|
|
|
|
এক দিন আগেই বার্তা দিল শুভেচ্ছা বৈঠক |
অনিন্দ্য জানা • সুকনা |
চব্বিশ ঘণ্টা আগেই পাহাড়-চুক্তির ‘মুখবন্ধ’ রচনা করে দিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
আজ, সোমবার ‘ঐতিহাসিক’ চুক্তি সইয়ের আগে রবিবার রাতে সুকনার বনবাংলোয় মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে এসে দেখা করলেন গোর্খা জনমুক্তি মোর্চার নেতা বিমল গুরুঙ্গ। এমনিতে নিছকই গুরুঙ্গের তরফে ‘জন্মদিনের আর্শীর্বাদ প্রার্থনা’ এবং মুখ্যমন্ত্রীর তরফে পাল্টা ‘শুভেচ্ছা’। কিন্তু এই বৈঠকের ‘তাৎপর্য’ সুদূরপ্রসারী। যেমন ইঙ্গিতবাহী চুক্তি সইয়ের আগের দিন এই শুভেচ্ছা বৈঠকের ‘বার্তা’।
সারা দিন পাহাড়ে কাটিয়ে রাত ৯টা নাগাদ সুকনা বনবাংলোয় গুরুঙ্গ এসেছিলেন মোর্চার নেতা রোশন গিরি এবং অন্য পারিষদদের একাংশকে নিয়ে। মমতার সঙ্গে ছিলেন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী মুকুল রায় এবং উত্তরবঙ্গ উন্নয়ন মন্ত্রী গৌতম দেব। মুখ্যমন্ত্রীর জন্য মিষ্টি নিয়ে এসেছিলেন গুরুঙ্গ। আর এনেছিলেন ‘খাদা’ (নেপালিদের সম্ভ্রমসূচক উত্তরীয়)। সেই ‘খাদা’ যখন একে একে মমতার গলায় পরিয়ে দিলেন মোর্চা নেতারা, সম্ভবত তখনই সূচনা হয়ে গেল পাহাড় সমস্যা সমাধানের। অন্তত প্রতীকী অর্থে। অতিথিদের মমতা দিলেন রসগোল্লা।
প্রায় আধ ঘণ্টা কথা হল মমতা-গুরুঙ্গের। তার যে খুব কোনও রাজনৈতিক বা প্রশাসনিক তাৎপর্য রয়েছে, তা নয়। জন্মদিনের জন্য অকুণ্ঠ শুভেচ্ছা, সোমবারের চুক্তির আগে প্রস্তুতি কেমন হচ্ছে, পাহাড়ের প্রতিক্রিয়া কী মূলত এই সবই। কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পি চিদম্বরম যে আসছেন, গুরুঙ্গদের তা-ও জানালেন মমতা। বাংলো ছাড়ার আগে গুরুঙ্গ জানিয়ে গেলেন, তিনি খুশি। ‘ঐতিহাসিক’ চুক্তির ফলে খুশি পাহাড়ের মানুষও। |
 |
মহানন্দা অভয়ারণ্যের ওয়াচটাওয়ারে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। রবিবার। অনিন্দ্য জানা |
মমতা অবশ্য শুরু থেকেই যথেষ্ট ‘নিশ্চিন্ত’ ছিলেন। যে কারণে সুকনায় পৌঁছেই তিনি চলে গিয়েছিলেন গভীর অরণ্যে। খানিকটা খেলাচ্ছলেই এ দিন বিকেলে মুখ্যমন্ত্রীকে বাংলোর বনকর্মীরা বলেছিলেন, ভোর ৫টায় এই বাংলোর হাতায় ঢুকে কলাগাছ খেয়ে গিয়েছে মহানন্দা অভয়ারণ্যের বৃহদাকার দাঁতাল। যা শুনে মমতা বলে বসলেন, তিনি অরণ্যের গভীরে যেতে চান! সুকনা বনবাংলোর কর্মীরা চমৎকৃত। খানিকটা বিস্মিতও বটে। কারণ, যিনি বনের গভীরে গিয়ে হস্তিদর্শনের বাসনা প্রকাশ করছেন, তিনি পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী! সুকনা থেকে কয়েক কিলোমিটার দূরে পিনটেল ভিলেজে যিনি ‘ঐতিহাসিক’ পাহাড়-চুক্তি স্বাক্ষর অনুষ্ঠানে এসেছেন!
