|
|
|
|
প্রবন্ধ ১... |
সমস্যাটা পরীক্ষা নিয়ে নয়, লেখাপড়া নিয়ে |
পরীক্ষা ব্যাপারটা নিয়ে নিশ্চয়ই অনেক প্রশ্ন, অনেক তর্ক। কিন্তু যতক্ষণ না
তার একটা
যথাযথ বিকল্প পাওয়া যায়, ততক্ষণ বরং স্কুলশিক্ষার গোটা
আয়োজনটাকে
উন্নত ও কার্যকর করে তোলার দিকে মন দেওয়াই শ্রেয়।
সেমন্তী ঘোষ |
সিদ্ধান্ত, না কি প্রস্তাব? প্রস্তাব, না কি ভাবনা? এই মূহূর্তে কোন স্তরে রয়েছে কথাটা? একটু ধোঁয়াটে। তবে শিক্ষামন্ত্রী যখন প্রচারমাধ্যমের সামনে জানাচ্ছেন, রাজ্যের সরকারি ও সরকার অনুমোদিত স্কুলগুলিতে ক্লাস এইট অবধি পরীক্ষা তুলে দেওয়া হবে, কিংবা ঐচ্ছিক করে দেওয়া হবে, ধরে নেওয়া যেতে পারে, যে স্তরেই হোক, কথাটা রয়েছেই, গুরুতর ভাবেই রয়েছে। নতুন জমানায় সংস্কারের কাজ চলছে তড়িৎগতিতে, তারও মধ্যে আলাদা করে ধাক্কা দিল মন্ত্রীর বক্তব্যের আকস্মিকতা ও দ্রুততা। কোথা থেকে এল এই বক্তব্য? কারা ঠিক করলেন? কেন ঠিক করলেন? ঠিকই, তৃণমূল কংগ্রেসের নির্বাচনী ইস্তেহারে এমন একটা কথা পড়া গিয়েছিল। কিন্তু সে তো দলীয় ইস্তেহার-মাত্র! শিক্ষা, তায় আবার বুনিয়াদি শিক্ষার মতো একটা অত্যন্ত গুরুতর বিষয় নিয়ে কোনও রাজনৈতিক দলের ইস্তেহার নিশ্চয়ই একটা বৈপ্লবিক নীতির ভিত্তি হতে পারে না? প্রাথমিক শিক্ষা ও প্রাক্-মাধ্যমিক শিক্ষার স্তর থেকে পরীক্ষা ব্যবস্থা উঠিয়ে দেওয়া বা ঐচ্ছিক করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত (বা প্রস্তাব, বা ভাবনা) বৈপ্লবিক বইকী!
পরীক্ষা, অর্থাৎ আমাদের চেনা ব্যবস্থায় পরীক্ষার যে আকারপ্রকার কোনও বিচারেই সেটা স্বস্তিকর কিংবা কার্যকর নয়। কিন্তু যত আপত্তিই থাক, আরও ভাল কোনও বিকল্প নিশ্চিত না করে সেটা এ ভাবে বাতিল করে দেওয়া যায়? রাজ্য-জোড়া অগুন্তি পুত্রকন্যার ভবিষ্যৎ হাতে নিয়ে শূন্যে এ ভাবে ঝাঁপ দেওয়া যায়? সেটা কি সুবিবেচনার কাজ? পরীক্ষাকে ছাত্ররা ভয় পায় বলেই পরীক্ষাকে হটিয়ে দিতে হবে? পরীক্ষার অত্যধিক ভার বা তার অযথা ভয় কমানোর চেষ্টা করা যায় না? মন্ত্রীর বক্তব্য প্রকাশের পর নানা বিরূপ প্রতিক্রিয়া শোনা যাচ্ছে, কিছু বিদ্রুপও: ছেলেমেয়েরা তো বাবা-মাকেও ভয় পায়, তা বাবা-মাদেরও এ বার আইন করে তুলে দিলে হয় না? নেহাত হালকা বিদ্রুপ, কিন্তু এর মধ্যেও ভেবে দেখার মতো একটা কথাআছে। শিক্ষাজগতের সংস্কার করতে চাইলে কোনটা আমাদের মূল লক্ষ্য হওয়া উচিত? শিক্ষাজগতের অব্যবস্থা এবং অকার্যকারিতা দূর করা? না কি, ছেলেমেয়েদের (তথা বাবা-মায়েদের) ‘ভয়’ দূর করে তাদের খুশি করতে চাওয়া? অর্থাৎ, প্রাথমিক-মাধ্যমিক শিক্ষার মতো জরুরি ও মৌলিক ক্ষেত্রে সংস্কার কি কেবলমাত্র জনমনোরঞ্জনের আদর্শ দিয়ে চালিত হওয়া উচিত? না কি, ভবিষ্যৎ-প্রজন্মকে কোন পথে ঠিক মতো শিক্ষিত করে তোলা যায়, সেটা ভাবা উচিত?
