একটা নতুন চেতনা ঝিলিক দিয়ে যায়। কিন্তু আলোর উৎস দেখা যায় না। উপন্যাস লেখা মানে এই কেন্দ্রকে চরিত্র, প্লট ইত্যাদির আড়ালে রেখে দেওয়া। কোনও উপন্যাসে পাঠক যদি সরাসরি ধরতে পারেন এটাই কেন্দ্র, সেটি বাজে উপন্যাস। কেন্দ্র আসলে সোনার হরিণের মতো’, জানাচ্ছেন পামুক। কেন কেন্দ্রকে ধরা যায় না? ‘আসলে কেন্দ্র তো একটা নয়, অনেক। কিংবা কে জানে, কেন্দ্র বলেই হয়তো কিছু নেই,’ এ ভাবেই নিজের কেন্দ্রাতিগ বয়ান তছনছ করে দেন পামুক।
বইটির গুরুত্ব এখানেই। কে না জানে, আধুনিক জীবনে নিশ্চিত কোনও কেন্দ্র, থুড়ি, ‘জীবনদেবতা’ নেই! |
|
|
|
|
|