কলকাতা হলে লোকে নির্ঘাত বলত, আহ্ আবগারি ওয়েদার! সকাল থেকে নিভু নিভু আলো। ঝোড়ো হাওয়া। ছিটছাট হাল্কা বৃষ্টি।
লর্ডস মাঠ সংলগ্ন দক্ষিণ লন্ডনের এই সম্ভ্রান্ত পল্লিতে লোকে বলবে, টু টোয়েন্টি ওয়ান বি বেকার স্ট্রিট ওয়েদার। ঠিক এ রকম ধূসর আলো, রাস্তায় কম থাকা পথচারী আর ঝোড়ো হাওয়া অগ্রাহ্য করা ওভারকোট চাপিয়েই তো রহস্যজনক আগুন্তুক বেল বাজাবে ২২১ বি বাড়িটার নীচে। বলবে, মিস্টার হোমস আছেন? সেই হাউন্ড অফ বাস্কারভিলস থেকে শুরু করে অগুনতি কেসে তো এ রকম আবহাওয়াতেই মক্কেলের আবির্ভাব ঘটেছে।
বেকার স্ট্রিটের এই বিশ্ববিখ্যাত বাড়িটা থেকে বিশ্বের অভিজাততম মাঠের দূরত্ব হল গড়িয়াহাট মোড় থেকে প্রিয়া সিনেমা। সেই ডব্লিউ জি গ্রেসের আমলে তৈরি একটা কাল্পনিক গোয়েন্দা চরিত্র। কিন্তু আজও তার এমন মহিমা যে, সোমবার দুপুরেও রাস্তা উপচে হোমস দর্শনার্থীদের ভিড়। এক হাতের মধ্যে বিটল স্টোর্স। আরও একটা দ্রষ্টব্য। ভাবাই যায় না যে। বিদ্রোহ-বন্যায় বিশ্ব সঙ্গীতজগতকে টালমাটাল করে দেওয়া বিটলরা তাঁদের গান রেকর্ডিং করতেন চিররক্ষণশীল এই এলাকার স্টুডিওতে।
আপাতত সেখানে থিকথিক করছে পর্যটকেরা। বেশির ভাগই ভারতীয়। একটু এগিয়ে অক্সফোর্ড স্ট্রিট, মার্বল আর্চ, পিকাডেলি সার্কাস। সব রাস্তায় এত খয়েরি মুখ যে হোয়াইট লন্ডন নয়। মনে হবে ব্রাউন লন্ডন। বাকিংহাম প্যালেসে চেঞ্জ অব গার্ডস শেষ করে রঙিন অশ্বারোহীরা ফিরছে বেকার স্ট্রিট হয়ে লর্ডসের সামনে দিয়ে। আর তাদের দেখামাত্র পর্যটকেরা ছুটছে। কেউ মোবাইল ক্যামেরা। কেউ ভিডিওয় তুলে রাখছে। হইচই। খাওয়া-দাওয়া। দোকান-বাজার। হাইড পার্ক? সে তো প্রতি মিনিটেই জমজমাট। |
আর শহরের কেন্দ্রস্থল দেখে বোঝারই উপায় নেই ধমনী আর শিরাতে কী আবেগ। কী জাতীয় রাজনীতিতে! কী ক্রিকেটে! সেন্ট জেমস পার্ক স্টেশনের কাছাকাছি মিনিট কয়েকের দূরত্বে ভারতীয় টিম হোটেল আর নিউ স্কটল্যান্ড ইয়ার্ড। দুটো স্পটের সামনেই সাংবাদিকদের ভিড় আর ওবি ভ্যান। এখানকার মেট্রোপলিটন পুলিশ প্রধান হচ্ছেন স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের সর্বোচ্চ মাথা। সেই তিনি স্যর পল স্টিভেনসন গতকাল রাতে ফোন কেলেঙ্কারিতে ইস্তফা দেওয়ার পর বাকি অফিসারদেরও পদত্যাগপত্র জমা পড়তে শুরু হয়েছে। এমনই অত্যাশ্চার্য গতিতে ঘুরছে মার্ডখ অধ্যায়ের চাকা যে, দক্ষিণ আফ্রিকা সফররত ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীকে না ইস্তফা দিতে হয়! তিনি দেশে থাকলে মিডিয়ার ভিড় অবধারিত থাকত ১০ ডাউনিং স্ট্রিটের দিকে। না থাকায় মিডিয়া স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডে মনোনিবেশ করল।
