সিনেমা সমালোচনা...

জীবনকে জিতিয়ে জাদু-স্কুলে এ বার নতুন প্রজন্ম

ক্ষমা করবেন সম্পাদক-স্যার! আপনার নির্দেশে ‘ডেথলি হ্যালোজ’-এর দ্বিতীয় পর্ব দেখতে গিয়েছিলাম ঠিকই। কিন্তু বেরিয়ে এসে মনে হল, এই ছবির রিভিউ লেখা সম্ভব নয়। শেষ দৃশ্যের পর আলো জ্বলে-ওঠা মাল্টিপ্লেক্স, পায়ে পায়ে ভিড় ঠেলে কাউন্টারে ‘থ্রি ডি চশমা’ জমা দেওয়া, সবই করেছি, জানেন? কিন্তু কেমন যেন যন্ত্রের মতো! তত ক্ষণে এক বিষণ্ণ অবসাদ আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরেছে, ভিড়ের মধ্যেও কেমন যেন ফাঁকা ফাঁকা লাগছে। যুগ শেষ হয়ে গেলে কি এমনই হয়?
জানি, পেশাদার সাংবাদিককে ‘সাবজেক্ট’-এর থেকে দূরত্ব বজায় রাখতে হয়। কিন্তু আমরা যারা হ্যারি পটার পড়তে পড়তে শিশু থেকে কিশোর হয়েছি, কিশোর থেকে তরুণ হয়েছি, কেউ বা তারুণ্য ছেড়ে মধ্যবয়সে পৌঁছেছি...তাদের পক্ষে আজ সব প্যাশন ছিঁড়েখুঁড়ে শুধুই নিরাপদ দূরত্ব রাখা সম্ভব? বই হিসেবে ‘ডেথলি হ্যালোজ’ প্রকাশিত হয়েছিল চার বছর আগে। কিন্তু তখনও একটা আশ্বাস ছিল। সিনেমাটা তো হবে! আজ ছবি শেষের পর সেই গোপন আশ্বাসও চৌপাট! হ্যারি, রন আর হারমিওনেরা আমাদের মতো জাদুহীন মাগ্লদের দুনিয়ায় আর আসবে না!

হ্যারি পটার অ্যান্ড দ্য ডেথলি হ্যালোজ-২
ড্যানিয়েল র্যাডক্লিফ, রুপার্ট গ্রিন্ট, এম্মা ওয়াটসন