ক্ষমতায় আসার দু’মাসের মধ্যে, কোনও কমিশন-চালিত তদন্ত বা রিপোর্ট ছাড়া, কোনও বিশেষজ্ঞ-কমিটির পরামর্শ ছাড়া, হঠাৎ এমন একটা সিদ্ধান্ত/প্রস্তাব/ভাবনা? মন্ত্রী অবশ্য বলছেন, তিনি নাকি ব্যক্তিগত ভাবে কারও কারও সঙ্গে কথা বলেছেন। কিন্তু ব্যক্তিগত ‘কফি-টেবল’ কথোপকথনের ভিত্তিতে কি এত বড় সিদ্ধান্তে পৌঁছনো যায়? পুরো ঘটনাটার হেতু ও লক্ষ্য খুঁজতে বসলে একটাই যুক্তি খুঁজে পাওয়া সম্ভব। দুর্ভাগ্যক্রমে, সেটা জনমনোরঞ্জনের যুক্তি। অত্যন্ত গুরুতর, সমস্যাদীর্ণ একটা বিষয়ে দরকারি ভাবনা-চিন্তা ছাড়াই চটজলদি অবস্থানে পৌঁছনো যাচ্ছে এ জন্যই যে অনেক লোককে খুশি করা দরকার, ‘পরিবর্তন’ দিয়ে, এক্ষুনি। তাতে আসল সমস্যাটা সমাধানের পথ থেকে ছিটকে অতল খাদে তলিয়ে গেলেও কী-ই বা এসে যায়। এই দৃষ্টিভঙ্গি ভয়ানক বিপজ্জনক। এ রাজ্যের শিক্ষা ব্যবস্থার হাল এমনিতেই খুব খারাপ, এই পথে, এই দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে চললে আরও দ্রুত সেটা আরও বেশি খারাপ হয়ে বসবে, সন্দেহ নেই। |
|
বাম সরকারের আমলেও এ রকম আশ্চর্য সব ‘সমাধান’-এর চেষ্টা আমরা দেখেছি। তখনও শিক্ষার হাল ফেরানোর জন্য, শিক্ষার আরও বেশি প্রসারের জন্য স্কুলের প্রাথমিক স্তরে ইংরেজি তুলে দেওয়া হয়েছিল। ফল কী দাঁড়াল, সবাই দেখলাম। বাম সরকারও দেখল। তাই ১৯৮১ সালে মহাড়ম্বরে ক্লাস ফাইভ পর্যন্ত ইংরেজি তুলে দেওয়ার দুই দশক পর আবার সেই ক্লাস ওয়ানেই ইংরেজি ফিরিয়ে আনা হল, ভুল স্বীকার হল। মাঝখান থেকে দোদুল্যমান সরকারি নীতির জন্য দুই দশকের পশ্চিমবঙ্গীয় প্রজন্মের ভাগে পড়ল বড্ড বেশি চড়া মূল্য।
নানা পরিসরের আলোচনাতেই আজকের তৃণমূল সরকারের পরীক্ষা হটিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্তের সঙ্গে বাম আমলের সেই ইংরেজি-সংস্কারের তুলনা চলছে। এই পত্রিকার সম্পাদকীয় স্তম্ভেও সে তুলনাটা উঠেছে। অথচ এই দুই সংস্কার কিন্তু ঠিক তুলনীয় নয়। বাম সরকারের ইংরেজি উঠিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত যতই ত্রুটিপূর্ণ হোক, দোদুল্যমান হোক, সেখানে একটা স্পষ্ট নীতি ছিল। তাদের সামনে একটা লক্ষ্য ছিল, আদর্শ ছিল। সেই আদর্শ বা লক্ষ্য বা নীতির সঙ্গে আমরা অনেকেই একমত হইনি, হই না, তা-ই বলে নীতি বা আদর্শটার অস্তিত্ব