|
|
|
|
|
|
|
মুখোমুখি... |
|
সঙ্গীত পরিচালকেরা আমাকে আজকাল ডাকেন না |
অথচ ব্রিটনি স্পিয়ার্স, জারমেইন জ্যাকসনদের সঙ্গে গান গাইছেন। তবু বলিউডে ভাল গান গাইতে না পারার দুঃখ
তাঁকে কুরে কুরে খায়। বহু দিন পর মুখ খুললেন সোনু নিগম। মুম্বইয়ে তাঁর রিয়্যালিটি শোয়ের সেটে। মুখোমুখি ইন্দ্রনীল রায় |
বিগত কয়েক সপ্তাহ ধরে সারা পৃথিবী ঘুরে বেরিয়েছেন তিনি।
আর তার ফলেই ঘুমের সময় ওলটপালট। প্রচণ্ড জেটল্যাগ। ‘এক্স ফ্যাক্টর’ রিয়্যালিটি শো-এর বাকি দুই সহ-বিচারক সঞ্জয় লীলা বনশালি এবং শ্রেয়া ঘোষালের অভিযোগ, তিনি তাঁদের দু’জনকেও সময় দিতে পারছেন না। প্রচণ্ড সর্দি আর জেটল্যাগে ভুগতে ভুগতে আনন্দবাজারকে ইন্টারভিউ দেওয়ার সময়টুকু বের করলেন কী ভাবে, তার কারণটা নিজেই বললেন, “আপনারা হলেন গিয়ে আমার বৌয়ের দেশের লোক। কী করে না বলি বলুন?”
সাম্প্রতিক কালে প্রচার মাধ্যমে বিরল সোনু নিগম সাক্ষাৎকার দিলেন: |
|
পত্রিকা: আনন্দবাজারে আপনার শেষ সাক্ষাৎকার বেরিয়েছিল বছর পাঁচেক আগে। এমনকী শাহরুখ খান, অমিতাভ বচ্চনের মতো সুপারস্টারের কাছে পৌঁছনোও আপনাকে পাওয়ার চাইতে সহজ। ঠিক কী কারণে সোনু নিগম এই ভাবে নিজেকে নির্বাসিত করেছেন, জানা সম্ভব কি?
সোনু: নিজের ইচ্ছায় সোনু নিগম নির্বাসিত হয়নি এটা বলতে পারি। আসলে বলিউডে যে অনেক কাজ করছি তাও তো নয়। করছি না যে তারও একটা কারণ আছে। এখানে আর সেই ধরনের বড় মাপের কাজ হচ্ছে না আজকাল। এমন অবস্থায় সঙ্গীত পরিচালকদের কাছে গিয়ে ‘কাজ দাও’ বলে ভিক্ষে চাইতে পারব না।
এ ভাবেই বেশ আছি আমি। যেহেতু নিয়মিত তেমন কাজ করছি না, তাই প্রচারের আলোয় থাকারও দরকার আছে বলে মনে করি না। সেই কারণেই ‘জাস্ট’ নিজেকে সরিয়ে নিয়েছি।
পত্রিকা: আশ্চর্য লাগে ভাবতে। “আমি সঙ্গীত পরিচালকদের কাছে গিয়ে কাজ ভিক্ষে চাইতে পারি না।” এমন কথা যখন বলেন সত্যি বলেন কি?
সোনু: হ্যা। একদম সত্যি কথা বলছি। বেশির ভাগ সঙ্গীত পরিচালকই আমাকে কাজে
ডাকেন না।
খুব যে উঁচু গুণমানের কাজের কথা বলছি, তাও না। সাধারণ কাজের কথাই বলছি। সে রকমটাও পাই না...
পত্রিকা: কী বলছেন আপনি? যে সোনু নিগম আজও তর্কাতীত ভাবে ভারতের এক নম্বর গায়ক, তাঁর কাছে সুরকারেরা আসছেন না... এটা বিশ্বাস করতে হবে?
সোনু: হ্যা। আমাকে কেউ কাজ করতে ডাকে না। আর সোনু নিগমই বা কেন? শানের ব্যাপারটাই দেখুন না! শানও আজকাল তেমন ভাল গান গাওয়ার সুযোগ পায় না। কেকে-কে দেখুন, উদিতকে দেখুন। বাবুলকে দেখুন। কুণাল গাঞ্জাওয়ালা বা অভিজিৎকেও দেখুন আমাদের কারও কাছেই তেমন ভাল গান নেই।
পত্রিকা: ঠিক কেন এটা ঘটছে?
