|
|
|
|
স্মরণ |
সবার উপরে |
উত্তমকুমার। চলে যাওয়ার ৩১ বছর পর যদি ফিরতেন। কোনও মাল্টিপ্লেক্সে বসে দেখতেন তাঁর ছবির রেট্রোস্পেকটিভ।
কোনটা পছন্দ হত? কোনটাই বা অপছন্দ? তাঁর মৃত্যুবার্ষিকীর এক দিন আগে সেই কল্পনায় ডুবলেন শঙ্করলাল ভট্টাচার্য |
এক বর্ষার দিনে পাহাড় পাহাড় ফুলমালায় চাপা পড়ে গিয়েছিলেন বলে এ বারের বর্ষায় একটু বেশি সাবধান উত্তমকুমার! শখের ধুতি আর গিলে করা পাঞ্জাবি ছেড়ে ‘নায়ক’-এর চোখা স্যুট-টাইয়ে চলে এসেছেন মাল্টিপ্লেক্সে। চেরি রংয়ের মার্সেডিজে যেতে যেতে এক বার বললেন, ‘আমাদের দৌড় তো ছিল ফিয়েট, অ্যাম্বাসাডর, বড় জোর ফোর্ড টমাস অবধি। বিশু (বিশ্বজিৎ) অবিশ্যি বম্বে গিয়ে একটা ইম্পালা হাঁকাচ্ছিল। তবে, সে যুগে, মার্সেডিজের আকাঙ্ক্ষাটা থেকেই গিয়েছিল। এ সব গাড়িতে বসলে স্টিয়ারিংয়ের জন্য হাত নিশপিশ করে, বলতে বলতে ব্যাক সিটে বসা নায়ক দু’হাতে স্টিয়ারিং ঘোরানোর ভঙ্গি করলেন।
মস্ত সুশীতল মাল্টিপ্লেক্সের বেদম আরামের সিটে গা এলিয়ে ‘ভুস’ করে বসেই নায়কের প্রথম প্রতিক্রিয়া হল, “বাপ্স! এ ভাবেই তো বার্লিন চলচ্চিত্র উৎসবে গিয়ে ডুবে গিয়েছিলাম। আমাদের সময় গ্লোব, মেট্রো, লাইট হাউসে আরামের সিট ছিল বটে, সেখানে হত তো বিলিতি ছবি। আমাকে আর রমাকে (সুচিত্রা) দেখার জন্য কী কষ্টটাই না করেছে বাংলার পাবলিক!”
সিটের হাতলে গেলাস রাখার খাপ আছে, কিন্তু অ্যাশট্রে নেই দেখে হাঁক দিলেন উত্তম, “সে কী! ছাই ফেলব কোথায়?” যখন শুনলেন হল-টলে আজকাল ধূমপান নিষিদ্ধ, একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন, “কী ব্যাপার বলো তো? সবই তো দেখছি বদলে গেছে এই ৩০টা বছরে, তা হলে আমার সময়কার আছেটা কী?”