অস্বীকার করা যায় না। বাম তাত্ত্বিক-রাজনীতিকরা মনে করতেন, শিক্ষার ক্ষেত্রে ইংরেজি ভাষাটা গ্রামবাংলার ছেলেমেয়েদের কাছে একটা সম্পূর্ণ অ-পরিচিত বস্তু, সেটা প্রথম শৈশবেই না চাপিয়ে দিলেও চলে। মাতৃভাষার পাশে, মাতৃভাষার মাধ্যমে অন্যান্য বিষয় শিক্ষার পাশে, দ্বিতীয় ভাষার শিক্ষার আদৌ দরকার আছে কি না, দরকার থাকলে কবে থেকে সে শিক্ষা শুরু করা ভাল, এ সব নিয়ে তাঁদের বহুচর্চিত সুস্পষ্ট মত ছিল। তাঁরা কেউ কেউ এমনও বলতেন যে, ইংরেজি শিক্ষা বুর্জোয়া শিক্ষা সমাজতন্ত্রের আদর্শের সঙ্গে সেটা খাপ খায় না। মোট কথা, তাঁদের প্রাথমিক স্তরে ইংরেজির বিরোধিতাটা ঠিক ‘অ্যাড-হক’ জনমনোরঞ্জনের হাতিয়ার ছিল না, ছিল স্পষ্ট আদর্শ-প্রসূত শক্তপোক্ত নীতি। সেই নীতি বা যুক্তির সঙ্গে তর্ক করা যেত, আপত্তি তোলা যেত। কিন্তু যেখানে নীতি বা যুক্তি, কোনওটাই স্পষ্ট নয়, সেখানে যে তর্কও করা যায় না, আপত্তিও তোলা যায় না! ব্যক্তিগত আলাপ-আলোচনার ক্ষেত্রে ‘গ্রাউন্ড-রিয়্যালিটি’র কোনও তথ্যসাবুদও দাবি করা যায় না!
প্রশাসনিক স্তরেও কিন্তু ১৯৮১ সালের সিদ্ধান্ত ঘোষণার আগে সরকারি মহলেই ইংরেজি নিয়ে নানা রকম আলোচনা গবেষণা চলেছে, কমিশন তৈরি হয়েছে, তার রিপোর্ট জমা পড়েছে। অর্থাৎ রাজনৈতিক মত যা-ই থাকুক না কেন, প্রশাসনিক সংস্কার হয়ে ওঠার আগে ইংরেজি বিদায়কেও একটা পদ্ধতির মধ্য দিয়ে হেঁটে যেতে হয়েছে, ইস্তেহার থেকে সে সরাসরি প্রেস কনফারেন্স-এ চলে আসেনি।
|
প্রশ্নটা পরিকাঠামোর |
সুবুদ্ধি ও সুযুক্তির খাতিরে যদি ধরে নেওয়া যায়, শিক্ষার প্রসার এবং অর্থময় প্রসারই আপাতত প্রশাসনের এক ও একমাত্র লক্ষ্য, সে ক্ষেত্রে কিন্তু পরীক্ষা নিয়ে ভাবনাটা শুরু করা উচিত একটা সম্পূর্ণ ভিন্ন জায়গা থেকে। মনে রাখা উচিত যে, দেশের অন্যত্র অবস্থা যেমনই হোক না কেন, পশ্চিমবঙ্গে প্রাথমিক শিক্ষার হাল খুবই করুণ, এবং মাধ্যমিক শিক্ষার হাল করুণতর। সেই আত্যন্তিক করুণতার প্রথম ও প্রধান কারণ, পরীক্ষাব্যবস্থা নয়, অতি-দুর্বল পরিকাঠামো। স্কুলশিক্ষার উন্নতি ও সংস্কার চাইলে তাই প্রথমেই দরকার, পরিকাঠামোর আগাপাশতলা পরিবর্তন। স্কুল, স্কুলঘর, শিক্ষকের সংখ্যা, পড়াশোনার পরিবেশ, ঠিকঠাক ক্লাস হওয়ার বন্দোবস্ত, ছাত্রছাত্রীদের স্কুল যাতায়াতের ব্যবস্থা