সোনু: কারণটা আর কিছুই নয়, সঙ্গীত পরিচালকেরা আজকাল নিজেরাই গান গাইছেন। সে কারণে স্টেজ শোগুলো পাচ্ছেন তাঁরা। আর তাতে প্রত্যেক দিন লক্ষ টাকা করে কামাচ্ছেন। এর পর কেনই বা তাঁরা কণ্ঠশিল্পীদের গান দিয়ে নিজেদের রোজগারটা বন্ধ করবেন বলুন তো? মোট কথা, তাঁদের কাছে আজকাল সঙ্গীতশিল্পীদের কোনও গুরুত্ব আছে বলে মনে হয় না।
পত্রিকা: আপনি কি হিমেশ রেশমিয়ার মতো সঙ্গীত পরিচালকের কথা বলছেন?
সোনু: শুধু তিনি নন, আরও অনেকেই আছেন। কারও নাম করে কিছু বলতে চাই না। লোগ সমঝ জায়েঙ্গে কিসকে বারে মে বাত কর রহা হু। বেশির ভাগ সঙ্গীত পরিচালকই নিজেরা গান গাইছেন।
|
পত্রিকা: আপনি কি শঙ্কর-এহসান-লয়ের শঙ্করকে ইঙ্গিত করছেন?
সোনু: দেখুন, শঙ্করের গান গাওয়া নিয়ে আমার কোনও সমস্যা নেই। উনি তো তা-ও এক জন প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ধ্রুপদী গায়ক। এবং ওঁর গান শুনতে খুবই ভাল লাগে। বলিউডে আরও অনেকেই আছেন, যাঁদের গলা তেমন ভাল নয়, তা সত্ত্বেও নিজেরাই সুর দিচ্ছেন, নিজেরাই গাইছেন। শান্তনু মৈত্রের মতো সুরকাররা, যাঁদের গান গাওয়ার উচ্চাকাঙ্ক্ষা নেই, তাঁরাই আমাকে কাজ দেন। দেন বলেই ‘থ্রি ইডিয়টস’-এর মতো ছবিতে গান গাইতে পারি।
(‘এক্স ফ্যাক্টর’ রিয়্যালিটি শো-এ তাঁর সহ-বিচারক শ্রেয়া ঘোষালের দিকে মুখ ফিরিয়ে) আমি শ্রেয়াকেও বলি, যদি কোনও মহিলা সুরকার থাকত, শ্রেয়া আর সুনিধির মতো গায়িকারাও অ্যাদ্দিনে বেকার হয়ে যেত। এক কথায় বললে, সঙ্গীত পরিচালকদের কাছে স্টেজ শো-র লোভটা আজকাল সাঙ্ঘাতিক হয়ে দাঁড়িয়েছে।
পত্রিকা: আচ্ছা কোনও সঙ্গীত পরিচালকের সঙ্গে এই ব্যাপারটা নিয়ে আলোচনা করেছেন?
সোনু: সত্যি কথা বলতে কী, করি না। এই সব পরিস্থিতি আলোচনা করে বদলাবার মতো নয়।
পত্রিকা: একটা কথা বলুন, আজকাল যে সব শিল্পী গান গাইছেন, তাঁদের গান আপনার ভাল লাগে?
সোনু: জানিই না কোন গান কোন শিল্পীকে দিয়ে গাওয়ানো হয়েছে। বছর পনেরো আগেও বোঝা যেত কোনটা অভিজিৎদার গলা আর কোনটা শানদার গলা। উদিতজির গলার সঙ্গে আমার গলার স্বরের তফাতটা আপনারা ধরতে পারতেন। আর আজকাল? যে কোনও সাধারণ মানুষকে গিয়ে জিজ্ঞাসা করুন, সুপারহিট গানও কোন শিল্পী গেয়েছে কেউ জানে না। কী ‘প্যাথেটিক’...
পত্রিকা: কিন্তু এই যে আপনি বছরে এক বার কী দু’বার গান করেন, এতে তো আপনার অনুরাগীরা হতাশ হয়ে পড়ছেন?
