পরীক্ষার মুখেও তৃপ্তির জন্মদিন
পাতলেবাসের সেই বাড়ির সামনে সকাল থেকেই ভিড়।
পাতলেবাস? দার্জিলিং সদর থেকে প্রায় আট কিলোমিটার দূরে, সরু পাহাড়ি রাস্তায় নর্থ পয়েন্ট স্কুল পেরিয়ে আরও প্রায় দু’হাজার ফুট নীচে নামলে যে গ্রামটির দেখা মেলে। রবিবার সেই গ্রামটিই যেন হয়ে উঠেছে দার্জিলিং পাহাড়ের প্রাণকেন্দ্র।
না, একটু ভুল হল। পুরো পাতলেবাস নয়, ভিড়টা তো শুধু রাস্তার ধারে একটা সাদামাঠা পাকাবাড়ি ঘিরে। যে বাড়ির খোলা দাওয়ায় সারি পেতে রাখা গোটা পঞ্চাশেক প্লাস্টিকের চেয়ার। তার মধ্যে আকাশি রঙের একটি চেয়ারে বসে আছেন বাড়ির মালিক। মুখের হাসিতে রাজনীতির থেকেও অনেক বেশি করে রয়েছে তৃপ্তি। প্রশান্তিও।
কারণ, সাদা সার্টের উপরে ক্রিম রঙের কেতাদুরস্ত ব্লেজার পরনে ওই মানুষটি এ দিন ৪৭ পূর্ণ করে ৪৮ বছরে পা দিলেন। তার থেকেও বড় কারণ, ২৪ ঘণ্টার মধ্যে সই হতে চলেছে যে পাহাড় চুক্তি, তার তিন পক্ষের অন্যতম তাঁর দল গোর্খা জনমুক্তি মোর্চা।
এ বারের জন্মদিনটা তাই অন্যরকম ছিল বিমল গুরুঙ্গের কাছে। কপালে লম্বাটে লাল তিলক। পরের পর এগিয়ে আসছে অভিনন্দনের হাত। আট থেকে আশি, বাদ নেই কেউ-ই। বড়রা পরিয়েছেন খাদা, দিয়েছেন ফুল। ছোটরা চকোলেট হাতে দিয়ে প্রণাম করলেই তাদের বুকে টেনে নিয়েছেন গুরুঙ্গ। কেক খাইয়ে দিয়েছেন নিজের হাতে। পাহাড়ের নতুন স্বশাসিত পরিষদের নামে কেন ‘দার্জিলিং’ নেই এই বিতর্ক এ দিন ঘেঁষতে পারেনি কাছে। বরং যে-ই প্রশ্ন নিয়ে হাজির হোক (যেমন এই প্রতিবেদক), পেয়েছে গুরুঙ্গের অভ্যর্থনা। এবং তাঁর ইশারায় বাড়ির মেয়েরা এগিয়ে এসেছেন লাড্ডু, মিষ্টি, আলুর দম বোঝাই শালপাতার প্লেট নিয়ে।
অভ্যর্থনা। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে খাদা পরাচ্ছেন মোর্চা সভাপতি
বিমল গুরুঙ্গ। রবিবার সুকনা বনবাংলোয়। অনিন্দ্য জানা
গত চার বছরে ১৭ জুলাইটা সে ভাবে পালন করা হয়নি গুরুঙ্গের। হবেই বা কী করে? কখনও তিনি টানা বন্ধ ‘সফল’ করতে ব্যস্ত। কখনও নানা মামলায় জেরবার নেতা-অনুগামীদের কী ভাবে আগলানো যায়, সেই পরিকল্পনা করছেন। আন্দোলন চালাতে চেয়েচিন্তে টাকা জোগাড়ের ব্যাপারেও মূল দায় ছিল তাঁর। কাজেই জন্মদিন-টিন হওয়ার প্রশ্নই ছিল না।
এ বার ছবিটা পুরো বদলে গিয়েছে। প্রতীকী ভাবে বলা যায়, জোড়া কেক সহযোগে জন্মদিন পালন হচ্ছে গুরুঙ্গের। রবিবার একটি কেক নিজে কাটলেন। আজ, সোমবার দ্বিতীয় ‘কেক’ (অর্থাৎ গোর্খাল্যান্ড টেরিটোরিয়াল অ্যাডমিনিস্ট্রেশন বা জিটিএ) পেতে চলেছেন তিনি। যাতে (ত্রিপাক্ষিক চুক্তিতে) তাঁর দলের হয়ে সই করছেন তাঁরই প্রধান সেনাপতি হিসেবে পরিচিত রোশন গিরি।
সোমবারের সেই চুক্তি-অনুষ্ঠানের আগে রবিবার গুরুঙ্গের বাড়ির উঠোনে তাই যেন ছোটখাটো দলীয় বৈঠকই বসে গিয়েছিল। বেলা তখন সাড়ে ১২টা। মোর্চা প্রধানের বাড়িতে ঢুকে দেখা গেল, রোশন গিরি-সহ দলের সব প্রথম সারির নেতাই সেখানে বসে। আর কোনও ঢাকঢাক গুড়গুড় নেই, সাংবাদিকের সামনেই চলল তাঁদের সঙ্গে গুরুঙ্গের আলোচনা। কী ভাবে, কত তাড়াতাড়ি পাহাড়ের গরিবদের দারিদ্রসীমার উপরে আনা যাবে, তা নিয়ে কথা বলছিলেন ওঁরা। সুবাস ঘিসিংয়ের সঙ্গে চুক্তির পরে কেন্দ্র ও রাজ্যের বরাদ্দ টাকা যে ভাবে নয়ছয়ের অভিযোগে পাহাড় উত্তাল হয়ে উঠেছিল, সেই প্রসঙ্গও ঘুরেফিরে উঠেছে। মোর্চা সভাপতি সকলকে সতর্কও করে দিয়েছেন। পাহাড় ও সমতলের মধ্যে যাতে কোনও বিভেদ, ভুল বোঝাবুঝি না হয়, সে ব্যাপারে প্রতিটি এলাকার নেতাকে অতিমাত্রায় সাবধান থাকার নির্দেশও দিয়েছেন তিনি। অনুগামীদের গুরুঙ্গ বলেছেন, “পাহাড়-সমতল মিলেমিশেই এগোবে। উন্নয়ন হবেই। বাকি যা বলার কাল বলব।”
