|
|
|
|
প্রবন্ধ ২... |
রাজা হরিশচন্দ্রকে আমরা আজও ভুলতে পারিনি |
খাদ্য নিরাপত্তা আইনই হোক বা সংরক্ষণ, যাঁদের কথা বলে সরকার এই সব কল্যাণনীতি
তৈরি করে, তাঁদের কাছে বিশেষ সুফল পৌঁছয় না। দানধ্যানের পরিবর্তে গরিব মানুষকে
যদি
বাজারের যোগ্য করে তোলা হত, তাতে তাঁদের অনেক বেশি উপকার হত।
সুগত মারজিৎ |
গ্রামীণ কর্মসংস্থান যোজনার পর এ বার নতুন খাদ্যনীতি প্রণয়ন করা হচ্ছে। এই নীতির ফলে দরিদ্র মানুষকে সস্তায় খাদ্যশস্য বণ্টন করা হবে। এক দিকে মূল্যবৃদ্ধির প্রকোপ, অন্য দিকে খুব দরিদ্রদের মধ্যে কর্মহীনতা অথবা অন্যান্য কারণে রোজগারের অভাব সব মিলে নতুন খাদ্য নীতি নিশ্চয়ই দরিদ্র মানুষকে কিছুটা সাহায্য করবে। শোনা যাচ্ছে, দারিদ্রসীমার ঠিক ওপরে আছেন, এমন মানুষরাও এর থেকে উপকৃত হবেন। যত দূর বোঝা যাচ্ছে, তাতে মনে হচ্ছে জাতীয় উপদেষ্টা পর্ষদের পরামর্শ অনুযায়ীই কাজ হচ্ছে। অর্থনীতিবিদদের কথায় খুব একটা আমল দেওয়া হচ্ছে বলে তো মনে হচ্ছে না। কিন্তু, অর্থনীতির কিছু অলঙ্ঘনীয় যুক্তি আছে। মানুষের উপকার করতে গিয়ে শেষ পর্যন্ত যদি তাঁদের ক্ষতি হয়ে যায়, তবে সেটা অন্যায়। দেখা যাক, মানবকল্যাণের নামে যা করা হচ্ছে, যে ভাবে করা হচ্ছে, তা কতখানি যুক্তিগ্রাহ্য।
আমি অর্থনীতির যুক্তি দিয়ে কয়েকটি কথা বলতে চাই। ক্ষমতার অলিন্দে কী হচ্ছে, তা জানার কোনও উপায় তো আমাদের নেই। কিন্তু, কল্যাণমূলক কাজের নামে লাগামহীন অন্যায় যুক্তির বিরুদ্ধে কয়েকটি কথা বলা প্রয়োজন।
দারিদ্রসীমার নীচে (বি পি এল) এবং দারিদ্রসীমার উপরে (এ পি এল) এই বিভাজনের ফলে বার বার দেখা গিয়েছে, দারিদ্রসীমার নীচে থাকা মানুষের জন্য দেওয়া ভর্তুকির খুব কম অংশই প্রকৃতপক্ষে তাঁদের কাছে পৌঁছয়। ধরুন পরিস্থিতিটা এই রকম ১০০ জন গরিব মানুষের জন্য ১০০ টাকা বরাদ্দ করা হলে যাঁরা আসলে দরিদ্র নন, তাঁরাই ৬০ টাকা নিয়ে নেন। বাকিটা প্রকৃত গরিবের কাছে পৌঁছয়। অর্থাৎ, শুধু দরিদ্রদের জন্য মাথাপিছু এক টাকা বরাদ্দ হলে তাঁরা প্রকৃতপক্ষে হাতে পাবেন ৪০ পয়সা। একটা গ্রামে যদি ১০০ জন মানুষ থাকেন, যাঁদের মধ্যে ৫০ জন দরিদ্র, বাকি ৫০ জন নন, সেই গ্রামে যদি প্রত্যেককে এক টাকা করে দেওয়া হয়, তা হলে ৫০ জন গরিবও এক টাকা করেই পাবেন। যদি গরিব মানুষের উপকার করতেই হয়, তবে শুধু তাঁদের জন্য টাকা বরাদ্দ না করে সবার জন্য করা প্রয়োজন। যে সব অঞ্চলে গরিব মানুষরা সংখ্যায় ৭০ শতাংশ বা তারও বেশি, সেখানে বি পি এল-এ পি এল ভাগ না করে সবার জন্য বরাদ্দ রাখা উচিত। তা হলে বি পি এল-দের জন্য বরাদ্দ অর্থ অন্যদের পকেটে যাওয়ার সম্ভাবনা কমে। অনেক জায়গা আছে, যেখানে দরিদ্র মানুষের সংখ্যা জাতীয় গড়ের তুলনায় ঢের বেশি। সেখানে সবাইকে সাহায্য দিলে গরিবের নামে চুরির প্রবণতা কমে। |
|
কিন্তু, সব জায়গাতেই যদি দানছত্র খুলে বসতে হয়, সরকার কুলোতে পারবে না। জঙ্গলমহলে নিশ্চয়ই দারিদ্রসীমার নীচে থাকা মানুষের সংখ্যা ওপরে থাকা মানুষের তুলনায় অনেক বেশি। এই রকম জায়গায় সবার জন্য ভর্তুকির ব্যবস্থা হোক। এই রকম অঞ্চলের কথা বিবেচনা করলে জাতীয় উপদেষ্টা পর্ষদের নীতির সঙ্গে অর্থনীতির যুক্তির খুব প্রভেদ নেই। কিন্তু, দেশের সর্বত্র এই দানছত্র খোলা সম্ভব নয়। উপদেষ্টা পর্ষদ যদি দেশবাসীর চোখের জল মোছাতে দেশব্যাপী দানছত্রের ব্যবস্থা করে, তার জের টানতে হবে সরকারকেই। অর্থনীতির কাণ্ডজ্ঞান না থাকাই যদি মানুষের উপকার করতে পারার ছাড়পত্র হয়ে দাঁড়ায়, সেটা অতি দুর্ভাগ্য। আমার মনে হয়, যাঁরা জাতীয় উপদেষ্টা পর্ষদের সদস্য, তাঁদের আরও একটা পর্ষদের সদস্য করে দেওয়া প্রয়োজন ‘কল্যাণমূলক কাজ করার টাকা কোথা থেকে আসবে’ কমিটি!