সোনু: ফ্যানেদের কথা ভেবে মন খারাপ হয় খুব। এ-ও জানি, ওদেরকে হতাশ করছি। প্রথম প্রথম যখন কাজ আসা বন্ধ হল, খুব বিষণ্ণতায় ভুগতাম। এখন কারণটা বুঝতে পেরে সেই অবসাদ অনেকটা কেটেছে। গত এক বছর ধরেই যে এ রকমটা হচ্ছে তা তো নয়। গত পাঁচ বছর হল কাজ পাচ্ছি না। এমনকী এখনও যখন কোনও সঙ্গীত পরিচালক আমাকে কাজ দিতে আসেন, তখন ধরে নিতে হবে, তাঁরা এর আগে কম পক্ষে দশ জনকে দিয়ে গাওয়াতে চেষ্টা করিয়ে ব্যর্থ হয়ে শেষমেশ আমার কাছে এসেছেন। মানে আমি হলাম গিয়ে একাদশ গায়ক।
পত্রিকা: আপনার কথায় কেমন একটা তিক্ততা ঝরছে....
সোনু: না, তিক্ততা নয়, হতাশ লাগে। সঙ্গীতের জগতে যেটা ঘটছে তা ভেবে খুব মন খারাপ লাগে আজকাল। সত্যি খুব খারাপ লাগে। (মুখে গম্ভীর ভাব)
পত্রিকা: বুঝতে পারছি আপনার মনের অবস্থা...
সোনু: ... আর খারাপ লাগার থেকেও বেশি যেটা মনে হয়, সঙ্গীতকে পুরোপুরি নতুন ভাবে জাগিয়ে তুলতে হবে। আজকাল বড় বেশি বলিউডি সিনেমায় গানের ছড়াছড়ি। অন্য গান হচ্ছে কই? মনেই করতে পারি না, শেষ কবে একটা ভাল গজল বা ভজন শুনেছি। মনে করতে পারি না, শেষ কবে হিন্দি ছবিতে একটা ভাল ‘স্যাড সং’ শুনেছি। সে সব জিনিস যেন হারিয়ে গেছে। ইদানীং বেশির ভাগ গান হল আইটেম নম্বরের মতো। সিনেমার প্রোমো। এ সব গানের আয়ু এক মাস। তিন মাস বাদে কেউ সে সব গানের এক কলি সুর মনে রাখা তো দূরের কথা, একটা শব্দও মনে রাখে না। এটা খুব দুঃখের ব্যাপার।
পত্রিকা: তা হলে কী করা যায়?
সোনু: অপেক্ষা করতে হবে। ধৈর্য ধরতে হবে। মনেপ্রাণে বিশ্বাস করি, পরিস্থিতি বদলাবে। আপনাদের বাংলার শিল্পী বিক্রম ঘোষের সঙ্গে একটা কাজ করছি। এই ধরনের প্রাইভেট অ্যালবামের কাজ শিল্পীসত্তাটাকে জাগিয়ে রাখে।
পত্রিকা: অনেকেই হয়তো জানেন না, লস অ্যাঞ্জেলেসের সানসেট বুলেভার্ডে আপনি একটা ফ্ল্যাট কিনেছেন। এবং সেখানে অনেকটা সময় কাটান।
সোনু: কী করে জানলেন?
পত্রিকা: আপনার ওখানকার বাঙালি বন্ধুরা, যাঁদের সঙ্গে নিয়মিত মেলামেশা করেন, তাঁরাই বলেছেন।
সোনু: (বিস্মিত) হ্যাঁ, ওখানে একটা অ্যাপার্টমেন্ট কিনেছি বটে। থাকতেও বেশ ভাল লাগে।
|
পত্রিকা: লস অ্যাঞ্জেলেসে থাকা মানে একটা প্রশ্নই ওঠে আপনি কি হলিউডে কাজ করার কথা ভাবছেন?
সোনু: না না, তা নয়। আসলে ওই শহরটা বেশ লাগে আমার। হলিউডে কাজ করার কোনও পরিকল্পনা বা ইচ্ছেই আমার নেই। স্থায়ী ভাবে ওই শহরে বসবাসের কথা ভাবনাতেই আসে না, কারণ ইদানীং মায়ের শরীরও খুব ভাল যাচ্ছে না।
পত্রিকা: কিন্তু টরন্টোয় আইফা অ্যাওয়ার্ডসে জারমেইন জ্যাকসনের সঙ্গে পারফর্ম করলেন, ব্রিটনি স্পিয়ার্সের সঙ্গে নতুন অ্যালবাম করলেন...