কিন্তু রোওলিং বোধহয় রবীন্দ্রনাথের মতোই বিশ্বাস করেন, ‘শেষ হয়েও হইল না শেষ!’ ফলে বইয়ের মতো ছবিটাও শেষ হয় ভোল্ডেমর্টের সঙ্গে হ্যারিদের যুদ্ধের ১৯ বছর পরে। কিংস ক্রস স্টেশনের ৯৩/৪ প্ল্যাটফর্মে হ্যারি আর জিনি তাদের ছেলেকে হগওয়ার্টস এক্সপ্রেসে তুলে দিতে এসেছে। এসেছে আর এক দম্পতি। রন আর হারমিওনে। তাদের মেয়েও ওই ট্রেনেই জাদু-স্কুলে যাবে। গত যুগের কাহিনি শেষ, জাদু-পৃথিবীতে এ বার নতুন প্রজন্ম।
হ্যারি আর জিনির পুত্র এ বার বাবার কানের কাছে চিন্তিত মুখ নিয়ে আসে। “বাবা, আমাকে যদি ‘স্লিথেরিন’ হাউসে যেতে হয়?”
কে না জানে, হগওয়ার্টস স্কুলে স্লিথেরিন হল শয়তানদের দল! ভোল্ডেমর্ট স্কুলজীবনে ওই দলেই ছিল। কিন্তু হ্যারি ছেলেকে আস্তে আস্তে বলে, “তোমার নাম অ্যালাবাস সেভেরাস পটার। হগওয়ার্টসের দুই সেরা প্রধান শিক্ষকের নাম সেখানে জড়িয়ে। আর তাঁদের মধ্যে এক জন স্লিথেরিন ছিলেন।” ইঙ্গিতটা অত্যাচারী শিক্ষক সেভেরাস স্নেপের দিকে। মনে পড়ল, আগের সিনেমাগুলিতে উত্তেজিত হ্যারি বহু বার প্রধান শিক্ষককে জানাতে এসেছে, “স্নেপ কিন্তু...,” আর ডাম্বলডোর ঠান্ডা গলায় হ্যারিকে থামিয়ে দিতেন, “স্নেপ নয় হ্যারি। প্রফেসর স্নেপ।”
দর্শকাসনে বসে গলার কাছে দমটা তাই হঠাৎ আটকে গেল। স্কুলে আমরাও প্রতি মুহূর্তে ‘অত্যাচারী শিক্ষক’ ভেবে যাঁদের মুণ্ডপাত করেছি, বড় হয়ে তাঁদেরই কারও কারও কথা ভেবে শ্রদ্ধায় মাথা নিচু হয়ে এসেছে। তাই না?
জানি, হগওয়ার্টস স্কুলে এর পর এই শিশুদের মাথায় নেমে আসবে ভুতুড়ে টুপি বা ‘সর্টিং হ্যাট’। সে-ই বলে দেবে, কে যাবে ভাল ছেলেমেয়েদের ‘গ্রিফিনডোর’ হাউসে, কে-ই বা হবে ‘স্লিথেরিন’। কিন্তু পুত্রের কানে মোক্ষম মন্ত্রটা শিখিয়ে দেয় হ্যারি, “তুমি যা হতে চাইবে, সর্টিং হ্যাট তোমাকে সেই দলেই নেবে।” সাধে সমাজতাত্ত্বিক অ্যান্ড্রু ব্লেক তাঁর ‘দ্য ইররেজিস্টিবল রাইজ অব হ্যারি পটার’ বইয়ে দেখিয়েছিলেন, হ্যারি পটার আসলে আধুনিক মানুষের বেছে নেওয়া বা ‘চয়েস’-এর স্বাধীনতার গল্প। আমি দুঃখ পাব, তবু গ্রিফিনডোরেই যাব, এটি রেনেসাঁর চেতনা। তবু আধুনিক মানুষের মনে মাঝে মাঝে ভোল্ডেমর্ট ঢুকে পড়ে, কেন না বাসনার তৃষ্ণা। আধুনিক মনে দু’টি সত্তাই পাশাপাশি থাকে।
কী এসে যায় এত তত্ত্বকথায়? ডেভিড ইয়েটস-এর এই ছবি শুরু থেকেই অন্ধকার এক দুনিয়াকে ধরতে চায়। ডোবি নামের আজব ভূতটি মারা গিয়েছে। হ্যারি, রন আর হারমিওনেকে এ বার বাকি ‘হরক্রাক্স’গুলি খুঁজতে হবে। লকেট, কাপ ইত্যাদি সাতটি বিচিত্র বস্তুতে ভোল্ডেমর্ট সাত ভাগে লুকিয়ে রেখেছে তার প্রাণ, সেগুলিই হরক্রাক্স!
আর ‘ডেথলি হ্যালোজ’? তিনটে জিনিস। প্রথমটা ‘এল্ডারলি ওয়ান্ড’ নামে এক জাদুদণ্ড। দ্বিতীয়টি অদৃশ্য এক আচ্ছাদন, গায়ে থাকলে কেউ খুঁজে পাবে না। তৃতীয়টি বিশেষ এক পাথর বা ‘রেজারেকশন স্টোন’। তা মৃতদের ফিরিয়ে আনে। তিনটি জিনিসের মধ্যে নিরুচ্চার এক খ্রিস্টীয় উপমা রেখে দিয়েছিলেন রোওলিং। ডেভিড ইয়েটসের ছবি তাকে পরতে পরতে ধরেছে। ভোল্ডেমর্টের সঙ্গে হ্যারির প্রথম সংঘাত ঘটে যাওয়ার পর চার দিক সাদা আলোয় ভরা। সন্তের মতো এগিয়ে আসেন প্রয়াত প্রধান শিক্ষক ডাম্বলডোর। হ্যারি বুঝতে পারে না, সে কোথায়? কিংস ক্রস স্টেশনে? আর ডাম্বলডোর তখনই বলেন, “মৃতদের জন্য দুঃখ কোরো না হ্যারি। যারা বেঁচে থাকল, তাদের কথা ভাবো।”
