পরিবর্তনের লর্ডসে সচিনের শততমের গায়েও বাণিজ্যের রং
তিনটে নমিনেশন থাকা মনে হচ্ছে অনিবার্য! রোববার থেকে আগামী শনিবার পর্যন্ত ভরা গ্রীষ্মকালীন ইংল্যান্ডের যে সপ্তাহটা কাটবে তার সপ্তাহসেরা নির্বাচনে।
বৃষ্টিভেজা লর্ডস।
রুপার্ট মার্ডখ।
সচিন তেন্ডুলকর।
সপ্তাহের প্রথম দিনটা অবশ্য লর্ডস মোটেও বৃষ্টিভেজা নয়। বৃষ্টিতে চোবা। বৃষ্টির বোলিং অ্যাটাক ছিল মোটামুটি দু’ধরনের। ভারী এবং মাঝারি। সেটাকে দিব্যি অগ্রাহ্য করে দেখলাম লর্ডসের ভেতর লোকজন ঘোরাঘুরি করছে এবং তারা কেউ শ্বেতাঙ্গ নয়। ঠিক দেখলাম তো? নাকি বৃষ্টি দৃষ্টিশক্তিকে আবছা করে দিল? রোববার এমসিসি-র ছুটি। লর্ডস কর্তাদের ছুটি। এ দিন গ্রেস গেটের দুর্গ সদৃশ দরজা বন্ধ থাকার কথা। আর দ্বাররক্ষীদের যাদের রূঢ় হওয়ার জন্যই চাকরি, যারা স্বয়ং সুনীল গাওস্করকে পর্যন্ত এক বার চিনতে না পারায় ঢুকতে দেয়নি, তারা এত জনপ্রাণী মেনে নিচ্ছে কী করে? এরা কি তা হলে বিষ্যুদবার থেকে শুরু টেস্টের টিকিট কিনতে এসেছে?
দ্বাররক্ষী জানালেন, টিকিটের অ্যাঙ্গলটা ভুল। কারণ বিশ্বের দু’হাজারতম টেস্টের প্রথম চার দিন অলরেডি হাউসফুল। ফিফ্থ ডে এখন বিক্রি হবে না। খেলা যদি ওই অবধি চলে শেষ দিনে দৈনিক টিকিট বিক্রি হবে। এই ভিড়টা হল কিছু লর্ডস জাদুঘর দর্শনার্থী। কিছু স্যুভেনির শপ থেকে ক্রিকেট স্মারকের খরিদ্দার। প্রথম টেস্ট ম্যাচ তো শুধু দু’হাজারতম পূর্তির নয়, ঘটনাচক্রে আবার ভারত-ইংল্যান্ডের মধ্যে শততম টেস্টও। লর্ডস কর্তৃপক্ষ সেই উপলক্ষে পাঁচশো টি-শার্ট বাজারে ছেড়েছে। সেটা আর ‘ইন্ডিয়া’ লেখা নীল জার্সি আগাম কেনার জন্য এত ভিড়। টেস্ট উপলক্ষে যে স্টল-টলগুলো তৈরি হচ্ছে, সেগুলোতে জোর কাজ চলছে। গেট থেকেই চোখে পড়ছে ব্যানারগুলো ‘দ্য গ্রেট ইন্ডিয়ান কারি’, ‘দ্য গ্রেট ইন্ডিয়ান কুইজিন’। এগুলো তো তবু অস্থায়ী রেস্তোরা।ঁ টেস্ট ম্যাচ দিয়ে শুরু। টেস্ট দিয়ে শেষ। লর্ডসের উল্টো দিকে লজ রোডের ওপর সাবেকি যে রেস্তোরাঁগুলো বরাবর টুনা আর স্যামন মাছ খাওয়ানোর পরম্পরা ধরে রেখেছে, সেখানে এখন মেনুতে বড় বড় করে চিকেন টিক্কা। চিকেন বাটার মশালা। এমনই আশ্চর্য রূপান্তর যে, এর পর কোনও দিন হয়তো বোনলেস ইলিশও পাওয়া যাবে।
টেস্টের ছিয়ানব্বই ঘণ্টা আগেই ভারতীয় সমর্থকদের যা উৎসাহের বহর তাতে ভারত কি বিদেশি পিচে হোম সিরিজ খেলতে নামছে? এ মুহূর্তে অবশ্য তার চেয়েও প্রাসঙ্গিক মনে হল, লর্ডসের দ্বাররক্ষী এত নরমসরম হয়ে অর্থনৈতিক মন্দার বাজারে চাকরি টিকিয়ে রেখেছে কী করে? রক্ষীটি মৃদু হেসে বললেন, “যুগ বদলে গেছে। সময় বদলে গেছে। এখন আমাদের বলাই হয়েছে, অনেক খোলামেলা হতে। আর মিস্টার গাওস্করকে আমরা সত্যিই চিনতে পারিনি। তখন টিভি-তে এত খেলা দেখাত না। এখন টিভি দেখে আপনাদের দীনেশ কার্তিককেও আমি চিনি। গেটে ওঁকে দেখলে আটকাব না।”
লর্ডস ছিল ইংরেজ ঔপনিবেশিকতার এক বাস্তিল দুর্গ। রোববার সেখানে এক ঘণ্টা কাটিয়েই মনে হল, ঐতিহ্য শুধু মড়মড় করে ভাঙছেই না, চরিত্রে আইপিএল গামী হয়ে পড়েছে। টাকা চাই তার আর সবার মতোই। বনেদিয়ানার নিকুচি করেছে। আসন্ন টেস্ট ম্যাচ লর্ডসে বাণিজ্যিক বাজারে মস্ত সুযোগ। বিশেষ করে যদি সচিন তেন্ডুলকরের একশোতম সেঞ্চুরিটা হয়ে যায়!