মমতা কিন্তু গেলেনই।
আর গেলেন তো গেলেন, একেবারে ‘কোর-এরিয়ায়’! রেল লাইনের পাশে ওয়াচ-টাওয়ারে উঠে পড়লেন। বনকর্মীদের সঙ্গে ছবি তুললেন। কথা বললেন। (যে কর্মীরা পরে জানালেন, যত দূর মনে পড়ছে, শেষ বার এখানে এসেছিলেন অধুনা-প্রয়াত মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু।) আসার পথে হুট করে ঢুকলেন খয়রানি নামের এক আপাত-অখ্যাত বনগাঁয়ে। নেপালি অধিবাসীদের সঙ্গে কথা বললেন। অক্লেশে চা চেয়ে খেলেন। ঢুকে পড়লেন তাঁদের রান্নাঘরে (যে বসতবাড়িতে, কাউকে প্রশ্ন না-করেই লিখে ফেলা যাক, পা পড়েনি এমনকী, ছোটখাট কোনও মন্ত্রীও। মুখ্যমন্ত্রী তো অনেক দূরের গ্রহ)। ফেরার পথে মমতাকে খানিকটা বিমর্ষও দেখাল যে, কোনও জন্তু-জানোয়ার দেখা গেল না। বললেন, “আসলে গাড়ি নিয়ে জঙ্গলের ভিতরে এলে ওরা বিরক্ত বোধ করে! এর পর চুপিচুপি আসতে হবে।”
এটা মনে করার কোনও কারণ নেই যে, কলকাতা থেকে এত দূর ঠেঙিয়ে কেন্দ্রীয় মন্ত্রী মুকুল রায়, দীনেশ ত্রিবেদী এবং ছায়াসঙ্গী তরুণ শিল্পোদ্যোগী শিবাজি পাঁজাকে নিয়ে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী স্রেফ অভয়ারণ্য দেখতে এসেছেন। (বস্তুত, কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পি চিদম্বরমের আপত্তিতে পাহাড়ে না-হয়ে সুকনায় চুক্তি সই হওয়ায় ঈষৎ ক্ষুণ্ণ মুখ্যমন্ত্রী। তিনি চেয়েছিলেন, সমতলে নয়, পাহাড়ে গিয়েই চুক্তি সই হোক। কিন্তু চিদম্বরম এই ভরা বর্ষার মরসুমে ধসের আশঙ্কায় কিঞ্চিৎ উচাটন. ফলে পাহাড়ের পাদদেশে এই সুকনা!) ততখানি বালখিল্যতা থাকলে তিনি ৯ কোটি ১৩ লক্ষ মানুষের দণ্ডমুন্ডের কর্ত্রী হন না। মমতা আসলে বন-সফরের মধ্যে দিয়ে বুঝতে চেয়েছেন, যে পাহাড়-সমস্যার সমাধান তিনি করতে চলেছেন আর ২৪ ঘণ্টার মধ্যে, আমজনতার মধ্যে তার প্রতিক্রিয়া কেমন। নইলে কি আর বিমান থেকে নেমে উত্তরবঙ্গ উন্নয়ন মন্ত্রী গৌতম দেবকে প্রথম প্রশ্ন করেন, “এখানকার মানুষের রি-অ্যাকশন কী?” আর বোঝাতে চেয়েছেন, তিনি সমতলের নন, পাহাড়েরও মুখ্যমন্ত্রী। সেই জন্যই ‘ইতিহাস’ তৈরি করতে এসেছেন। |
 |
শিলিগুড়ির সুকনা ফরেস্ট বাংলোয় মুখ্যমন্ত্রী। রবিবার। সুমন বল্লভ |
ইতিহাস? মমতার নিজের কথায়, “অত জানি না। শুধু এটা জানি যে, আমি পাহাড়ের সমস্যার সমাধান করতে চাই আন্তরিক ভাবে। রাজ্যভাগ না-করেই। আমি এটা দেখাতে চাই যে, সদিচ্ছা থাকলে সমস্যার সমাধান করা যায়। আর বলতে চাই, রাজ্যে ক্ষমতায় আসার আগে যে প্রতিশ্রুতি আমি দিয়েছিলাম, তা মুখের কথা ছিল না। কাজেও সেটা আমাদের সরকার করে দেখাচ্ছে!” মুখ্যমন্ত্রী যা বললেন না, তা হল এই চুক্তির মাধ্যমে তিনি গোটা দেশের কাছে এক অনুচ্চারিত ‘বার্তা’ দিতে চান। যে ‘বার্তা’ বলবে, ‘দার্জিলিং মডেলে’ চাইলে দেশের সমস্ত প্রান্তের সমস্যার (তেলেঙ্গানা-সহ) সমাধান করা যেতে পারে।