বেশ কিছু দিন আগে শুনেছিলাম, রেশন দোকানের দুর্নীতি ঠেকাতে, অথবা রেশনের মারফত ভাল মানের খাদ্যশস্য মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে ‘ফুড কুপন’ ব্যবস্থা চালু হবে। হল না। হলে, তাতে অনেকখানি উপকার হত। আমার ধারণা, এই ক্ষেত্রেও কোনও ‘অল্পবিদ্যা ভয়ঙ্করী’ গোত্রের মানবকল্যাণ বিশেষজ্ঞ বাদ সেধেছেন। বায়োমেট্রিক পদ্ধতিতে দরিদ্র চিহ্নিত করার কাজ শুরু হবে বলে শুনছি। আশা করি, সেই কাজ তাড়াতাড়ি শেষ হবে। তা না হলে, অনেক সচ্ছল মানুষই গরিব মানুষের জন্য চোখের জল ফেলে গরিবের জন্য বরাদ্দ টাকাকড়ি নিয়ে চম্পট দেবেন। শুনলাম, এ বার থেকে নাকি গ্রামে দরিদ্রদের জন্য বরাদ্দ ভর্তুকির টাকা সরাসরি ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে আসবে। অত্যন্ত ভাল কথা। কিন্তু ভয়ে ভয়ে আছি কোনও কল্যাণমুখী উপদেষ্টা হয়তো বলে বসবেন, ও সব করা চলবে না।
কোনও একটি গোষ্ঠীকে নির্দিষ্ট করে যদি শুধু সেই গোষ্ঠীভুক্ত মানুষদের জন্যই সরকার কিছু করতে চায়, তবে তাঁদের চিহ্নিত করার কাজটি খুব ভাল ভাবে করা প্রয়োজন। সেই চিহ্নিতকরণের কাজটি শতকরা একশো ভাগ ঠিক না হলে, যাঁদের জন্য টাকা বরাদ্দ হয়, তাঁরা টাকা পাবেন না। তা হলে কি অন্যদের পাইয়ে দেওয়ার জন্যই উপদেশ দিচ্ছি আমরা? নাকি, গরিব মানুষ তাঁদের জন্য বরাদ্দ ১০০ টাকার মধ্যে ৪০ টাকা পেলেই চলবে, বাকিটা অন্যরা লুটেপুটে খেলেও আমাদের কিছু করার নেই? আমাদের দেশের সংরক্ষণ নীতির কথা ভাবুন। এ দেশে যে এক বার সংরক্ষণের সুবিধে পাবেন, তিনি সংরক্ষিতদের মধ্যে অন্যদের তুলনায় এগিয়ে যাবেন। তার পর, অনন্ত কাল ধরে তাঁর পরিবারের লোকরাই সংরক্ষণের সুবিধা পেতে থাকবে, কারণ প্রথম সংরক্ষণটির দৌলতে এই পরিবারটি অন্যান্য পশ্চাতপদদের তুলনায় অগ্রসর। আমাদের নেতারা ভুলেও বলেন না, যে পরিবার এক বার সংরক্ষণের সুবিধা পেয়েছে, তারা ভবিষ্যতে এই সুবিধা আর পাবে না, অন্যান্যরা পাবে। ফলে, দেশের বিভিন্ন প্রান্তে সংরক্ষণের সুবিধা যাঁদের পাওয়ার কথা, সেই সব গোষ্ঠীর মধ্যে কিছু সংখ্যক মানুষেরই শ্রীবৃদ্ধি হয়। এমন মানুষরা জাতীয় স্তরে খুবই প্রভাবশালী হন। কিন্তু, গোষ্ঠীর প্রায় ৯০ শতাংশ মানুষের অবস্থা আগে যেমন ছিল, তেমনই থেকে যায়। ফলে, পিছিয়ে পড়া গোষ্ঠীর এগিয়ে যাওয়া মুষ্টিমেয় মানুষরা আরও সরব হয়ে আরও সুযোগসুবিধা হাতিয়ে নেওয়ার চেষ্টায় থাকেন। তাই, গরিব মানুষকে দু’টাকায় চাল দেওয়া আর সংরক্ষণ নিয়ে চিৎকার আখেরে তেমন ভাল ফল দেয় না। বার বার দু’টাকায় চাল দেওয়ার দরকার হয়, আরও আরও সংরক্ষণের প্রয়োজন পড়ে। আমি নিশ্চিত, জাতীয় নিরাপত্তা পর্ষদে এই সব নিয়ে তেমন আলোচনা হয় না। বালিতে মুখ লুকোলে কিন্তু বাস্তব পাল্টায় না।