ইত্যাদি প্রাথমিক ও মৌলিক বিষয়গুলি সংশোধন না করলে যে কোনও সংস্কারই অর্থহীন। প্রতি ক্লাসের বিপুল পাঠ্যক্রমের বোঝা নিয়ে সম্পূর্ণ অ-প্রস্তুত অবস্থায় ছেলেমেয়েরা যখন পরীক্ষায় বসে, তখন ভয় না হওয়াটাই তো অস্বাভাবিক। পরিকাঠামোর উন্নতি হলে কিন্তু তাদের অ-প্রস্তুত অবস্থাটাও পাল্টানোর সম্ভাবনা, নিয়মিত চর্চা ও উপযুক্ত শিক্ষণপদ্ধতি থাকলে তাদের পরীক্ষার মুখোমুখি হওয়ার ক্ষমতাটাও বাড়ার কথা। তা হলেই পরীক্ষার ভয় কমবে, পরীক্ষার কার্যকারিতা বাড়বে।
আর কিছু না হোক, পড়ানোর জন্য যথেষ্ট শিক্ষক চাই, পড়তে বসার জন্য যথেষ্ট জায়গা চাই। অথচ এ রাজ্যের স্কুলগুলিতে ছাত্র-শিক্ষক অনুপাত? অত্যন্ত উদ্বেগজনক। কোনও কোনও জেলায় ভয়াবহ। কিছু কিছু প্রত্যন্ত অঞ্চলে, গোটা স্কুলে এক জনই মাত্র পুরো-সময়ের শিক্ষক। কোথাও আবার (যেমন মুর্শিদাবাদের অনেক জায়গায়) ছাত্র-শিক্ষক অনুপাত ৭৩ অবধি চলে যায়। কোনও অবস্থাতেই কি এক জন শিক্ষকের পক্ষে প্রতি দিন ৭৩ জনকে কোনও বিষয় (অথবা সব বিষয়) ঠিকমত পড়ানো সম্ভব? পরীক্ষার জন্য তাদের প্রস্তুত করা সম্ভব? অথচ, এই অনুপাত কমলে পরীক্ষা ব্যাপারটা তত ভয়ানক না-ই হতে পারে।
আর যদি ছাত্র-ক্লাসঘর অনুপাতের দিকে তাকাই? সে তো আরও সাংঘাতিক। দেখা যাচ্ছে, মুর্শিদাবাদের শমসেরগঞ্জে এই অনুপাত ৮২, সুতিতে ৯৪, রঘুনাথগঞ্জে ৬০, ধুলিয়ানে ৭৮, নদিয়ার নাকাশিপাড়ায় ৭৮, ইত্যাদি। জেলার স্কুলগুলির চেহারা আমরা সবাই অল্পবিস্তর জানি। অনুমান করতে পারি ঘরগুলির আকারও। তার মধ্যে ৭৮? ৮০? ৯০? ছেলেমেয়েগুলি পড়া শেখে সেখানে? পরীক্ষার জন্য রসদ জোগাড় করে?
এ তো গেল, যা নেই তার কথা। আর যা আছে? ক’টা স্কুলে প্রতিদিন ঠিক মতো ক্লাস হয়? শিক্ষকরা নিয়মমাফিক ক্লাসে আসেন? শিশুদের উপযোগী ভাষায় ও পদ্ধতিতে ক’জন শিক্ষক তাদের পড়ান? কেউ পড়া বুঝল কি না, না বুঝলে কী করণীয়, কী ভাবে তাকে প্রয়োজন হলে ক্লাসের বাইরেও পড়াটা বুঝে নিতে সাহায্য করা সম্ভব, কত জন এ নিয়ে মাথা ঘামান? আর তার পরেও পরীক্ষা বস্তুটাকে ছাত্রছাত্রীরা ভয় পায় বলে আমরা পরীক্ষা উঠিয়ে দেওয়ার কথা ভাবি? যেন, পরীক্ষা ছাড়া অন্য কোনও পদ্ধতিতে এই পরিকাঠামোয় এর চেয়ে ভাল কিছু অর্জন করা সম্ভব? উন্নততর শিক্ষা দান ও শিক্ষা লাভ সম্ভব?