জন্মদিনে নিজের বাড়িতে গুরুঙ্গ। বিশ্বরূপ বসাক
গুরুঙ্গের মতো পাহাড়-সমতল ঐক্য বজায় রাখার সুর এ দিন তাঁর দলের প্রথম সারির নেতাদের গলাতেও। দার্জিলিং বিতর্ক উস্কে দেওয়া গেল তখনই, “গোর্খাল্যান্ড টেরিটোরিয়াল অ্যাডমিনিস্ট্রেশন হওয়া মানে ভবিষ্যতে দার্জিলিং নামটাই থাকবে না বলে অনেকে আশঙ্কা করছেন। এটা নিয়ে আপনারা কিছু বলছেন না কেন?” মোর্চার প্রথম সারির নেতাদের এক জন বললেন, “এ সব প্রশ্ন যাঁরা তুলছেন, তাঁরা একটু তলিয়ে ভাবছেন না কেন? তর্কের খাতিরে ধরলাম, দার্জিলিঙের নাম তুলে দেওয়া হল। কিন্তু কার্শিয়াং-কালিম্পং? সেই নামগুলোও তো নেই। সে কথা কেউ বলছেন না কেন? সব ফালতু বিতর্ক! আসলে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যই রয়েছে এ সবের পিছনে।” পাশ থেকে এক প্রবীণ মোর্চা নেতা বললেন, “আরে বাবা, জেলাটা তো দার্জিলিংই থাকছে। দার্জিলিঙের ডিএম, এসপি তো শিলিগুড়িরও দায়িত্বে থাকবেন। তার পরেও বিতর্কের মানে হয় না।”
আপাতত এই বিতর্ক নিয়ে বিন্দুমাত্র উৎসাহী নয় দার্জিলিং। বরং হোটেল মালিক থেকে দিনমজুর, চা শ্রমিক থেকে বেকার যুবক-যুবতী, সকলেই চাইছেন যত দ্রুত সম্ভব কাজ শুরু করুক ‘জিটিএ’। রংবুলে ছোট্ট দোকান চালান অমৃতা রাই। মধ্যবয়সী গৃহবধূ সুবাস ঘিসিংয়ের আন্দোলন দেখেছেন, চুক্তি সইও দেখেছেন। বলছেন, “তার পর কী হয়েছে, দেখেছি তা-ও!” আর এখন? অমৃতা দেবী বললেন, “এখন শান্তি ফিরেছে। চুক্তিটা হলে পুরোপুরি নিশ্চিন্তে ব্যবসা করতে পারি। কী নামে চুক্তি হল, তা নিয়ে ভেবে লাভ কী!”
শিলিগুড়িতে জমি দেখছেন মিনি সচিবালয়ের জন্য। রবিবার।-সুমন বল্লভ
সোনাদা স্টেশনের ধারে ব্যানার টাঙাচ্ছিলেন এক দল যুবক-যুবতী। তাতে লেখা রয়েছে, চুক্তি সইয়ে যাঁরা অংশগ্রহণ করছেন, তাঁদের সকলের জন্য রইল পাহাড়বাসীর শুভকামনা। কাজের দেখভাল করছিলেন অমৃত প্রধান। বয়স ২৫ বছর। মোর্চার সোনাদা-টুং যুব শাখার আহ্বায়ক। অমৃত বললেন, “এখন আমরা নানা স্কুলে বিনে পয়সায় পড়াই। কেউ কম্পিউটার শিখে, কেউ এমবিএ-সহ নানা ডিগ্রি, ডিপ্লোমা নিয়ে বসে রয়েছি। আশা করি কালকের পরে আমাদের হতাশা দ্রুত কেটে যাবে। যাঁরা ভাবছেন আমরা আলাদা হচ্ছি, তাঁরা ভুল ভাবছেন। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় আমাদের সঙ্গে রয়েছেন। ওঁর সাহায্যে আমরা নিজের পায়ে দাঁড়াতে চাইছি। দেখবেন, জিটিএ হলে নবজন্ম হবে আমাদের।”
আজ, সোমবার সুকনার পিনটেল ভিলেজে যে চুক্তি সই হতে চলেছে, তাকে ঘিরে বিশেষত তরুণ প্রজন্মের প্রত্যাশা এমনই আকাশছোঁয়া। গুরুঙ্গও সেটা জানেন।
জন্মদিনের ২৪ ঘণ্টার মাথায় সেই নতুন চ্যালেঞ্জের মুখেই পড়তে চলেছেন মোর্চা প্রধান।
Previous Story Uttarbanga Next Story



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.