জবাবে যা শুনলেন, তাতে ওঁর ওই ৬৪ কোটি টাকার হাসিটা বিগলিত করুণায় ঝরে পড়ল, “আরে বলো কী! ৩০ বছরেও ভাঁটা পড়েনি বাঙালির উত্তমবিলাসে? বলছ শ’গুণ বেড়েছে? বলছ আমাকে সবাই বাংলার মুখ বলছে? বলো কী? এত কী করলাম ভাই, পৌনে দু’শো ছবিই তো? তাতেই এই? আর তারও তো কত ছবিই করতে করতে বুঝেছি, কিস্সু হচ্ছে না। আমাকে ধরেই দৌড়তে চাইছে।
“আর যেগুলো দৌড়ল? আত্মপ্রশংসা হবে, তবু বলি, ও ছবি আর হবে না। করবেটা কে? উত্তম কোথায়? চলে যাবার পরের দিনই তো মানিকবাবু বলেছিলেন, ‘ও রকম আর হবে না!’ আমায় দিয়ে ‘নায়ক’ করিয়েছিলেন, কী একটা ছবি বলো তো! তার পর ‘চিড়িয়াখানা’ করেই শেষ। এক কুচি অভিমান তো ছিলই, মিছে বলব না, হাজার হোক বামুনের ব্যাটা তো। কিন্তু সে সব ধুয়েমুছে সাফ হয়ে গেল, যখন আমার স্মরণসভায় টেকনিশিয়ানস স্টুডিওতে দাঁড়িয়ে বলে দিলেন, ‘কিছু দিন আগে ‘নায়ক’ ছবিটা আবার টেলিভিশনে দেখেছি। ১০-১২ বছর পরে। খুব মন দিয়ে ছবিটা দেখেছি এবং ছবিটা দেখে আমার মনে হয়েছে যে ছবিটাতে আমার ত্রুটিবিচ্যুতি নিশ্চয়ই আছে, কিন্তু উত্তমের কাজে কোনও ভুল নেই...উত্তমের অভিনয় দেখে আমি অকপটে বলতে পারি যে, তাঁর অভিনয়ের মধ্যে আমি একটি ত্রুটিও খুঁজে পাইনি।’
‘‘কী বলব আর, মৃত্যুর পর আর এক বার আনন্দে মরে গেলাম। ৫৪ বছরে চলে যাওয়ার দুঃখও চলে গেল। বুড়ো হয়ে সাইড রোল করা আর রোগে ভুগে মরার চেয়ে তো ভাল। তোমাদের এই হাহাকার, ‘গুরু’! ‘গুরু’! ডাকও তো এই জন্যই।
“তা হলে এসো তোমাদের সঙ্গে বসে পর্দায় নিজেকে দেখি। কী বললে? আমার সব ছবি সাজিয়ে রেখেছে? গ্রেট! এখন চলো, আর এখন থেকে স্পিকটি নট, এই অন্ধকার ঘরে শুধু ‘মহানায়ক’ কথা বলবে।”
|
*** |
কেন যে লোকে ‘সাড়ে ৭৪’কে উত্তমের ছবি বলে আমার মাথায় খেলে না। ওটা আদ্যোপান্ত তুলসীদার (চক্রবর্তী) ছবি। কোথায় রমা? কোথায় আমি? খেলছেন তো তুলসীদা। দ্যাখো, দ্যাখো, ওই যে বাড়ি ফিরে কালী কীর্তন করছেন আর পৈতে দিয়ে গা আঁচড়াচ্ছেন ও তো পূর্বজন্মের সুফল ভাই। চোখমুখের কী এক্সপ্রেসশন আর কী টাইমিং লোকটার!
‘পাশের বাড়ি’তে বরং একটু খেলছি আমরা। ওই ফোন ধরাধরি কেস তাতে একটা রোমান্সের সাসপেন্স গড়ছে, ওতেই রমা আর আমি ক্যারেক্টারে জমছি। একটা জিনিস খেয়াল করেছ, রমা আর আমার রোম্যান্টিক ছবিগুলোয় সারা ক্ষণ কী একটা সাসপেন্স, কী হয় কী হয় ভাব। কেউ ভাবতে পেরেছিল ‘শাপমোচন’-এ ভর সন্ধ্যায় দেখা করে হাবা, ভাল মানুষ আমি নায়িকার কাছে চেয়ে বসলাম কী? না শুধুই ১০টা টাকা! নায়িকা তার সব কিছু উজাড় করে দিতে প্রস্তুত, আর আমি চাইছি ১০টা টাকা। আর সঙ্গে সঙ্গে ওই ঐতিহাসিক চড়। বাংলা সিনেমার এক সেরা রোম্যান্টিক দৃশ্য। জানি না, বাংলা ছবিতে তার আগে কোনও নায়িকা নায়ককে চড় মেরেছে কি না। শুনেছিলাম এটা দেখার পর বাঙালি মেয়েরা প্রেমে পড়লে আয়নার সামনে খুব চড় প্র্যাক্টিস করত। আর ছেলেরা চড় হজম করে উত্তম হওয়ার চেষ্টা করত। কিন্তু দুঃখের ব্যাপার, তাদের কষ্ট ভোলার জন্য তো আর হেমন্তদার (মুখোপাধ্যায়) প্লে-ব্যাক থাকত না। ‘সুরের আকাশে তুমি যে গো শুকতারা’ এ তো শুধু একটা গান নয়। গোটা ছবির আত্মা, ‘শাপমোচন’-এর শাপ তো গান নিয়েই, ধরা আছে এই গানেই। ‘শাপমোচন’-এর সময়েও কিন্তু ‘গুরু!’ ডাকের চল হয়নি। সে অনেক পরের। তবে ওই মিড ফিফ্টিজেই আমার মধ্যে রোমান্সের ঢেউ বইছে ২৪ ঘণ্টা। আমার তাকানো, আমার সংলাপ ধরা, ছাড়া, হাঁটা, নায়িকাকে আলিঙ্গন... আমি পর্দায় আগুন ছড়াই। এই এখন ‘হারানো সুর’-এ গীতার গলায় রমার গান, ‘তুমি যে আমার, ওগো তুমি যে আমার’ শুনতে শুনতে আমার গায়ে কাঁটা দিচ্ছে। আমি ভেতরে ভেতরে উত্তমকে হিংসা করছি। ‘গুরু!’ ‘গুরু’! করতে ইচ্ছে করছে। মনে করতে চাইছি স্মৃতিভ্রষ্ট নায়কের চরিত্রে চোখ বুজে শুয়ে আমি কী ভাবছিলাম সে দিন? রমার প্রেমে পড়েছিলাম নতুন করে? যে প্রেম মুখে বলতে পারিনি? দ্যাখো বাপু, আমি অ্যাক্টিং স্কুলে শিক্ষে করা নায়ক নই। যা শিখেছি ঠেকে, দেখে, মনের আয়নায় নিজেকে কেটে, ছিঁড়ে, রক্তাক্ত করে। আমার যেটা ছিল, যে জন্য আমি উত্তমকুমার, তা হল প্যাশন। কী জীবনে, কী অভিনয়ে। এই যে তোমাদের সঙ্গে আমার পুরনো ছবি দেখছি, আমি নতুন করে প্রেমে পড়ছি রমা, সুমিত্রা (দেবী), সাবু (সাবিত্রী), বেণুর (সুপ্রিয়া)... একটা জিনিস জানবে, জীবনে আর অভিনয়ে প্রেমে পড়া খুব আলাদা জিনিস নয় কিন্তু। এই যে ‘অপরিচিত’র নায়ক আমি নায়িকার (অপর্ণা) জন্য পাগল, হিংস্র, খুনি হয়ে উঠেছি। এই প্যাশনের উপকরণ তো জীবন থেকেই নেওয়া। কিংবা ‘স্ত্রী’ ছবিতে সহধর্মিণীর (আরতি) হারের লকেটে সৌমিত্রর ছবি দেখে বেচারিকে গুলি করতে যাচ্ছি, সে-ও তো ওই উন্মত্ত প্যাশনের চাপে। এই প্যাশন ভেতরে থাকতে হবে, তবেই না ছবির সেই সিকোয়েন্সে, সেই সংলাপে ছিটকে বেরিয়ে আসবে। কী আর বলব তোমাদের এখন, বয়স তো অনেক হল, তবে নায়কের জীবনে, নায়কের রোলে, শরীরের যৌন আকাঙ্ক্ষারও নিবৃত্তি হয়েছে অসাধারণ সব রোম্যান্টিক রোল করতে গিয়ে।
আরে ভাই, উত্তমকুমার হওয়া কি চাট্টিখানি কথা! এই যে এখেনে সিগ্রেট ফুঁকতে দিচ্ছ না, আমার কতখানি সমস্যা করছ জান? ধূমপান, জনি ওয়াকার, ব্ল্যাক লেভেল স্কচও আমার প্যাশন ছিল। প্যাশন ছিল হেমন্তদার গান। সেই হেমন্তদার সঙ্গে সম্পর্ক কেটে গেল, উনি বম্বেতে নায়ক করে নিয়ে গেলেন বিশুকে। ভাল। আমি খুঁজে নিলাম শ্যামলকে (মিত্র), মান্নাবাবুকে (দে), শেষে কিশোরকুমারকে। ভাবো কী গান
মান্না দে দিলেন ‘অ্যান্টনি ফিরিঙ্গি’তে...‘আমি যে জলসাঘরে’, ‘চম্পা চামেলি’, আর ওই অবিস্মরণীয় ‘আমি যামিনী তুমি শশী হে’...ভাবো তো অনিলবাবুর (বাগচী) মতো ওই সুর কেউ বাঁধতে পারবে আজকের দিনে? তার কিছু দিন আগে ‘মেরে মেহবুব’ ফিল্মে নৌশাদের সুরে রাজেন্দ্রকুমারের লিপে ‘মেরে মেহবুব তুঝে মেরি মোহব্বত কি কসম’ শুনে দারুণ লেগেছিল। মনটা একটু খারাপও হয়েছিল, এমন গান কি আমার ঠোঁটে পাব না? অনিলদা
আর মান্নাবাবু আমার সে দুঃখ ঘুচিয়ে দিলেন। আর সবার ওপরে তনুজা!