|
বিকল্পের পথে যেতে হলে |
অন্য কোনও পদ্ধতির কথা উঠছে এ জন্যই যে আমরা ধরে নিচ্ছি শিক্ষার প্রসার, এবং অর্থময় শিক্ষার প্রসার যদি লক্ষ্য হয়, তা হলে কোনও না কোনও ধরনের একটা ‘ইভ্যালুয়েশন’ বা ‘অ্যাসেসমেন্ট’ থাকতেই হবে। কারণ কোনও মূল্যায়ন ছাড়া, ছাত্রছাত্রীরা কতটুকু বুঝল, কতটুকু বুঝল না, সেই বিচারটারই কোনও অবকাশ থাকে না। কিছুই যদি না থাকে, (মন্ত্রীর সেই প্রথম দিনের কথায় যেন তেমনই একটা সুর ছিল, পরীক্ষা থাকবে না, ইউনিট টেস্ট থাকবে না, ও সব কিছুই থাকবে না,) তা হলে অবশ্য শিক্ষা নিয়ে কথা বলেই লাভ নেই, হীরকরাজার দেশের মতো ‘আজ থেকে পাঠশালা বন্ধ’ বলে স্কুলসমূহ উঠিয়ে দিলেই হয়। ধরে নিচ্ছি, সেটা ঠিক নয়, পরীক্ষা ওঠানোর ভাবনা আসলে আসছে বিকল্প পদ্ধতির ভাবনা থেকে, সম্প্রতি সি বি এস ই যে পথে এগিয়েছে, সেই দিকে। পরীক্ষা জিনিসটাকে একটা স্তর অবধি উঠিয়ে দিয়ে এবং তার পরবর্তী স্তরেও ঐচ্ছিক করে দিয়ে সি বি এস ই কিন্তু খুব দৃঢ় ভাবে বিকল্প পদ্ধতির সন্ধান করছে। কী সেই পদ্ধতি, এবং কী সেই পদ্ধতির দার্শনিক ভিত্তি, সেটা তাদের নথিপত্রে বেশ স্পষ্ট। অনেক দিনের গবেষণার ফলে তৈরি সে সব নথিপত্র।
সি বি এস ই-র বিকল্প পদ্ধতি বলছে একটা ‘কন্টিনিউয়াস অ্যান্ড কম্প্রিহেনসিভ ইভ্যালুয়েশন’-এর (সি সি ই) কথা, অর্থাৎ বছর’ভর লাগাতার মূল্যায়ন, প্রতিটি বিষয়ে প্রতিটি ছাত্র বা ছাত্রী কেমন ভাবে, কতটা এগোচ্ছে, তার নিবিষ্ট পর্যবেক্ষণ। প্রতিটি স্কুল আলাদা ভাবে তার পড়ুয়াদের মূল্যায়নের দায়িত্ব নেবে, তাদের প্রতি স্তর থেকে পরবর্তী স্তরে ঠিকঠাক এগিয়ে দেবে। ‘সি সি ই’ পদ্ধতির কয়েকটা লক্ষ্য প্রথমেই বলে দেওয়া হচ্ছে:
১) মুখস্থ না করে প্রত্যেক ছাত্রছাত্রীর স্বাধীন চিন্তার ক্ষমতা জাগানো,
২) প্রতি ক্লাসে শিক্ষক-ছাত্রের আদানপ্রদানের ভিত্তিতে ছাত্রের অগ্রগতির হিসেব রাখা,
৩) ‘কোয়ান্টিটেটিভ’ বা নম্বর-ভিত্তিক পদ্ধতির বাইরে গিয়ে শেখার ‘কোয়ালিটি’ বা গুণগত মানের উপর জোর দেওয়া। সন্দেহ নেই, এ কাজ যদি সত্যিই করা যায়, দারুণ ব্যাপার, কোনও পরীক্ষা-ব্যবস্থাই এর সঙ্গে পাল্লা দিতে পারে না। মুশকিল হল, আমাদের মতো দেশে, যেখানে পড়ুয়ার সংখ্যা এত বেশি এবং প্রয়োজনীয় সম্পদ ও পরিকাঠামো এত কম, সেখানে কি প্রতি ছাত্রের জন্য এতটা মনোযোগ, অবকাশ, জায়গা সত্যিই দেওয়া সম্ভব? সি বি এস ই স্কুলগুলি অর্থনৈতিক ভাবে অনেক সক্ষম, সেখানকার অভিভাবকরা অনেক গুণ সচেতন শিক্ষার মান বিষয়েও, শিক্ষার অধিকার বিষয়েও। কিন্তু সেখানেও এই সি সি ই পদ্ধতি সত্যিই কার্যকর প্রমাণিত হবে কি না, এখনও তা নিয়ে প্রভূত সংশয় আছে।