পুরনো ‘ইতিহাস’ বলছে, আজ থেকে ২৩ বছর আগে ‘সামগ্রিক জাতীয় স্বার্থে’ এবং তৎকালীন ‘প্রধানমন্ত্রী রাজীব গাঁধীর আহ্বানে সাড়া দিয়ে’ যে ‘গোর্খাল্যান্ড স্বশাসিত পরিষদ চুক্তি’ হয়েছিল, তার অনুষ্ঠান হয়েছিল সুকনা থেকে বহু দূরে। কলকাতার রাজভবনের ব্যাঙ্কোয়েট হলে। ছিলেন তৎকালীন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বুটা সিংহ এবং তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু। তাঁরাও চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছিলেন। আর সই করেছিলেন তৎকালীন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রসচিব সি জি সোমাইয়া, রাজ্যের মুখ্যসচিব রথীন সেনগুপ্ত এবং তদানীন্তন জিএনএলএফ প্রধান সুবাস ঘিসিং।
সেই চুক্তি সই হয়েছিল সকাল ১০টায়। এই চুক্তি সই হবে দুপুর তিনটেয়। মমতা এবং চিদম্বরম ছাড়াও থাকবেন রাজ্যের মুখ্যসচিব সমর ঘোষ, স্বরাষ্ট্রসচিব জ্ঞানদত্ত গৌতম। থাকবেন দুই কেন্দ্রীয় মন্ত্রী দীনেশ ত্রিবেদী, মুকুল রায় এবং রাজ্যের মন্ত্রী সুব্রত মুখোপাধ্যায়, মণীশ গুপ্ত, করিম চৌধুরীরা। থাকবেন বিমল গুরুঙ্গ। যাঁর জন্মদিনের জন্য মমতা এক দিন পিছিয়ে দিয়েছিলেন চুক্তি সই। এবং রাজ্যের রাজধানী কলকাতা নয়, এই চুক্তি সই হবে একেবারে পাহাড়ের ছোঁয়াচ লাগিয়ে। পুরোপুরি নেপালি ভাষাভাষী অধ্যুষিত এলাকার মধ্যে। (যে কারণে, শিলিগুড়ি সার্কিট-হাউসে থাকার পরিকল্পনা বাতিল করে সুকনায় এসে উঠেছেন মমতা। যেখানে দলের খুচরো নেতাদের আনাগোনা কঠোর ভাবে নিষিদ্ধ করা হয়েছে।) যে এলাকা শুরু হয়ে গিয়েছে বাগডোগরা থেকে এসে দার্জিলিং মোড় থেকে বাঁ-দিকে ঘুরতেই। যে যাত্রাপথে অগুন্তি নেপালি জনতা গোর্খা জনমুক্তি মোর্চার সবুজ-সাদা-হলুদ তেরঙা পতাকা নিয়ে মুখ্যমন্ত্রীকে দু’হাত তুলে স্বাগত জানিয়েছে। গাড়ি থামিয়ে গলায় পরিয়েছে ‘খাদা’ (নেপালি সম্ভ্রমসূচক উত্তরীয়)। মমতার স্লোগান ‘মা-মাটি-মানুষ’-এর হিন্দি অনুবাদে তাঁদের হাতে প্ল্যাকার্ড দেখা গিয়েছে ‘জন-জননী-জন্মভূমি’।
আশ্চর্য নয়। একেবারেই আশ্চর্য নয় যে, মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পর প্রথম উত্তরবঙ্গ সফরে এখনও পর্যন্ত ‘সুখী’ মমতা। |
 |
শিলিগুড়ির সুকনা বনবাংলোয় মুখ্যমন্ত্রী। রবিবার। নিজস্ব চিত্র |