কী একটা নায়িকা, মাই গড!
ভেতরটা জ্বালিয়ে দিচ্ছে। শুধু ‘অ্যান্টনি ফিরিঙ্গি’ নয়, উত্তমকুমারেরও। তবুও জানো, বড় আফশোস হেমন্তর গলা পাইনি শেষের প্রায় ১৮-২০ বছর।
ওই তো আমার অর্ধসত্তা ছিল, রমার যেমন সন্ধ্যা। বেণু লিখেছে ওর স্মৃতিকথায়, বেণুকে হেমন্তদার বম্বে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা থেকেই যত ভুল বোঝাবুঝি। বেণুর প্রতি আমার প্যাশনের বাড়বাড়ন্তও বলতে পার। সেই প্যাশনেরই একটা রূপক আমি এখন দেখতে পাচ্ছি ‘লাল পাথর’-এর এই অংশগুলোয়। দ্যাখো, কী প্যাশনেট এক মহিলা ছিল বেণু। রোলের ভেতর দিয়েও মানুষটা ঠিকরে বেরোচ্ছে। প্রশান্ত চৌধুরীর গল্পটা যে দিন হাতে এসেছিল, সে দিন থেকেই আমার স্বপ্ন দেখা শুরু। বেণুকে নিয়েই একটা ছবির আউটডোরে ছিলাম জঙ্গলে। কী একটা ব্যাপারে বেজায় ঝগড়াঝাটি শুরু হল, আমি রাতের বেলা গাড়ি ড্রাইভ করে চলে আসছিলাম। আমায় ধাওয়া করে মাঝপথে থামিয়েছিল কিন্তু বেণুই আর তোমাদের নাম-করা চলচ্চিত্র সাংবাদিক রবি বসু। ওই রবিবাবুকেই শু্যটিং শেষে রাতবিরেতে আমি ‘লাল পাথর’-এর গল্প শোনাতাম। কাহিনির ওই পাগলাটে লোকটাও আমি। বেণুও ওই নাছোড়, পজেসিভ মহিলা। সুনীলদাই (মুখোপাধ্যায়) করেছিল ছবিটা। এ রকম আর এক প্রিয় চরিত্র হল ‘সাহেব বিবি গোলাম’-এর ভূতনাথ।
তোমাদের বম্বের রাজকুমার হিন্দিতে ‘লাল পাথর’ করার সময় নাকি দফায় দফায় আমার ছবিটা দেখেছে। তাতে আমার ছ’আনা তুলতে পেরেছে? বলো না, সবজান্তা বাবাজি তোমরা। গুরুকে আমার বেশ পছন্দই, ওর কথায় আর যাচ্ছি না। আমার টাইম বেশি নেই, চলো অন্য ছবিতে যাই।
না না, তার আগে ‘সাহেব বিবি গোলাম’ সামলাই। এ ছবিতে আমি ভূতনাথ, এক বড় জমিদার পরিবারের নিতান্ত আশ্রিত। অথচ তার চোখেই সমস্ত ঘটনাস্রোত, বংশের ওঠা-পড়া তোমরা দেখেছ। আমাকে সবাই এক রকম কৃপা কিংবা উপেক্ষা করে। অথচ এই মানুষটিরই হৃদয় জুড়ে রয়েছে নায়িকা পটেশ্বরীর (সুমিত্রা দেবী) অপরূপ মুখখানি। লেখক বিমল মিত্র কী ভেবেছিলেন জানি না, আমি কিন্তু ওই অবহেলিতা, অগ্নিসমা সুন্দরী বৌঠান ও ভূতনাথের মধ্যে এক নিরুচ্চার, অন্তঃশীল প্রেম দেখতে পাই। মহিলার অবক্ষয় ও মৃত্যুর সামনে ও-ই এক চিলতে বেড়া। যে দিন তিনি খুন হলেন আমি একমাত্র সাক্ষী। গোলাম। নিম্নবিত্ত বাঙালি গোলাম। কিন্তু এদের আবেগ, অনুভূতির ঢিললঙ্গর বহুত উঁচু ডালে পৌঁছয়।
