নাশকতা হয়নি, রেলকর্মীদের
‘ভুলেই’ সাঁইথিয়ার দুর্ঘটনা
নাশকতা নয়।
নিছক সংশ্লিষ্ট রেলকর্মীদের ভুলের জেরেই সাঁইথিয়া স্টেশনে দাঁড়ানো বনাঞ্চল এক্সপ্রেসের পিছনে উত্তরবঙ্গ এক্সপ্রেস ধাক্কা মেরেছিল বলে তদন্ত-রিপোর্টে জানিয়ে দিলেন কমিশনার অফ রেলওয়ে সেফটি (সিআরএস)। ঠিক এক বছর আগে গভীর রাতের (২০১০-এর ১৯ জুলাই) ওই দুর্ঘটনায় ৬১ জনের মৃত্যু হয়। উত্তরবঙ্গের চালক, সহকারী চালক ও বনাঞ্চলের গার্ডও তাতে মারা যান।
এবং কমিশনার অফ রেলওয়ে সেফটি আরপি যাদব তাঁর রিপোর্টে ওই বিপর্যয়ের দায় চাপিয়েছেন চার রেলকর্মীর উপরে। প্রত্যক্ষ ভাবে দায়ী করেছেন উত্তরবঙ্গ এক্সপ্রেসের চালক, সহকারী চালক ও সাঁইথিয়া স্টেশনের পশ্চিম কেবিনের কেবিনম্যানকে। পরোক্ষে দায়ী করা হয়েছে উত্তরবঙ্গের গার্ডকে।
কী হয়েছিল সেই রাতে?
সাঁইথিয়া স্টেশনের চার নম্বর প্ল্যাটফর্মে রাঁচিগামী বনাঞ্চল এক্সপ্রেস দাঁড়িয়ে ছিল। রাত দু’টো নাগাদ দ্রুত গতিতে এসে তার পিছনে আছড়ে পড়ে শিয়ালদহগামী ডাউন উত্তরবঙ্গ এক্সপ্রেস। প্রাথমিক তদন্তে প্রকাশ, উত্তরবঙ্গ এক্সপ্রেস সাঁইথিয়ার আগের স্টেশন গদাধরপুর থেকে সিগন্যাল মেনেই ছেড়েছিল। তার পরে মাত্র সাত কিলোমিটার যেতে না-যেতেই ট্রেনটি কী ভাবে বেসামাল হয়ে গেল, তা নিয়ে বিভ্রান্তি দেখা দেয়। এর পিছনে নাশকতা রয়েছে কি না, উঠেছিল সে প্রশ্নও।
রেলের প্রাথমিক তদন্তে অবশ্য নাশকতার কোনও প্রমাণ মেলেনি। তদন্তকারীদের প্রাথমিক অনুমান ছিল, মানুষের ভুলেই (হিউম্যান এরর) দুর্ঘটনাটি ঘটেছে। এ বার সিআরএসের রিপোর্টে সেটাই পরিষ্কার ভাবে জানিয়ে দেওয়া হল। ঘটনার জন্য ‘দায়ী’ কারা কারা, সিআরএস তা চিহ্নিত করে দিয়েছেন। কার কী ভুল ছিল, তা-ও উল্লেখ করেছেন। রেল-সূত্রের খবর, রিপোর্টটি রেল বোর্ডে পাঠানো হয়েছে। কী বলা হয়েছে তাতে?
রিপোর্ট মোতাবেক, দুর্ঘটনার মূল দায় উত্তরবঙ্গ এক্সপ্রেসের দুই চালক মাধবচন্দ্র দে এবং নির্মল মণ্ডলের। সিআরএসের বক্তব্য: সাঁইথিয়া স্টেশনে ঢোকার মুখে সিগন্যাল ছিল লাল। তা উপেক্ষা করেই উত্তরবঙ্গ এক্সপ্রেস দুরন্ত গতিতে ঢুকে পড়ে সাঁইথিয়া স্টেশনের চার নম্বর প্ল্যাটফর্মে, যেখানে তখন দাঁড়িয়ে বনাঞ্চল এক্সপ্রেস!
কিন্তু দুই চালক কেন সিগন্যাল মানলেন না?
সিআরএস যাদবের মতে, উত্তরবঙ্গের চালক ও সহকারী চালক সম্ভবত তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়ে পড়েছিলেন। তাই সিগন্যাল ধরতে পারেননি। দুই চালকের ময়নাতদন্ত ও ভিসেরা-রিপোর্টের উল্লেখ করে তিনি জানিয়েছেন, চালকের পেটে ইথাইল অ্যালকোহল মিলেছে। তবে রেল-পুলিশ তাঁর রক্তের নমুনা না-পাঠানোয় বোঝা যায়নি যে, ওই মাদকের পরিমাণ ছিল কতটা। সহকারী চালকের পেটে কিন্তু অ্যালকোহল পাওয়া যায়নি। তা সত্ত্বেও তিনি কেন তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়ে পড়েছিলেন, রিপোর্টে তা স্পষ্ট নয়। ঠিক যে ভাবে চালকের শরীরে অ্যালকোহল থাকলেও তার পরিমাণ ওই ব্যক্তিকে তন্দ্রাচ্ছন্ন করে ফেলার মতো ছিল কি না, সেটাও পরিষ্কার হয়নি।
সেই রাতে সাঁইথিয়া স্টেশনের পশ্চিম কেবিনে কর্তব্যরত কেবিনম্যান মটোর লেটের ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন সিআরএস। তাঁর যুক্তি: এখনকার যা প্রযুক্তি, তাতে দুই চালক সিগন্যাল উপেক্ষা করলেও দুর্ঘটনা এড়ানো যেত। বিষয়টি ব্যাখ্যা করে রিপোর্ট বলছে: কোনও প্ল্যাটফর্মে ট্রেন দাঁড়িয়ে থাকলে সেখানে যাতে অন্য ট্রেন ঢুকতে না-পারে, সে জন্য পিছনের ট্রেনকে লুপ-লাইনে ঢুকিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা রয়েছে। সংশ্লিষ্ট প্রযুক্তি প্রয়োগ করা হলে সিগন্যাল না-মেনে ছুটে আসা পিছনের ট্রেন নিজে থেকেই লুপ-লাইনে চলে যাবে। অথচ ১৯ জুলাই রাতে সাঁইথিয়ার কেবিনম্যান তা ব্যবহারই করেননি!
