|
|
|
|
|
|
|
পুস্তক পরিচয় ১... |
|
বিশ্বায়নের আড়ালে অন্য ইতিহাস |
সুপ্রিয়া চৌধুরী |
দ্য রিভার অব স্মোক, অমিতাভ ঘোষ। হেমিশ হ্যামিল্টন, ৬৯৯.০০ |
ঐতিহাসিক উপন্যাস’ শীর্ষক প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, ইতিহাসের বিশেষ সত্য ও সাহিত্যের নিত্য সত্যকে সমান ভাবে রক্ষা করা সাহিত্যকারের পক্ষে অত্যন্ত কঠিন কাজ। এমনকী ইউরোপীয় কথাসাহিত্যে ঐতিহাসিক উপন্যাসের প্রধান প্রবর্তক যিনি, সেই স্কটের রচনাতেও ইতিহাসের বিকার ঘটেছে, যদিও তা সাহিত্যরসে পরিপূর্ণ। স্কট ছিলেন অমিতাভ ঘোষের ছেলেবেলার সঙ্গী, কিন্তু ইতিহাসের প্রতি আনুগত্য অমিতাভ-র মজ্জাগত। তাঁর প্রত্যেকটি উপন্যাসে তিনি কালের ও স্থানের পটভূমিকা সযত্নে চিহ্নিত করেছেন। লক্ষণীয়, ক্রমশ তাঁর নজর গিয়ে পড়েছে ভারতের পূর্ব সীমান্তের দিকে পুব থেকে আরও পুবে যেন আমাদের নিয়ে যেতে চান তিনি। দুই পারের বাংলা, বর্মা, মালয়, চিন সুদূরপ্রসারিত এই ভ্রমণকাহিনি আমাদের নিয়ে চলেছে বর্তমান থেকে অতীতে, দেশভাগ থেকে কোম্পানি-শাসনের যুগে। যে-সব ভারতীয় লেখক ইংরেজিতে সাহিত্য রচনা করেন, তাঁদের মধ্যে আর এক জনকেও পাওয়া যাবে না যিনি অমিতাভ-র মতো, কেবল পশ্চিম নয়, পুবের দিকেও তাকিয়েছেন, এবং সেই দৃষ্টি দিয়ে তুলে ধরেছেন বিস্তারিত একটি ‘আঞ্চলিক’ ইতিহাস, যা প্রধানত বঙ্গোপসাগর ও ভারত মহাসাগরের ইতিহাস।
অমিতাভ-র সাম্প্রতিকতম উপন্যাস রিভার অব স্মোক, তাঁর পরিকল্পিত বিরাট কথা-কাণ্ড ‘আইবিস ট্রিলজি’-র দ্বিতীয় খণ্ড। যে সব চরিত্রগুলিকে তিনি সি অব পপিজ-এর শেষে মাঝসমুদ্র পরিত্যাগ করেছিলেন, তাদের তিনি এ বারে ডাঙ্গায় এনে ফেলবেন, এমন আশা পাঠকের মনে জাগতেই পারে। কয়েকটি চরিত্রের ক্ষেত্রে অমিতাভ তাই করেছেন, কিন্তু অন্যেরা এখনও নিখোঁজ। বরং এই গল্পের কেন্দ্রস্থল দখল করেছে আরও কিছু চরিত্র, যারা আগের উপন্যাসে ছিল প্রান্তিক, উপেক্ষিত। কাহিনির পটভূমিকাও সরে গেছে ‘আইবিস’ জাহাজ থেকে চিনের পার্ল নদী ও তার পারে অবস্থিত ক্যান্টন শহরে। যে যাত্রাপথ ধরে আমরা সেখানে পৌঁছই, সেটি প্রধানত একটি পণ্যদ্রব্যের। কোম্পানির আমলে উত্তর ও মধ্য ভারত হয়ে উঠেছিল আফিম চাষের কেন্দ্রভূমি। সেই মারাত্মক, নিষ্ঠুর পরিবেশ ছেড়ে পালাতে চেয়েছিল দীতি ও কালুয়া। দীতিকে আমরা এই উপন্যাসের গোড়ায় দেখতে পাই, কালুয়ার খবর নেই। কিন্তু গাজিয়াবাদের কারখানায় মোড়ক-বাঁধাই করা আফিমের গুলি জলপথে চলে এসেছে চিনের উপকূলে, যেখানে শ’য়ে শ’য়ে ব্রিটিশ, মার্কিন ও ভারতীয় বণিক তা দেশের অভ্যন্তরে পাচার করতে উদ্যোগী। বিরাট এক ভাসমান নগরী গড়ে উঠেছে পার্ল নদীর বুকে। আফিমবাহী জাহাজগুলি অপেক্ষা করছে খানিক দূরে, সমুদ্রে। ডাঙায় রয়েছে বিদেশি বণিকদের বাণিজ্যকুঠি বা হং। আফিমের ধোঁয়ায় আচ্ছাদিত পার্ল নদী বস্তুতই ‘রিভার অব স্মোক’।