এসো, এ বার আসল কথায় যাই। এই যে তোমাদের উত্তমকুমার, এ স্যুটেড, বুটেড, বড়লোক হলে মেয়েরা গলে গলে পড়বেই। কিন্তু ‘শাপমোচন’, ‘সাহেব বিবি গোলাম’, ‘মায়ামৃগ’, ‘অমানুষ’, ‘যদুবংশ’য় নিতান্ত সাধারণ অবস্থার চরিত্রে থেকেও যখন নায়কের গরিমা পাই, মেয়েদের মন কাড়ি, তখন মনে হয় বাঙালি যুবাকে একটা বার্তা পাঠাচ্ছি। সেটা হল, জীবনের কোনও অবস্থাই রোমান্সমুক্ত নয়, কোনও চরিত্রই হারিয়ে যাওয়ার জন্য আসে না। তোমরা বলবে এ সব ‘অথরব্যাক্ড’ অর্থাৎ লেখকের বদান্যতাপ্রাপ্ত, প্লে-ব্যাক গানে জোরদার চরিত্র। কিন্তু আমার কাজটুকুও দ্যাখো; সাধারণ পোশাক-আশাক, সাধারণ সংলাপ, রোজকার পরিস্থিতি, তার মধ্যেই একটা সজীব, সতেজ, প্রাণভোমরা মানুষ। কেন, পরিচারকের ভূমিকায় ‘খোকাবাবুর প্রত্যাবর্তন’-এ দাগ কাটিনি? আর ‘যদুবংশ’য় গগনদার ভূমিকা তো আমার সারা জীবনের এক সেরা অভিনয়। এ ছবি বা ‘নায়ক’ তো মরণের পারেও আমি দেখে চলেছি। ‘নায়ক’ শেষ হতে না হতেই মানিকদা আমাকে ‘চিড়িয়াখানা’য় ব্যোমকেশ করবেন বলে ঠিক করলেন। ‘নায়ক’-এর মতো ওই অসামান্য কাজের পর এ ছবি ঠিক সেই স্তরে চড়ল না। উপরন্তু ওই সময় আমি অসুস্থ হয়ে ছবি শেষ করতে দেড়টা বছর লেগে যায়। মানিকবাবু নিজেও ভেতর-ভেতর উশখুশ করছিলেন ‘গুপী গাইন বাঘা বাইন’ শুরু করবেন বলে। তবে ‘নায়ক’ করে একটা অদ্ভুত স্বাদ ছড়াল মনের মধ্যে। একটা সম্পূর্ণ আধুনিক মেজাজ ও স্টাইলের ছবিতে কাজ করে একটা নতুন ধারার অ্যাক্টিং-এর উদ্বেগ তৈরি হল ভেতরে। বলতে নেই, প্রায় এক সময়ে একটা বাজে কাজও করে বসেছিলাম নিজের সঞ্চয়ের অজস্র টাকা লগ্নি করে। আমার ও রমার সুপারহিট ছবি ‘অগ্নিপরীক্ষা’র হিন্দি রিমেক ‘ছোটি সি মুলাকাত’। কিস্সু হল না, টাকা গেল, স্ট্রোক হয়ে শরীরটা ভাঙল, আর বম্বের কিছু প্রযোজক, চিত্রনির্মাতা, পরিবেশকদের চরিত্রের একটা নৃশংস দিক চাক্ষুষ করলাম।
এর অনেক পরে শক্তি সামন্তের হিন্দি আর বাংলা ‘অমানুষ’ করে তো দিব্যি সাফল্য পেয়েছি। তবু বলব, আমার বলিউড মধুচন্দ্রিমাগুলো সুখের হয়নি। ‘অমানুষ’-এ ফাটিয়ে কাজ করেছি শর্মিলাকে নিয়ে, কিশোরের ‘কী আশায় বাঁধি খেলাঘর’ গানটায় মেজাজে লিপ দিয়েছি, কিন্তু চেহারায় বয়েস থাবা মারছিল। এ জন্যই ছবিটা দেখতে দেখতে খুশি-খুশি ভাবের সঙ্গে একটা ব্যথাও জড়িয়ে যাচ্ছে। যেটা হয় না যখন ‘যদুবংশ’ দেখি, বয়স্ক রোলে বয়স্ক চেহারাই, কিন্তু কী ওজন! কী আকর্ষণ!
