|
|
|
|
নিরাপত্তায় বাঁধা নন, উত্তরবঙ্গে এক নতুন মুখ্যমন্ত্রী |
নমিতেশ ঘোষ ও কৌশিক চৌধুরী • শিলিগুড়ি |
কাকভোর থেকেই চার দিকে নিরাপত্তার বেড়াজাল। কিন্তু তিনি মানলেন কই!
দার্জিলিং জেলা পুলিশ, ইন্ডিয়ান রিজার্ভ ব্যাটেলিয়ান, বিভিন্ন গোয়েন্দা দফতর থেকে মুখ্যমন্ত্রীর দায়িত্বপ্রান্ত স্পেশ্যাল সিকিউরিটি ইউনিট (এসএসইউ)। প্রশিক্ষিত কুকুর থেকে ‘অ্যান্টি স্যাবোতাজ ইউনিট’। বাদ ছিল না কোনও কিছুই। সব মিলিয়ে মেরেকেটে ১৫ কিলোমিটার যাত্রা পথের জন্য ২ হাজার পুলিশ কর্মী। নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তার মুড়ে ফেলার চেষ্টা হয়েছিল বাগডোগরা থেকে সুকনা। কিন্তু তিনি আসার পরে দিনভর দেখা গেল চেনা ছবিটাই।
বিমানবন্দর থেকে সুকনা পৌঁছনোর পথেই তিনি গাড়ি থেকে নেমে পড়লেন দু’বার। বাগডোগরায় গুরুদ্বারের সামনে দলীয় কর্মী ও আমজনতার মাঝে দাঁড়িয়ে নানা সমস্যার ব্যাপারে খোঁজখবর নিলেন। মঙ্গলবারের সরকারি অনুষ্ঠান নিয়ে কথা বললেন শিলিগুড়ি পুরসভার মেয়র, চেয়ারম্যান, মেয়র পারিষদের সঙ্গে। পরে আবার জাতীয় সড়কের ধারে উত্তরায়ণ উপনগরীর কাছে হঠাৎই নেমে পড়লেন গাড়ি থেকে। উত্তরবঙ্গ উন্নয়ন মন্ত্রী গৌতম দেবকে নিয়ে চূড়ান্ত করে ফেললেন মিনি সচিবালয়ের জায়গাও। সব জায়গায় এগিয়ে সংবাদমাধ্যমের সঙ্গেও কথা বললেন। শুধু তাই নয়, মাটিগাড়ায় দলীয় কর্মীরা ফুল ছেটানোয় দুধ সাদা স্করপিওর গতি কমে গেল তাঁর নির্দেশে।
তিনি মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
গত ২০ মে শপথ নেওয়ার পর এই প্রথম উত্তরবঙ্গ সফরে এলেন। বাম জমানায় প্রায়ই আসতেন বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। আসতেন জ্যোতি বসুও। কিন্তু সংবাদমাধ্যম বা সাধারণ মানুষ তো দূরের কথা, অনেক প্রথম সারির বাম নেতাও মুখ্যমন্ত্রীর ধারেকাছে ভিড়তে পারতেন না। প্রয়োজনে তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী ডেকে নিতেন তাঁদের। দীর্ঘ কয়েক দশক পর এ বারই অন্য ছবি দেখল শিলিগুড়ি এবং লাগোয়া এলাকার মানুষ। |
 |
খুশি। সুকনায় মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। রবিবার। সুমন বল্লভ |
রবিবার মুখ্যমন্ত্রী কলকাতা থেকে বিমানে বাগডোগরা বিমানবন্দরে পৌঁছন ২টো ৫৫ মিনিটে। ৩০ গাড়ির কনভয়ের প্রথমেই ছিলেন এসএসইউ-এর জনা ১৫-২০ কর্মী। দ্বিতীয় সারিতে বিভিন্ন গোয়েন্দা দফতরের অফিসার, কর্মীরা। বাগডোগরা, উত্তরায়ণ হয়ে সুকনায় কনভয় ঢোকে ৩-৫৫ মিনিট নাগাদ। সেখানেও একই ছবি। দলীয় নেতা, মন্ত্রী, বন বিভাগের কর্মী বা সাংবাদমাধ্যমের প্রতিনিধিরা অনায়াসেই পৌঁছতে পারলেন মুখ্যমন্ত্রীর কাছে।