ঊনবিংশ শতাব্দীতে ব্রিটিশ সাম্রাজ্য চিন থেকে রুপো, রেশম ও চিনেমাটি আমদানি করার তাগিদে এমন একটি পণ্যদ্রব্য খুঁজেছিলেন, যা সহজে এবং প্রচুর পরিমাণে, সে দেশে রফতানি করা যায়। আফিমের কারবারের সূত্রপাত সেই থেকে। উত্তর ও মধ্য ভারতের উর্বর চাষের জমিতে খাদ্যোৎপাদন ছেড়ে আফিম-চাষ শুরু হল। সেই আফিমের ব্যবসায় বড়লোক হয়ে উঠল কলকাতা ও মুম্বই শহরের বণিক সম্প্রদায়। রিভার অব স্মোক-কে কেন্দ্র করে যে আলোচনাচক্র আমাদের এই শহরে ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল হল-এ অনুষ্ঠিত হয়েছিল, তাতে অমিতাভ বলেছিলেন, ‘ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল’-এর নাম হওয়া উচিত ‘ওপিয়াম মেমোরিয়াল’। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের ধন-দৌলত ও ভারতীয় কোম্প্রাদোর গোষ্ঠীর বেড়ে ওঠার পিছনে রয়েছে এই এক বাণিজ্যিক ইতিহাস, যার সুদূর-প্রসারিত প্রতিফলন আমরা দেখতে পাই ঊনবিংশ ও বিংশ শতাব্দীর রাজনৈতিক ও সামাজিক ক্ষেত্রে। এই ইতিহাস সে ভাবে লেখা হয়নি, আমরাও স্কুলে-কলেজে তা পাঠ করি না। এই বিস্মৃতপ্রায় ইতিহাসকে তুলে ধরা এবং সেই সঙ্গে ছোট-বড় মানুষের ভালবাসা, প্রেম, যন্ত্রণা, দুঃখকে কেন্দ্র করে সাহিত্য-সৃষ্টি করা, এই হল অমিতাভ-র সাম্প্রতিক রচনাটির মহৎ উদ্দেশ্য। এই লক্ষ্যে তিনি অবশ্যই পৌঁছতে পেরেছেন।
সি অব পপিজ-এর তুলনায় রিভার অব স্মোক-কে অনেক বেশি সুখপাঠ্য মনে হয়। নানা ভাষার সংমিশ্রণ এই উপন্যাসেও আছে, তবে হয়তো আমরা তাতে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছি, বা সত্যিই এই বইয়ের ভাষা আরও সহজবোধ্য। ফলত আমরা পুরোপুরি মনোনিবেশ করতে পারি বেণী-বাঁধা তিন-চারটে কাহিনির বিন্যাসে। চরিত্রবহুল ও ঘটনাবহুল এই উপন্যাসের মুখ্য চরিত্র বোধ হয় পার্সি বণিক বহরাম মোদি। আফিমের কারবার তাঁকে নিয়ে আসে ভারতের পশ্চিম প্রান্ত থেকে চিনের উপকূলে। পথে নির্বাসিত নেপোলিয়ানের সঙ্গে তাঁর সাক্ষাৎ হয় সেন্ট হেলেনায়, এবং নেপোলিয়ানের উক্তি ‘when China wakes, the world will tremble’ একটু আলাদা ভাবে শোনেন তাঁর মুখে। আফিম-ই হয়তো ঘুমন্ত চিনকে জাগিয়ে তুলবে, এই ভেবে প্রাক্তন সম্রাট কৌতুক বোধ করেন। মাদকাশক্তির ভয়াবহ প্রতিক্রিয়া বুঝতে পেরে চিনের সম্রাট চেষ্টা করেছিলেন আফিম কারবার বন্ধ করতে এবং ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বণিকদের ক্যান্টন শহর থেকে তাড়াতে। ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রচলিত বুলি ‘ফ্রি ট্রেড’, অ্যাডাম স্মিথ যে অর্থনৈতিক ভাবাদর্শের প্রবক্তা, সেই ভাবাদর্শের সমর্থনে ব্রিটিশ সাম্রাজ্য চিনকে যুদ্ধে পরাস্ত করে, এবং আফিমের অপকারিতা জেনেও গোটা দেশে মাদকাশক্তি ছড়িয়ে দেয়।
রিভার অব স্মোক-এ আমরা পাই এই ইতিহাসের গোড়ার ভাগ। সেই অংশে ক্যান্টন শহর ও পার্ল নদী উভয়ই সমান উজ্জ্বল। সেই দৃশ্যগুলি তুলে ধরেছেন এক প্রবাসী শিল্পী, কোম্পানি-চিত্রকর জর্জ চিনেরি-র পুত্র রবিন। চিত্রকরের চোখ দিয়ে সে দেখছে সেই ভাসমান নগরী, বিদেশি বণিক সম্প্রদায় ও তাদের বাণিজ্যকুঠি। শিল্প নিয়েও বাণিজ্য চলে, যেমন চলে উদ্ভিদবিদ্যা ও উদ্ভিদ-সংগ্রহের কাজ নিয়ে। ঊনবিংশ শতাব্দীর রাজনীতি, সমাজনীতি, বিজ্ঞান, শিল্প, চিত্রকলা সবই কী ভাবে বাণিজ্যাধীন হয়ে পড়ে, সেই ইতিহাসই হয়তো এই বইয়ের প্রধান বিষয়। মানুষও পণ্যদ্রব্য হতে পারে, দীতি-কালুয়ার মতো চুক্তিবদ্ধ শ্রমিকদের যেমন ভারত থেকে নিয়ে যাওয়া হত ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের দূর প্রান্তে। এক আশ্চর্য ও সফল উপন্যাসে অমিতাভ ঘোষ আমাদের মনে করিয়ে দিয়েছেন যে, একবিংশ শতাব্দীর বিশ্বায়ন ও পণ্যায়নের আড়ালে লুকিয়ে আছে দুশো বছরের বাণিজ্যনীতির ইতিহাস। |
|
|
|
|
|