ভাষাটা অন্য রকম। সে ভাষায় লিখতে গেলে বাক্য বিস্তার হবে এ ভাবে...
“সত্যিই কি ‘ঘোড়া’র মধ্যে আর ‘বিজ’ ছিল,” উত্তেজনায় কাঁপতে কাঁপতে ‘চিতা’কে জিজ্ঞেস করে ‘দা’। ‘চিতা’ নিরুত্তর। কেবল হিমচোখে হাতে ধরা পিস্তল থেকে বের করে দেখায় গুলি। শেষ গুলি। যা মুহূর্তে ঝাঁঝরা করে দিতে পারত ‘দা’কে। যেটা হয়তো স্বাভাবিক ছিল। কারণ, তার অতিবিশ্বস্ত ‘দা’ এসেছিল ‘চিতা’কে খুন করতে। সেই ‘দা’, যার হাত ধরে ‘চিতা’ পা দিয়েছিল এই জগতে। যার পোশাকি নাম আন্ডারওয়ার্ল্ড।
যে দুনিয়ার বাসিন্দারা মাঝে মাঝেই নিজেদের অস্তিত্বের জানান দিয়েছে নানা ঘটনায়। যদিও এই সব ঘটনার কেন্দ্রবিন্দু বেশির ভাগই মুম্বই। সেখানকার হাজি মাস্তান, দাউদ ইব্রাহিম, ছোটা শাকিল, ছোটা রাজনরা তো এখন সিনেমায়, খবরে যখন-তখন। যাদের নামের আগে-পরে জড়িয়ে আছে মুম্বই-বিস্ফোরণ থেকে শুরু করে সাংবাদিক জ্যোতির্ময় দে-র মতো মানুষ শিকার করা পর্যন্ত ঠান্ডা খুনের ফিরিস্তি।
কিন্তু কলকাতা? আন্ডারওয়ার্ল্ডের তরঙ্গ কতটা ভেসে আসে এই হুগলিতীরে? আসে। এই শহরে তাদের দুনিয়াদারি চলে ‘দা’ (দাদা বা ডন), ‘তারা’ (ফিক্সার), ‘চিতা’ (শু্যটার), ‘নোটিস’ (সুপারি), ‘বিজ’ (গুলি), ‘ঘোড়া’ (বন্দুক), ‘খোকা’ (কোটি), এই সব শব্দজোট ঘিরে।
তাদের কথাই শোনাচ্ছেন পরিচালক রিংগো। তাঁর নতুন ছবি ‘সিস্টেম’-এর মাধ্যমে। ২৯ জুলাই মুক্তি। অন্য ভাষা। অন্য মূল্যবোধ। চেনাজানা শহরের মধ্যেই আরেকটা শহর। তাই নিয়েই ছবি। বাংলা ভাষায় নাকি এই প্রথম। কিন্তু ছবির রসদ এল কোথা থেকে? “অলকানন্দাদির (নৃত্যশিল্পী অলকানন্দা রায়) সঙ্গে গিয়েছিলাম প্রেসিডেন্সি জেলে। কয়েদিদের মধ্যে কেউ কেউ দু’গুণ বা তিনগুণ যাবজ্জীবন কারাবাসে কাটাচ্ছে। তাদের কাছেই জেনেছি এই সব শব্দ,” বলছেন রিংগো।
উৎস আরও আছে। সারা বিশ্বের আন্ডারওয়ার্ল্ড ভিত্তিক ছবি। “সে ছবিগুলোর মধ্যেও কিন্তু একে অন্যের সঙ্গে প্রচুর মিল আছে। আসল যেটা পেয়েছি, সেটা ওই সব বন্দির সঙ্গে সামনাসামনি কথা বলে আর তথ্যপঞ্জি পড়ে,” বলছেন পরিচালক।
বলিউডে যাবতীয় আন্ডারওয়ার্ল্ডের ছবির পিছনে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভাবে জড়িয়ে আছে ‘ডি-কোম্পানি’ ওরফে দাউদ ইব্রাহিমের ‘সংস্থা’। যেমন রাম গোপাল বর্মার ট্রিলজি: ‘সত্য’, ‘ডি’ (রামুর প্রযোজনা), ‘কোম্পানি’। বা ‘ওয়ান্স আপন আ টাইম ইন মুম্বই’, হাজি মস্তান বনাম দাউদের গল্প। |
তা হলে, ‘সিস্টেম’-এর পিছনে কলকাতার মুখগুলো কারা? “বলিউডের এই ছবিগুলি মুক্তির পরই কিন্তু আমরা বা মিডিয়া সেই সব চরিত্রে আন্ডারওয়ার্ল্ডের সঙ্গে যুক্ত নানা নাম জুড়ে দিয়েছি। হয়তো ‘সিস্টেম’-এর মুক্তির পরেও উঠবে নানা নাম। আশির দশকে ডি সি (বন্দর) বিনোদ মেটা খুন হন। নব্বইয়ে বৌবাজার বোমা বিস্ফোরণ হয়। এখন ওপর ওপর শান্ত। কিন্তু আমি কয়েদিদের সঙ্গে কথা বলে জেনেছি যে, এখন পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গে বাংলাদেশের আন্ডারওয়ার্ল্ডের প্রত্যক্ষ যোগ আছে,” দাবি রিংগোর।