হ্যারি পটারের শেষ পর্বের তাৎপর্য এখানেই। ভোল্ডেমর্টের সঙ্গে শেষ সংঘাতের জন্য ‘নিষিদ্ধ অরণ্য’ বা ‘ফরবিডন ফরেস্ট’-এ চলেছে হ্যারি। প্রথম পর্বে এই অরণ্যেই শরীর ফিরে পেতে চেষ্টা করেছিল ভোল্ডেমর্ট, শেষ পর্বের ক্লাইম্যাক্সও সেখানেই! ‘রেজারেকশন স্টোন’ হাতে নেয় হ্যারি। তার সামনে তখন মৃতরা সবাই। মা, বাবা, পালক পিতা সিরিয়াস ব্ল্যাক। হ্যারি বলে, “তোমরা আমার সঙ্গে আছ তো?” আর তার শৈশবে মরে যাওয়া মা-বাবা জানান, “আমরা তোমার সঙ্গেই আছি, হ্যারি। শেষ দিন পর্যন্ত থাকব।” রোওলিং-এর লেখা অনুসরণ করেই ‘ডেথলি হ্যালোজ’ আর শিশু-চলচ্চিত্রে আটকে থাকে না, হয়ে ওঠে মৃত্যুর সঙ্গে জীবনের কথোপকথন।
অভিনয়? হ্যারি, রন আর হারমিওনের ভূমিকায় ড্যানিয়েল র্যাডক্লিফ, রুপার্ট গ্রিন্ট আর এম্মা ওয়াটসনকে নিয়ে বলার নেই। আমাদের চোখের সামনেই এরা বালক থেকে তরুণ হয়েছে। ভাগ্যিস প্রথম ছবির সময় রোওলিং জেদ ধরে বসেছিলেন, হলিউডের শিশু-অভিনেতা নয়। নতুন ব্রিটিশ মুখ নিতে হবে! র্যালফ ফিনেস ‘ভোল্ডেমর্ট’ হিসেবে চমৎকার। মাইকেল গ্যাম্বনের ‘ডাম্বলডোর’ দেখতে দেখতে মনে পড়ল, প্রথম হ্যারি পটার ছবিতে ওই চরিত্রে ছিলেন প্রয়াত রিচার্ড হ্যারিস। আজ তিনি শুধুই স্মৃতি।
আস্ত বইয়ের খুঁটিনাটি ছবিগুলিতে ধরা সম্ভব ছিল না, শেষ ছবিতেও তাই। ডাম্বলডোর যে অতীতে শয়তান জাদুকর গ্রিনডেলওয়াল্ডের বন্ধু ছিলেন, ‘বৃহত্তর ভালর জন্য’ কিশোর বয়সে তিনিও যে ওই তিন ‘ডেথলি হ্যালোজ’ খোঁজার চেষ্টা করেছিলেন, ছবিতে তা দেখানো হয়নি। রোওলিং-এর ভাষাটা ছিল, ‘ফর গ্রেটার গুড’। উইজার্ডদেরই তো দায়িত্ব, জাদুহীন ‘মাগ্ল’দের উপকার করা। সেই উপকারের জন্য চাই প্রতিটি যুদ্ধে জেতার ক্ষমতা, চাই ডেথলি হ্যালোজ!
দেখানো সম্ভব ছিল না কিশোর প্রেমের খুঁটিনাটিও। রন আর হারমিওনে যখন পরস্পরকে চুমু খায়, উপন্যাসে হ্যারি গলা খাঁকারি দিয়েছিল, “এই, যুদ্ধ হচ্ছে না?” প্রত্যুত্তরে রন বলেছিল, “আরে, যুদ্ধ বলেই তো। নাউ অর নেভার।” এ ছবিতে যেমন হরক্রাক্স খুঁজতে লুনা সরাসরি গুদামঘরে হ্যারিকে নিয়ে যায়। বইয়ে একটু অন্য রকম ছিল। সহপাঠিনী চো চ্যাং হ্যারিকে সেখানে নিয়ে যেতে চেয়েছিল। পাশ থেকে জুনিয়র ক্লাসের মেয়ে জিনি, ভবিষ্যতে যে হ্যারির বৌ হবে, সে গম্ভীর ভাবে বলেছিল, “না, চো যাবে না। লুনা, তুই বরং হ্যারিকে নিয়ে যা।” সহপাঠিনী চো চ্যাং-কে হ্যারি যে এক বার চুমু খেয়েছিল, জিনি ভুলতে পারেনি। স্কুলজীবনের সেই ‘প্রথম প্রতিশ্রুতি’র দিনগুলিও যেন আজ ভোল্ডেমর্টের মাথার মতো গুঁড়িয়ে গেল, কালো থ্রিডি চশমার সামনে উড়ে এল অজস্র স্মৃতির সাদা পালক।
এর পরও এই ছবির রিভিউ লেখা সম্ভব, স্যার? তবে বই আর ডিভিডি তো থাকবে। সেগুলিতে ভর দিয়েই মাঝে মাঝে আপনাদের ‘মাগ্ল-দুনিয়া’ ছেড়ে চলে যাব জাদু-পৃথিবীতে!
Previous Item Patrika Next Item


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.