পাশাপাশি উত্তরবঙ্গ এক্সপ্রেসের গার্ড সোমনাথ সেনগুপ্তকেও পরোক্ষ ভাবে দায়ী করেছেন সিআরএস। কেন? রিপোর্টের বক্তব্য:সাঁইথিয়া স্টেশনে উত্তরবঙ্গ এক্সপ্রেস থামার কথা। কিন্তু স্টেশন এসে যাওয়া সত্ত্বেও ট্রেন যে অনেক বেশি গতিতে ছুটছে, তা টের পেয়েও উত্তরবঙ্গের গার্ড ইমার্জেন্সি ব্রেক কষেননি। সিআরএসের মতে, গার্ড সময়মতো ইমার্জেন্সি ব্রেক কষলে দুর্ঘটনার তীব্রতা অনেক কম হতো। বহু জীবনহানি এড়ানো যেত।
ট্রেনে-ট্রেনে সংঘর্ষ প্রতিরোধের ব্যবস্থা (অ্যান্টি কলিশন ডিভাইস) এ ক্ষেত্রে কার্যকর হয়নি কেন? রিপোর্টে এই প্রসঙ্গটিও টেনেছেন সিআরএস। জানিয়েছেন, উত্তরবঙ্গ এক্সপ্রেস উত্তর-পূর্ব সীমান্ত রেলের ট্রেন হওয়ার সুবাদে তার ইঞ্জিনে ‘ডিভাইস’টি লাগানো ছিল। বস্তুত ওই শাখার সব ইঞ্জিনে, লাইনে ও কেবিনে প্রযুক্তিটি কার্যকর করা হয়েছে। কিন্তু পূর্ব রেলের লাইন ও কেবিনগুলোয় হয়নি। ফলে সাঁইথিয়ায় দুই ট্রেনের সংঘর্ষ এড়ানো যায়নি।
এরই প্রেক্ষিতে পূর্ব রেলের সব লাইন ও কেবিনে অবিলম্বে অ্যান্টি কলিশন ডিভাইস বসানোর সুপারিশ করেছেন সিআরএস। একই সঙ্গে জোর দিয়েছেন রেলের সব শাখায় স্বয়ংক্রিয় ‘ভিজিল্যান্স কন্ট্রোল’ অবিলম্বে কার্যকর করার উপরে। সেটা কী? রেল-সূত্রের খবর: এটি এক ধরনের স্বয়ংক্রিয় ইঞ্জিন নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা। ট্রেন চলাকালীন চালক যদি ঘুমিয়েও পড়েন, এই প্রযুক্তির দৌলতে ইঞ্জিন নিজেই আস্তে ধীরে ধীরে থেমে যাবে। রেল বোর্ডের প্রাক্তন কর্তা সুভাষরঞ্জন ঠাকুরের ব্যাখ্যা, “অনেক আগে প্রতিটা ইঞ্জিনে থাকত এমনই এক যন্ত্র ডেড ম্যান্স হ্যান্ডেল। ইঞ্জিনে একটা হাতল বা লিভার হাত দিয়ে ধরে রাখতেন চালক। হাত ছাড়লেই ইঞ্জিন আপনা-আপনি গতি কমাতে কমাতে থেমে যেত। তবে ভিজিল্যান্স কন্ট্রোল আরও কার্যকর প্রযুক্তি।” উল্লেখ্য, ২০০৯-এ এটি সব শাখায় বলবৎ করার সুপারিশ করেছিল রেল বোর্ড। তা এখনও হয়নি।
প্রযুক্তির পাশাপাশি দুর্ঘটনা এড়াতে রেলের বিভিন্ন শাখায় সরেজমিন নজরদারি বাড়াতে বলেছেন সিএআরএস। তাঁর সুপারিশ: রেল কর্তাদের স্টেশনে স্টেশনে গিয়ে, ট্রেনে ট্রেনে চড়ে কাজকর্ম খতিয়ে দেখতে হবে। কর্মীদের সচেতন করতে হবে।
সাঁইথিয়ার পুনরাবৃত্তি রুখতে কতটা সচেতন হয় রেল, সেটাই দেখার।

ছয় সূত্র
সিগন্যাল না-মেনে স্টেশনে ঢুকেছিল উত্তরবঙ্গ এক্সপ্রেস
উত্তরবঙ্গের চালক ও সহকারী চালক ছিলেন তন্দ্রাচ্ছন্ন
চালকের পেটে মিলেছে ইথাইল অ্যালকোহল
কেবিনম্যান লুপ-লাইন খোলা রাখেননি
ইমার্জেন্সি ব্রেক কষেননি উত্তরবঙ্গের গার্ড
লাইন ও কেবিনে অ্যান্টি কলিশন ডিভাইস ছিল না
Previous Story Purulia Next Story



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.