কেবল ট্রেমলেটের শর্ট-পিচ্ড বোলিং নয়, চিরাচরিত গ্রীষ্মকালীন ইংল্যান্ডের বৃষ্টিও কিন্তু শততম সেঞ্চুরিতে বাধা। লর্ডসেই জানা গেল আবহাওয়ার প্রাথমিক পূর্বাভাস খুব যুৎসই নয়। সন্দেহের এই একটা ছায়াতেই সবাই প্রমাদ গুনছে বহু প্রতীক্ষিত পার্টি জলে ভেসে যাবে না তো?
তিনটে যে নমিনেশনের কথা বলছিলাম তাদের নিয়ে এ সপ্তাহের এগজিট পোল করার সুযোগ থাকলে অবশ্য ধুমধাম করে জিতে থাকতেন রুপার্ট মার্ডখ। একেবারে মনের কথা বলছি। কলকাতায় বসে জাতীয় টিভি চ্যানেল দেখে বা আনন্দবাজারে বড় বড় লেখাগুলো পড়ে আন্দাজ করার কোনও উপায়ই নেই বিলেতে এখন মার্ডখ-কে নিয়ে ঠিক কী ঘটছে! ২৬/১১-র সময় যেমন চ্যানেলগুলো অবিশ্রান্ত দেখিয়ে যেত আক্রান্ত তাজ হোটেলের কভারেজ, তেমনই ননস্টপ চলছে ফোনে আড়িপাতা নিয়ে আলোচনা। কী টিভিতে, কী খবরের কাগজে! রোববার লন্ডন পুলিশ নিউজ কর্পের সদ্য পদত্যাগ করা উচ্চপদস্থ কর্মী রেবেদা ব্রুকসকে গ্রেফতার করায় তো কভারেজের তীব্রতা আরও চরমে। এ বার আলোচনা শুরু হয়ে গিয়েছে মার্ডখও কী গ্রেফতার হতে পারেন? অশীতিপর মিডিয়া ব্যারনের এ ভাবে কলঙ্কিত হওয়ার ছায়া পড়েছে ক্রিকেটমহলেও। বি স্কাই বি পুরো কিনে নেওয়ার প্রবল দাবিদার ছিলেন তিনি। ভাষ্যকারদের কারও কারও ধারণা ছিল, মার্ডখ যত ক্রিকেটে শেকড় গাড়বেন, তত বাড়বে ভাষ্যকারদের ভাতা। ক্রিকেটমহলে এমনও আলোচনা হচ্ছে যে, আজ পৃথিবীর সুখীতম লোক হল লন্ডনের ক্রিকেট জুয়াড়ি মজিদ। আর অবশ্যই পাকিস্তানে বসা তাঁর কিছু স্যাঙ্গাত। ফোনে আড়িপাতা কেলেঙ্কারিতে যে মহাবিতর্কিত ‘নিউজ অব দ্য ওয়ার্ল্ড’ বন্ধ করে দিতে বাধ্য হলেন মার্ডখ, তাঁরাই তো ফাঁস করেছিলেন মহম্মদ আমেরদের স্পট ফিক্সিং।
মার্ডখ আর ইংল্যান্ডের ছিচকাঁদুনে প্রকৃতির মধ্যে যতিচিহ্ন হিসেবে যেন দাঁড়িয়ে রয়েছেন সচিন তেন্ডুলকর! ক্রিকেট এমনিতে এ দেশের খবরের কাগজে ততটাই জায়গা পায়, যতটা পায় আনন্দবাজারের খেলার পাতায় টেবিল টেনিস। কিন্তু রোববারের কাগজগুলো নেড়েচেড়ে মনে হল তেন্ডুলকর-কভারেজে যে পরিমাণ জায়গা যাচ্ছে, অন্য খেলাগুলো সামান্য হলেও প্রতিদ্বন্দ্বিতায় পড়ল।
কাল রাত্তিরে স্কাই স্পোর্টস বারবার টনটন ম্যাচের একটাই মুহূর্ত দেখাচ্ছিল। অফস্টাম্পের অনেক বাইরের বল চালাতে গিয়ে সচিন আউট হচ্ছেন। সমারসেট ম্যাচে এত কিছু হল। অ্যান্ড্রু স্ট্রসের রান পাওয়া। রায়নার সেঞ্চুরি। ভারতের ব্যাটিং বিপর্যয়। অথচ সব কিছু ছাপিয়ে কভারেজে বারবার উঠে আসছে ‘দ্য গ্রেট ম্যান ফেলস্।’ যেন রান করাটা হেডলাইন তো বটেই। না করাটাও।