ধোনিদের হোটেলের সামনে সংখ্যাধিক্যে অনেক ছোট জমায়েত। বেশির ভাগই সিরিজ কভার করতে আসা ভারতীয় টিভি মাধ্যম। কিন্তু কৌতূহলে ব্রিটিশ মিডিয়ার মতই উদগ্র। হাইড পার্কের কাছে হিলটন হোটেলে সন্ধেবেলা চ্যারিটির জন্য ধোনির ব্যাট নিলাম হবে শুনে তারা দ্রুত লোকেশন বদলাল। জানা গেল, স্ত্রী সাক্ষীর নামে চ্যারিটি ফাউন্ডেশন খুলছেন ধোনি। আজ সেই উপলক্ষেই জমকালো ব্ল্যাক টাই ডিনার। যেখানে একে একে ঢুকলেন ব্রায়ান লারা, কোর্টনি ওয়ালশ, ডেভিড বুন, অ্যালেক স্টুয়ার্ট, ফারুখ ইঞ্জিনিয়ার। হরভজন সিংহও। পেছনের দরজা দিয়ে নাকি সচিনকেও ঢোকানোর কথা। লন্ডনের ‘হুজ হু’ সেখানে। মিডিয়া যথারীতি বাইরে নির্বাসিত। কিন্তু ধোনিকে যে করে হোক ধরতে হবে। তাঁর বিজ্ঞাপনের বিরুদ্ধে হরভজনের পাঠানো উকিলের চিঠিতে অধিনায়কের কী প্রতিক্রিয়া, জানতে হবে। টিম সূত্র থেকে বারবারই বলা হচ্ছে, দু’জনের সম্পর্ক খুব ভাল। এই বিতর্কের কোনও আঁচ দলের ওপর পড়বে না।
কিন্তু অভিজ্ঞরা সিঁদুরে মেঘ দেখছেন। চুয়াত্তরের ইংল্যান্ড সফরে এমনই অগ্নিগর্ভ সর্দারের সঙ্গে প্রকাশ্যে ফাটাফাটি হয়েছিল দলের অধিনায়কের। বিষেণ বেদী বনাম অজিত ওয়াড়েকরের সেই সংঘাতকে কেন্দ্র করে আরও চৌচির হয়ে গিয়েছিল দলের একতা। বেদী বলেছিলেন, “তুমি সম্পূর্ণ অযোগ্য নেতা। ম্যানেজারের পুতুল।” ওয়াড়েকর পাল্টা গলা চড়িয়েছিলেন, “তোমরা সব পটৌডির লোক। আমার টিমের ভাল চাও না।”
ধোনি বনাম হরভজন সেই অভিশপ্ত সফরের স্মৃতি ফিরিয়ে আনবে না তো? এমনিতে সমারসেট ম্যাচ দেখে ভারতকে সামান্য তাচ্ছিল্য করা শুরু হয়েছে। ইয়ান চ্যাপেল লিখেছেন, “প্রথম দুটো টেস্টেই বল বেশি সুইং করবে। পেসারদের সাহায্য করবে। এই দুটোতেই সহবাগ না থাকায় ভারত সমস্যায় পড়বে।” বব উইলিসেরও মনে হচ্ছে, ভারত যথেষ্ট প্রস্তুত নয়। ইংল্যান্ডের পরিবেশে তৈরি হওয়ার সুযোগ পায়নি। ট্রেমলেট আর ব্রডকে ঠিকমতো লেলিয়ে দেওয়া গেলে ওদের কপালে দুঃখ আছে।
সঞ্জয় মঞ্জরেকর অবশ্য ফোনে বললেন, “সচিন খেলে দিলে সহবাগ লাগবে না। দক্ষিণ আফ্রিকায় গিয়ে তো এ বার সহবাগ রান পায়নি। সচিন টানল।” ব্রিটিশ প্রেসও মোটামুটি ব্যাপারটাকে সচিন বনাম তৈরি ইংল্যান্ড পর্যায়ে রেখে দিয়েছে।
নার্সারি এন্ড-এ এ দিন দেখা গেল ঠিক প্র্যাক্টিস নেটের পিছনে তেন্ডুলকরের বড় ছবি লাগানো হয়েছে। পাশে তাঁর মন্তব্য, লর্ডস হল অসাধারণ গুরুত্বপূর্ণ একটা মাঠ। যেখানে সব ব্যাটসম্যানই সেঞ্চুরি পেতে চায়। আমিও ব্যাতিক্রম নই। লর্ডস মাঠে ব্যাট নিয়ে দাঁড়ানোর অনুভূতিটাই আলাদা।
এই প্রথম বোধহয় তেন্ডুলকর সোচ্চারে বললেন লর্ডসে সেঞ্চুরি পাওয়ার তীব্র আকাঙ্খার কথা। আবার আজকের মতো বেকার স্ট্রিট ওয়েদার তৈরি না হলে মঙ্গলবার সকাল ন’টায় তিনি-সহ ভারত প্র্যাক্টিসে নামছে নার্সারি এন্ডেই। যেখানে লন্ডন অলিম্পিকের তিরন্দাজি ইভেন্টটা হবে।
অত বড় বিজ্ঞাপন নেট করতে করতেও চোখ এড়িয়ে যেতে পারে না। আর আমিও ব্যাতিক্রম নই... আমিও এখানে সেঞ্চুরি পেতে চাই যত বার দেখবেন নিশ্চয়ই মনে পড়বে এ মাঠে তাঁর সর্বোচ্চ ৩৭। অন্তত লর্ডসে তাঁর মনোবিদ দরকার নেই। পুরোনো সর্বোচ্চ স্কোরই তো ভোকাল টনিক। |