আর পশ্চিমবঙ্গের সরকারি ব্যবস্থায়? প্রথমত, বিকল্প ব্যবস্থা হিসেবে এমন কিছু ভাবা হচ্ছে কি না আমরা জানি না। দ্বিতীয়ত, যদি-বা হয়ও, ওই ভাবা অবধিই। বর্তমান পরিকাঠামোয় কোনও ভাবেই এ রকম কিছু ঘটানো সম্ভব নয়, তা আমরা জানি, আমাদের রাজনীতিকরাও জানেন। ভাবের ঘরে ডাকাতি না করে তাই মনে হয়, আপাতত বরং পরীক্ষা-ব্যবস্থার মধ্যে থাকতে থাকতেই ব্যবস্থাটার যথাসম্ভব সংশোধন করা যাক। ভাবা যাক, ছোট ছোট ভাগে পরীক্ষাকে ভেঙে দেওয়া যায় কি না। ইউনিট টেস্টের ধরনেই বছর’ভর ছোট ছোট অ্যাসেসমেন্ট-এর মাধ্যমে বড় অ্যানুয়াল পরীক্ষার ভারটা কমানো যায় কি না। কিংবা, প্রশ্ন এবং লিখিত উত্তরের মধ্যে পরীক্ষা পদ্ধতিকে সীমাবদ্ধ না রেখে হাতে কলমে একক ও দলগত প্রজেক্ট করা যায় কি না। কিংবা, মৌখিক কথোপকথন বা দলবদ্ধ আলোচনার (গ্রুপ ডিসকাশন) ভিত্তিতে মূল্যায়ন করা যায় কি না। তবে হ্যাঁ, কাগজে কলমে সংস্কার হলেই তো হবে না, এর জন্য প্রতিটি শিক্ষকের বিশেষ ট্রেনিং লাগবে, আবশ্যিক ট্রেনিং, সারা রাজ্য জুড়ে। পাশাপাশি, সেই ট্রেনিং-এর ফল ক্লাসঘর অবধি পৌঁছচ্ছে কি না, তার নিয়মিত চেকিং লাগবে, আবশ্যিক, সারা রাজ্য জুড়ে। সে কাজগুলো কিন্তু সহজ নয়। বিশেষত রাজ্যের সাম্প্রতিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে। কিন্তু সহজ কঠিন যা-ই হোক, পরীক্ষার পরিবর্তে অন্য কোনও মূল্যায়ন পদ্ধতি যদি চালু করতে হয়, সেটা শিক্ষকদের যথাযোগ্য ট্রেনিং ছাড়া অসম্ভব, অবাস্তব। তার বিস্তারিত ব্যবস্থা ছাড়া পরীক্ষা-ব্যবস্থায় হাত দেওয়ার একটাই অর্থ: শিক্ষা বস্তুটাকে দ্রুত আরও বড় অর্থহীনতায় পৌঁছে দেওয়া।
মূল কথা একটাই। শিক্ষাক্ষেত্রে গভীরচারী, সুদূরপ্রসারী সংস্কার প্রবর্তন সহজ কাজ নয়। সেটা করার অধিকার একমাত্র প্রকৃত বিশেষজ্ঞেরই আছে। তাঁরাই কেবল জানেন, বহু কালের প্রচলিত একটা ব্যবস্থাকে পাল্টে দেওয়ার দায় কত বিশাল, তার দাবি কত জটিল, তার বিপদ কত বহুমুখী। সুতরাং শিক্ষণ বা পরীক্ষার পদ্ধতিতে কী ধরনের সংশোধন করা যেতে পারে, তা বলুন শিক্ষা-বিশেষজ্ঞরা। আর সেই সংশোধন কী ভাবে স্কুলশিক্ষা ব্যবস্থায় সার্থক ভাবে প্রয়োগ করা যাবে, সেটা বলুন অভিজ্ঞ, দক্ষ প্রশাসকরা।
ছেলেমেয়েরা কোন শিক্ষা কেমন ভাবে পেলে ভাল হয়, সেটা একটা তাত্ত্বিক প্রশ্ন। কী ভাবে সেই শিক্ষা-পদ্ধতি দরিদ্র রাজ্যের ছাত্রসমাজ ও শিক্ষকসমাজের কাছে পৌঁছে দেওয়া যায়, সেটা একটা প্রায়োগিক প্রশ্ন। দুটো প্রশ্নই খুব গুরুতর। খুব জরুরি। কিন্তু দুটো প্রশ্নই এমন ধরনের, যেখানে সহজ চটজলদি পথে হাঁটলে পথটা কেবলই আরও গোলকধাঁধা হয়ে যায়। ধৈর্য ধরে পায়ে পায়ে এগোলে তবু যেন দিনের শেষে কোথাও একটা পৌঁছনোর সম্ভাবনা থাকে। |
|
|
|
|
|