সোনু: অনেক দিন লস অ্যাঞ্জেলেসে থাকার দরুন আমার কিছু বন্ধুবান্ধব হয়েছে। তারাই ব্রিটনি আর জারমেইনের সঙ্গে আমার যোগাযোগ করিয়ে দেয়। ওদের সঙ্গে দেখা করে আমার কখনওই মনে হয়নি, ওরা অত বড় মাপের পপস্টার। একদম আমার আপনার মতো মানুষ। ওদেরও আমার গায়কি ভাল লেগে যায়। সেই থেকেই এই কাজগুলোর শুরু।
পত্রিকা: ভারতীয় সিনেমায় রিয়্যালিটি শো-এর ধস নামার প্রসঙ্গেই তা হলে ফিরে আসি। এখন আপনি সোনিতে ‘এক্স ফ্যাক্টর’ সঞ্চালনা করছেন। এর আগে ‘ইন্ডিয়ান আইডল’-এ বিচারক ছিলেন। কিন্তু যে সব গায়ক প্রতিযোগিতায় জেতে তাদের শেষ পর্যন্ত কী হয়? খুব ধীরে ধীরে বিস্মৃতির অতলে হারিয়ে যায়। এত রিয়্যালিটি শো-র জন্য কি কোয়ালিটি সাফার করে না? সোনু: সব সময়ে ঠিক তা নয়। সুনিধি চহ্বাণ, শ্রেয়া ঘোষালের মতো বেশ কয়েক জন শিল্পী আছেন, যাঁরা রিয়্যালিটি শো থেকে উঠে কাজের জগতে নাম করেছেন। আসলে সাফল্যের অনেকটাই নির্ভর করে সাফল্যের খিদে কতটা তার ওপর। আমি যখন শুরু করেছি, তখন ‘এক্স ফ্যাক্টর’ বা ‘ইন্ডিয়ান আইডল’-এর মতো রিয়্যালিটি শো থাকলে কী ভালই না হত...
পত্রিকা: কেন? সোনু: তা হলে আমাকে সঙ্গীত পরিচালকদের অফিসের বাইরে ছ’ থেকে আট ঘণ্টা লাইন দিতে হত না। আজকালকার শিল্পীরা এই সব রিয়্যালিটি শো-এর মাধ্যমে কত বড় প্ল্যাটফর্ম পেয়ে যাচ্ছে। আমাদের সময়ে তো এত সুবিধে ছিল না। এক জন সঙ্গীত পরিচালককে গলাটুকু শোনাতেই বছর তিনেক লেগে যেত। এতটাই কঠিন ছিল পুরো ব্যাপারটা।
পত্রিকা: আচ্ছা এটা কি মনে হয় না, ওই প্রতীক্ষা, ওই সংগ্রামের ফলেই আপনি আজ এই মাপের গায়ক হয়েছেন? আজকাল রিয়্যালিটি শো-এর গায়ক-গায়িকাদের সামনে এত বেশি কাজের পথ খোলা যে, তারা সে সব সুযোগসুবিধের মূল্য বুঝতে পারে না। সোনু: হতে পারে। হতে পারে সেটা। কিন্তু যখনই এই ধরনের রিয়্যালিটি শো-এর শিল্পীদের সঙ্গে আমার দেখা হয়, তাদের বলে থাকি, কেবল দু’জনকে মনে কোরো। লতা মঙ্গেশকর আর আশা ভোঁসলে। এই দুই গায়িকার কেরিয়ার যখন একেবারে তুঙ্গে তখনও রেওয়াজ করা বাদ দেননি। এই দুই শিল্পীকে প্রত্যেক দিন অজস্র গান গাইতে হত। এবং প্রত্যেক দিন প্রতিটা গানই গাইতেন তাঁরা একশোর মধ্যে একশো ভাগ নিষ্ঠা নিয়ে। এতটাই গভীর ছিল তাঁদের ‘কমিটমেন্ট’।
একটা দিনের জন্য তাঁরা লক্ষ্যচ্যুত হননি। রোজকার রেওয়াজ করার ব্যাপারেও অন্যমনস্ক হননি কখনও। বড় শিল্পী হতে হলে এই সব মানুষকে আদর্শ মনে কোরো। ওঁরাই আমার গুরু। লতাজি..আশাজি....মান্না দে।
পত্রিকা: তা হলে তো আপনার বাচ্চার জন্মদিনে লতা মঙ্গেশকর, আশা ভোঁসলের আসাটা আপনার কাছে বিরাট প্রাপ্তি... সোনু: একেবারে ঠিক। আমার প্রতি এটা তাঁদের আশীর্বাদ। এটাই সব চেয়ে বড় পাওয়া। এই পাওয়াটাই সারা জীবনের কামাই। আজকালকার সঙ্গীত পরিচালকেরা আমাকে কাজ না দিতে পারেন, কিন্তু আমার কাছ থেকে লতাজি বা আশাজির আশীর্বাদ তো কেড়ে নিতে পারবেন না। |
|
|
|
|
|