তাঁর আমলে উত্তরবঙ্গ যে ‘অবহেলিত’ থাকবে না, তা বোঝাতে বিমানবন্দর থেকে আসার পথে উত্তরায়ণের পাশে মাটিগাড়ায় মমতা ‘উত্তরবঙ্গের মহাকরণ’-এর জন্য মন্ত্রী গৌতমবাবুর দেখে-রাখা পাঁচ একর জমি দেখে এসেছেন। (আপাতত সচিবালয়ের জন্য মাটিগাড়ায় একটি বাড়ি নেওয়া হয়েছে। কিন্তু মমতা চান, নতুন সচিবালয় একেবারে নতুনই হোক।) প্রাথমিক ভাবে মুখ্যমন্ত্রীর জমিটি পছন্দও হয়েছে। তিনি বলেছেন, “কনফারেন্স হল, পার্কিং সমস্ত করতে হবে। আমার ঘরও করতে হবে। এখানে নতুন মহাকরণ হওয়ার পর আমি মাঝেমধ্যেই এসে থাকব। উত্তরবঙ্গ আমার প্রাণের খুব কাছাকাছি।” মুখে যেমন এ কথা বলেছেন, তেমনই ‘বার্তা’ দিয়েছেন নিজের কর্মপদ্ধতিতে দ্বিতীয় মহাকরণের জন্য জমি দেখে সুকনার পথে রওনা দেওয়া সেই ‘সঙ্কেত’ই দিচ্ছে যে, উত্তরবঙ্গকে গুরুত্ব দিচ্ছেন মুখ্যমন্ত্রী। পাহাড়-চুক্তি সই তারই প্রথম ধাপ।
চুক্তি-সই অনুষ্ঠানে অবশ্য থাকছেন না বিরোধী দলের তরফে কোনও নেতা। তবে তা নিয়ে চিন্তিত নন মুখ্যমন্ত্রী। কারণ, তাঁর তরফে সৌজন্য দেখিয়ে প্রধান বিরোধী দল সিপিএম-সহ অন্যদেরও আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। সেই আমন্ত্রণ বিরোধী শিবির ‘প্রত্যাখ্যান’ করায় পাহাড়ের মানুষ তাঁদের ‘সদিচ্ছা’ নিয়েই সন্দিহান হবেন বলে শাসক দলের নেতারা মনে করছেন। তৃণমূলের এক প্রথম সারির নেতার কথায়, “সিপিএম যে ইচ্ছা করেই পাহাড়ের সমস্যার সমাধান করেনি, সেটা এ বার পাহাড়ের মানুষ বুঝতে পারবেন!” সিপিএম প্রশ্ন তুলেছে চুক্তিতে কী আছে, তা তাদের অজ্ঞাত। দ্বিতীয়ত, চুক্তির যে অংশাবলি সংবাদমাধ্যমে ইতিমধ্যেই প্রকাশিত, তাতে রাজ্যভাগের আশঙ্কা উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না। প্রশাসনিক সূত্রের অবশ্য খবর, রাজ্যভাগের কোনও প্রশ্নই নেই! ২৩ বছর আগের চুক্তি যেমন ‘রাজ্যের আইনের আওতায়’ হয়েছিল, এ বারও তার কোনও ব্যত্যয় হচ্ছে না। আলাদা রাজ্যের দাবি যে তিনি মানবেন না, রেলমন্ত্রী হিসেবে পাহাড়ে গিয়ে বিমল গুরুঙ্গদের তা সাফ জানিয়ে এসেছিলেন মমতা। বাস্তবেও তার অন্যথা হচ্ছে না।
অতীত ইতিহাস বলছে, ১৯৮৮ থেকে ২০০৫ পর্যন্ত পার্বত্য পরিষদের চেয়ারম্যান ছিলেন ঘিসিং। তিনটি মেয়াদে। ২০০৫-এ হওয়ার কথা ছিল চতুর্থ নির্বাচন। কিন্তু বামফ্রন্ট সরকার ভোট না-করে ঘিসিংকে পরিষদের কেয়ারটেকার নিযুক্ত করে। তার পর থেকেই পাহাড়ের অবস্থার অবনতি ঘটে। ঘিসিংয়ের জনসমর্থন চলে যায় একদা তাঁর সঙ্গী গুরুঙ্গের হাতে। ইস্তফা দিতে বাধ্য হন ঘিসিং। রাজ্য সরকার বিভিন্ন আইএএস অফিসারকে পর্যায়ক্রমে ‘প্রশাসক’ নিয়োগ করে।
ছ’বছর পর সেই ‘অচলাবস্থা’র অবসান হতে চলেছে। তেইশ বছর পর ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি হচ্ছে মমতার হাত ধরে।
পুনরাবৃত্তি? নাকি আসলে নতুন ইতিহাসই লিখছেন নতুন মুখ্যমন্ত্রী? যার সূচনা এ দিন রাতে কার্যত হয়েই গেল সুকনা বনবাংলোয়। |
|
|
 |
|
|