১৯৪৮-এ ইংল্যান্ডে তাঁর শেষ সিরিজ খেলতে এসে যে পরিমান সম্ভ্রম, শ্রদ্ধা আর উষ্ণতা পেয়েছিলেন ব্র্যাডম্যান, তেষট্টি বছর পর অবিকল সেটাই যেন মহাকাল বরাদ্দ রেখেছিল স্যর ডনের নির্বাচিত উত্তরাধিকারের জন্য। নইলে প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক খেলায় বিপক্ষ আগাম এত সশ্রদ্ধ কী করে হয়?
মিডিয়ায় বারবার উঠে আসছে তেন্ডুলকরের অতীব নিম্নবিত্ত লর্ডস রেকর্ড। চারবার খেলে ২১ গড়। সর্বোচ্চ মোটে ৩৭। অথচ ইংল্যান্ডে গড় ৬২। চারটে সেঞ্চুরি সহ। লর্ডসে এ বার সম্ভবত শেষ বারের মতো তাঁর টেস্ট খেলতে নামা নিয়ে অদ্ভুত একটা আতরের গন্ধ চার দিকে ভুরভুর। যার নিঃশব্দ বার্তাএসো, শততম সেঞ্চুরিটা করে ফ্যালো। তুমি সম্মানিত হও। এই মাঠকেও গভীর ভাবে সম্মানিত করো।
মাইকেল ভন আর অ্যালেক স্টুয়ার্ট। প্রাক্তন দুই ইংরেজ অধিনায়ক এ দিনের দৈনিকে তেন্ডুলকরকে সামলানোর সম্ভাব্য কিছু টিপস দিয়েছেন স্ট্রসের দলকে। স্টুয়ার্ট যেমন বলেছেন, “ইনিংসের শুরুতে ফুল আর স্ট্রেট বল করো।” ভন বলেছেন, “অ্যান্ডারসন যেন ফোর্থ স্টাম্প আন্দাজে বল পিচ করে। মিড অনকে একদম সোজা রাখো। মিড উইকেটও সোজা। অন-এর দিকে তাকিয়ে তেন্ডুলকর যেন খালি জায়গা দেখতে না পায়।” আথার্টন আর নাসেরইংল্যান্ডের সাম্প্রতিক আরও দুই অধিনায়ককেও রেডিও-টিভি-প্রিন্টে বারবার জিজ্ঞেস করা হচ্ছে আদর্শ সচিন প্রেসক্রিপশন কী হতে পারে?
নিরন্তর সচিন-গবেষণা দেখে নিশ্চিত হওয়া যাচ্ছে ডগলাস জার্ডিন বেঁচে থাকলে নির্ঘাৎ তাঁর কাছেও মিডিয়া ছুটত। একটা স্ট্র্যাটেজি করে দিন না। আপনিই তো ক্রিকেট-স্ট্র্যাটেজির স্রষ্টা। জার্ডিন অবশ্য ভন বা স্টুয়ার্টের লেখা পড়লে হয়তো চটেই যেতেন যে, বিপক্ষকে এত মাথায় তোলার কী আছে! আমি স্বয়ং ডনকেই তুলিনি।
ভনরা বলেছেন, সচিনকে শ্রদ্ধা করো, ভয় কোরো না। কিন্তু তাঁদের দু’টো লেখাই এত বেশি প্রশংসায় ভিজে যে ইংল্যান্ড ড্রেসিংরুমে সমাদৃত না-ও হতে পারে।
দেখে-টেখে কেমন অপার্থিব মনে হচ্ছে। সত্যিই কি তেষট্টি বছর আগের গ্রীষ্ম ফেরত আসছে নাকি ২০১১-র ইংল্যান্ডে? সেবারও তো বৃষ্টি ব্যাঘাত ঘটিয়েছিল। সেবারও ওভালে ছিল সিরিজের শেষ টেস্ট!
Previous Story Khela Next Story



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.