আমার সেরা ছবি? সে তো তোমরা বলবে। অবশ্যই ‘নায়ক’। মানিকদা নায়ক-নায়িকার সম্পর্কটা কী ভাবে দেখেছেন সে তো তোমরা দেখতেই পাচ্ছ। আমি কিন্তু নায়ক অরিন্দমের একটু একটু করে গজদন্ত মিনার থেকে নেমে আসার মধ্যে একটা প্রেমের ছবি পাচ্ছি। মেয়েটাও প্রেমে পড়ে যাচ্ছে। তোমরা বলবে, আমি শালা দুশ্চরিত্র লোক, সব কিছুর মধ্যে প্রেম খুঁজি। আরে বাপ, নায়কটা তো আমি, অভিনয় করতে গিয়ে টের পাচ্ছি না ইমোশন কী চলছে ভেতরে? বাইরে উদাস থাকছি, ভেতরে দুলছি; মেয়েটা বুঝছে কি না জানি না, কিন্তু তলে তলে আমার এই দূরত্ব ও ঘনিষ্ঠতা ওকে ভাঙছে। এই সব ভাবতে ভাবতে একদিন মানিকবাবুর ওই রুমাল চিবুনো অভ্যাসটা নকল করে ফেললাম, আর সেটা ওঁর নজরে আসতে সঙ্গে সঙ্গে সেটা লাগিয়ে দিতে বললেন একটা মুডের দৃশ্যে। এই দ্যাখো! ‘নায়ক’ আমার সেরা বলে থামব না। সত্যজিৎ যে ‘নায়ক’-এর রোলে আমি ছাড়া কাউকে ভাবতেই পারেননি তা কেন জান? আমি ছাড়া আর স্টার কে? আমার স্মরণসভায় বলেওছিলেন যে, অন্য কাউকে নামালে লোকে বলত, যে অ্যাক্টর নিজের জীবনে স্টার হয়নি তাকে উনি স্টার করতে গেলেন কেন? উত্তম আসাতে অভিনয় ও জীবন মিলে গেল।
এ বার বলো, ওই স্টার আমাকে করল কোন ছবি? ‘শাপমোচন’, ‘অগ্নিপরীক্ষা’, ‘সবার উপরে’, হারানো সুর’, ‘ঝিন্দের বন্দী’, সাহেব বিবি গোলাম’, ‘কাল তুমি আলেয়া’, ‘শুধু একটি বছর’, ‘লাল পাথর’, আর হ্যাঁ, অবশ্যই, অবশ্যই, অবশ্যই ‘সপ্তপদী’। ‘সপ্তপদী’ নিয়ে তোমরা এত হইচই করো, তাই ওটা নিয়ে আর নিজে কিছু বলছি না। ‘সপ্তপদী’কে আমি বলি বাংলার ‘গন উইথ দ্য উইন্ড’।
পরের দিকেও ‘ছদ্মবেশী’ (মাধবীকে কী সুন্দর মানিয়েছে!), ‘জয়জয়ন্তী’, ‘স্ত্রী’, ‘অপরিচিত’তে কম স্টার নই বাপু আমি। এমনকী যেটা করতে করতে চলে গেলাম সেই ‘ওগো বধূ সুন্দরী’ও শুনি আমাকে দেখিয়ে এখনও দর্শক টানছে। না না, আর দেখে কাজ নেই, আমার যা জানার জেনে গেছি। আমি ছিলাম, আমি আছি, আমি থাকব। আমার এক স্যাঙাত বলত, আমি নাকি কলির কেষ্ট। এখন বুঝছি ভুল বলেনি। |
|
|
|
|
|