অর্থনীতির একেবারে প্রাথমিক পাঠকে আমরা বারে বারে কেমন তুচ্ছতাচ্ছিল্য করি, দেখা যাক। বাজারে চাল-গমের দাম কত হওয়া উচিত, তা অনেক ক্ষেত্রেই নির্ভর করে বাজারে এই পণ্যগুলির জোগানের ওপর। সরকারই যদি দেশের সবচেয়ে বড় মজুতদার হয়, আর তার মজুতদারির পরিমাণ যদি ক্রমে বেড়েই চলে, তা হলে যত উৎপাদনই হোক না কেন, বাজারে পর্যাপ্ত পরিমাণ চাল-গম আসবে না, এবং তার ফলে দাম বাড়বে। এক দিকে সরকার মজুতদারির পরিমাণ বাড়িয়েই যাবে, অন্য দিকে গ্রামীণ কর্মসংস্থান যোজনার মতো প্রকল্পের মাধ্যমে মানুষের হাতে টাকার পরিমাণ বাড়ায় খাদ্যের চাহিদাও বাড়বে তা হলে দাম বাড়া আটকানোর উপায় কী? এতে বড় চাষিদের লাভ, গরিব মানুষের ক্ষতি। যে চালের দাম কুড়ি টাকা কিলো হওয়া উচিত, সরকার যদি সেই চালই ৩০ টাকায় কিনে ১০ টাকায় বিক্রি করে, তবে বাকি কুড়ি টাকা সরকারকেই দিতে হয়। তখন রাস্তাঘাট হয় না, হাসপাতাল হয় না। সরকার যাঁকে ১০ টাকায় চাল পাইয়ে দিচ্ছে, তিনি বিনা চিকিৎসায় মারা যান। সরকার যদি বড় চাষিদের মুনাফা সুনিশ্চিত করার জন্য ৩০ টাকায় চাল না কিনত, খোলা বাজারে যাতে যথেষ্ট পরিমাণ চাল পৌঁছয় তার ব্যবস্থা করত, তা হলে হয়তো চালের দাম এমনিই কমত। সরকার বাজার অর্থনীতিকে বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ দেখাল, কারণ বড় চাষিদের বিরাগভাজন হওয়ার সাহস কোথায়! অন্য দিকে, গরিব মানুষের জন্য আমরা সব সময় কিছু না কিছু করছি, এমন একটা প্রচারের বাজারে কাটতি আছেই। নির্বাচনের সময় হলে তো কথাই নেই।
আসলে আমাদের অর্থনীতির একটা গোড়ায় গলদ কখনও কাটার নয়। ইন্ডিয়ার জন্য বিশ্বায়ন, প্রতিযোগিতা, ধনতন্ত্রের হাত ধরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো হওয়া, আর ভারতের জন্য বাজারকে ব্রাত্য করে রাখা, প্রতিযোগিতাকে সন্দেহের চোখে দেখা এই দ্বিচারিতা আমাদের মজ্জাগত। দেশের এক দিকটা মার্কিন মুলুকের মতো দেখতে হলেই ধরে নেব উন্নয়ন হয়েছে! দেখতে কেমন, সেটাই এখন সব। আর, যাতে এই মার্কিনায়নের প্রক্রিয়াটি ক্ষতিগ্রস্ত না হয়, তা নিশ্চিত করার দুটো উপায় ছিল। দেশের দরিদ্র মানুষদেরও শিক্ষা, স্বাস্থ্যের ব্যবস্থা করে দিয়ে, তাদের বাজারের যোগ্য করে তুলে সেই প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করতে দিয়ে যুগোপযোগী হয়ে ওঠার সুযোগ করে দেওয়াই হতে পারত যথার্থ পন্থা। কিন্তু, দানধ্যানের রাজনৈতিক মাহাত্ম্যের তুলনায় এ আর কী!
আসলে, রাজা হরিশচন্দ্রকে আমরা ভুলতে পারিনি। |
লেখক অর্থনীতিবিদ, সেন্টার ফর স্টাডিজ ইন সোশাল সায়েন্সেস-এর অধিকর্তা। মতামত ব্যক্তিগত |
|
|
|
|
|