তা কলকাতার ‘সিস্টেম’-এর ছবিটা কেমন? “সংখ্যা কম নয়। ত্রিশ হাজারের কাছাকাছি। প্রায় মুম্বইয়ের মতোই। মূল সংস্থা একটি। তার ছোট ছোট সহ-সংস্থা আছে। এমনই শক্তিশালী আর নিখুঁত নেটওয়ার্কে এদের কাজ হয় যেখানে ভুলের মার্জিন শূন্য,” বলছেন পরিচালক। সব থেকে চাঞ্চল্যকর বিষয়, কোনও সংস্থাই জানে না ‘আসল’ মাথা কে। “যারা জেলে রয়েছে, তারাও জানে না কে তাদের ‘অর্ডার’ দেয়।” সোজা কথায়, এই ছবি কলকাতার হাজি মাস্তান, দাউদ ইব্রাহিম, ছোটা শাকিলদের গল্প।
সেই জগতের সমস্ত জটিলতা, ঘাঁতঘোঁতই আছে ছবিতে। প্রেক্ষাপটটা কেবল এক বাঙালি, হিন্দু বাড়ির যৌথ পরিবার। যার মাথা বারীন সেনাপতি। সে তার ‘সিস্টেম’-এ তার মতো করে সাম্রাজ্য চালায়। তার ‘তারা’ হল দিলাওয়ার শেখ (সব্যসাচী চক্রবর্তী), ‘চিতা’ একলব্য (ইন্দ্রনীল সেনগুপ্ত)।
সেই ইন্দ্রনীল বলছেন, “অ্যাকশন ছবি হলেও আমি আর রিংগো ঠিকই করেছিলাম যে, একলব্যের চরিত্রায়ণ নিচু তারে বাঁধা হবে। ক্ষুরধার পেশাদার সে।” কিন্তু রিংগো আর ইন্দ্রনীলের প্রথম ছবি ‘যদি একদিন’ তো বক্স অফিসে ধাক্কা খেয়েছিল! ‘সিস্টেম’ মুক্তির আগে ভয় করছে না? “আমি হিট-ফ্লপ নিয়ে মাথা ঘামাই না,” বলছেন ইন্দ্রনীল। “স্ক্রিপ্ট আর লুক যদি পছন্দ হয়, তা হলে পর পর তিনটে ফ্লপ ছবির পরও একই পরিচালকের সঙ্গে কাজ করার কনফিডেন্স রাখি।”
তাই বলে মহাভারতের একলব্যের মতো ‘সিস্টেম’-এর একলব্যের জীবন প্রেমহীন নয়। একলব্য প্রেমে পড়ে এক পানশালার গায়িকার। নাম তার রানি। রানির ভূমিকায় অভিনয় করেছেন শুভ্রা কুন্ডু। যাঁর লিপে লোপামুদ্রা মিত্রের ‘মাহি রে’ ইতিমধ্যেই হিট। আর আছেন ইন্দ্রজিৎ চক্রবর্তী। আন্ডারকভার এজেন্ট রুদ্র। একলব্যের প্রতিপক্ষ। “ছবিটা উৎসর্গ করেছি বিনোদ মেটার নামে। রুদ্রর চরিত্র তাঁর আদর্শেই তৈরি,” বলছেন রিংগো। কিন্তু কলকাতার দর্শক আন্ডারওয়ার্ল্ড বলতে বোঝে ‘গডফাদার’। নয়তো রামগোপাল বর্মার ‘সত্য’, ‘সরকার’। নতুন কী দেবেন রিংগো? বিশেষত যখন তাঁর আগের ছবি ‘রিস্ক’ হলিউডের ‘সেলুলার’ দ্বারা একটু বেশি রকম ‘অনুপ্রাণিত’ বলে জানা গিয়েছিল? রামগোপাল বর্মার ছায়া তো আছেই। পুরো ব্যাপারটাকে আরও বাস্তবসম্মত করতে ‘সিস্টেম’-এর চিত্রনাট্যে সাহায্য করেছেন রোহিত বানভিলকর। ইনিই রামুর ‘রণ’-এর চিত্রনাট্য লিখেছিলেন। রামগোপালের আগামী ছবি ‘নট আ লাভ স্টেরি’ও এঁরই লেখা।
পালা বদলের গল্পও বলে ‘সিস্টেম’। বারীন সেনাপতির টক্কর নেয় তারই ভাই সিদ্ধান্ত (রাজেশ শর্মা)। আন্ডারওয়ার্ল্ডেই ভিন্ন ভিন্ন মেরু। বদলে বদলে যায় ‘ডিল’-এর সংজ্ঞা। কিন্তু ‘সিস্টেম’-এর এই ভয়ানক খেলায় কেউ কি কখনও জিতে ফেরে? চুপ পরিচালক। স্তব্ধ নায়ক। ‘সিস্টেম’-এর অংশ হলে সব বিষয়ে মুখ খোলা যায় না যে। |