পৌনে ৫টা নাগাদ মমতা জানান, মহানন্দা অভয়ারণ্যে ঢুকবেন। আগাম কোনও খবর, নির্দেশ বা প্রস্তুতি ছিল না পুলিশের। প্রথমে হকচকিয়ে গেলেও দৌড়ঝাঁপ করে সেরে ফেলা হয় প্রস্তুতি। বাংলো থেকে প্রায় ৬ কিলোমিটার রেল লাইন, গভীর জঙ্গলে ঘেরা পথ। সে পথে ছকে বাঁধা ‘নিরাপত্তা’ তখন কোথায়! মাঝে নুড়িপাথরের কাঁচা রাস্তায় কাদাজলে গাড়ির চাকা ও নীচের অংশ আটকাতে থাকায় বেশ কয়েক জন পুলিশ কর্তা কনভয় ছেড়ে ফিরেও এলেন। মুখ্যমন্ত্রী পৌঁছলেন গুলমা বিটের একটি ওয়াচ টাওয়ারে। সঙ্গে দলের নেতা-মন্ত্রী-আমলা সবাই। প্রায় আধ ঘণ্টা ওয়াচ টাওয়ারে থেকে বন বিভাগের সাধারণ কর্মী ও অফিসারদের কাছ থেকে অভয়ারণ্যের অবস্থা, সমস্যার কথা জেনে নেন মুখ্যমন্ত্রী। সংক্ষিপ্ত জঙ্গল সফরে খানিক হাসিঠাট্টাও করেন। তত ক্ষণে সন্ধ্যা নেমে এসেছে।
বহু ভিভিআইপি ও মুখ্যমন্ত্রীদের দেখেছেন সুকনা বন বিভাগের কর্মীরা। কিন্তু এ ভাবে নয়!
এখানেই শেষ নয়! কিলোমিটার খানেক এগিয়ে আচমকা মুখ্যমন্ত্রী ঢুকে পড়েন জঙ্গল লাগোয়া খয়রানি বস্তিতে। ২০-২৫ ঘর আদিবাসী ও নেপালি সম্প্রদায়ের বাস। গাড়ি থেকে নেমে মুখ্যমন্ত্রী ঢুকে পড়লেন মীনা শর্মার গোয়ালঘরে। খোঁজখবর নিলেন, কেমন করে কী চলছে তাঁর সংসারে। এর পরে তিনি ঢুকে পড়েন রাজীব সুব্বার রান্নাঘরে। কথা বলেন, শোনেন সমস্যার কথা। কখনও সস্নেহ হাত রাখেন কিছুই বুঝে না ওঠা বাচ্চাদের মাথায়। সেখানে মুখ্যমন্ত্রীর নিরাপত্তা বলতে তখন চারপাশে খয়রানি বস্তির অবাক মুখগুলি। এর পরে আর একটি বাড়িতে ঢুকে চেয়ার টেনে বসে পড়েন নিজেই। চা ভালবাসেন। তাই দিয়েই যথাসাধ্য আপ্যায়নে ব্যস্ত হন সাবিত্রী শর্মা। ৩-৪ চুমুক চা খাওয়ার ফাঁকেও গ্রামের অবস্থা, সংসারের অবস্থার কথা সবিস্তার শুনতে থাকেন মুখ্যমন্ত্রী। বন বিভাগের অফিসারদের ডেকে জানতে চান বাসিন্দাদের সাহায্য করা হয় কি না, সে সম্পর্কেও। স্থানীয় কিশোরীরা ছুটে এসে প্রণাম করেন মুখ্যমন্ত্রীকে। বনবস্তির আচমকা সফর শেষ করে সন্ধ্যা ৬টা নাগাদ সুকনা বনবাংলোয় ফেরেন। এ দিনেরর মতো স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন পুলিশ কর্তারা।
এ দিকে পিনটেল ভিলেজের লাগোয়া মাঠে রাতভর চলছে মাটি ফেলার কাজ। পাঁচিল ঘেরা এই মাঠেই হবে প্রতীক্ষিত চুক্তি সই। এক হাজার জনের বসার ব্যবস্থা করা হচ্ছে। মঞ্চ তৈরি। |
|
|
 |
|
|