|
|
|
|
|
সোনা কাঠি রুপো কাঠি
ব্যাজার জীবনের আনাচকানাচে রূপকথা অনেক। ছুঁয়ে দিন
আদরে, পরমোৎসব ক্ষণে ক্ষণে। নিভৃত আঁচ পোহান অবিরাম। |
|
|
একা থাকার উৎসব
রংগন চক্রবর্তী |
আমার দরজায় চারটে তালা। আগের বাড়িটার একটা মাত্র ল্যাচ ভেঙে চুরি হয়ে গিয়েছিল বলে। রোজ ফিরে এসে দরজা খুলি আর আমার কী রকম মনে হয় এটা নিয়ে একটা বাউল গান হতে পারত, ‘এক দরজার চারটে তালা’। অবশ্য এতে দেহতত্ত্ব ফিট করে কি না জানি না। একটা একটা করে তালা খুলি, ঢুকে ভেতর থেকে দরজাটা লাগাই, কী একটা আহ্লাদে মন ভরে যায়। না, ইয়ো বলে চেঁচাই না, বা নাচি না। একটা একটা করে আলো জ্বালাই আর সেই অন্ধকারে একটা প্যান্ডেল একটু একটু করে ফুটে ওঠে। ওপরের ফ্ল্যাট বলে গুমোট হয়ে থাকে। জানলা খুলি, বাতাস ঢোকে, সুইচে হাত রাখি, পাখা আমায় বাতাস করে। ফ্রিজ খুলি। কাজের মেয়ে বাটিতে তরমুজের টুকরো রেখে গেছেন, বাটিটা হাতে নিয়ে সোজা শোয়ার ঘরের বিছানায় গিয়ে বসে রিমোট টিপে টিভি দেখি। বাটি থেকে কাঁটায় গাঁথা তরমুজ আমার উৎসবের লাল টুকটুকে আহ্লাদের মতো মুখের ভেতর গলে যেতে থাকে। একটু ঝামেলা, দু-একটা বিচি পুটুরপুটুর করে ওঠে। আমার এই একা থাকার স্পেসে আমার তারা হয়ে যাওয়া মায়ের শাসন ফিরে আসে, বিচিগুলি ওই অনাঘ্রাত তরমুজের বাটিতে ফেলে দিতে পারি না। নিজেই গজগজ করতে করতে রান্নাঘর থেকে বিচি ফেলার জন্য একটা প্লেট নিয়ে আসি। হরভজনের ওভারটার শেষ বলটা মিস হয়ে যায়। সেফ আলি একটা মোবাইল সেটের বিজ্ঞাপনে কী সব বলতে থাকেন, একটা লোক লজ্জায় বামন হয়ে যায়।
আমার এই যে একার ঘরে ফেরা মঙ্গলকামীরা কেউ কেউ দুঃখ করেন। বাড়ি ফিরে একটা কারও মুখ দেখতে পারব না, ভাবতেও পারি না ইত্যাদি। আমার অনেক ছোট বেলার একটা উৎসবের গল্প মনে পড়ে যায়। সম্ভবত ভারতমাতার পুজোয় মান্না দে-র একটা গান বাজছিল, কী করে বোঝাই কিছু চাই না চাই না চাই না। হবি তো হ, ঠিক চাই না’র পরের রেকর্ডটা কেটে গিয়ে চাই না চাই না চাই না কথাটা প্রায় দু’মিনিট বেজেছিল। ব্যাপারটা ধরতে পারলেন তো?
|
অকারনের উৎসব
দেবাশিস গুপ্ত |
রাস্তায় দাঁড়িয়ে এক বন্ধুর অপেক্ষা করছিলাম। হঠাৎ একটি মেয়ের সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। সে আমায় দেখল কি না, জানি না। আঠারো বছরের মেয়েরা কাউকে দেখবে না, সেটাই নিয়ম। কিন্তু, আমি তাকে দেখলাম। সে আমার থেকে খানিক দূরে দাঁড়িয়ে ছিল। সাধারণ দেখতে বললে ভুল হবে। বলতে হবে অতি সাধারণ। কিন্তু, কী আশ্চর্য গ্রীবা তার! সব মেয়েই জানে, তাকে ঠিক কী ভাবে সুন্দর লাগে। যে মেয়ের থুতনির বাঁ দিকে তিল আছে, সে হাসার সময় মুখের বাঁ দিকটাই দেখতে দেয়। এই মেয়েটিও জানে, তার গ্রীবা সুন্দর। সে দাঁড়িয়ে রইল গর্বিত রাজহাঁসের মতো। আর, সেই গর্ব-ভরা দাঁড়ানোয় তাকে আরও সুন্দর লাগল। মনেই পড়ল না, এই মেয়ে আসলে দেখতে অতি সাধারণ। একটু বাদেই মেয়েটার বন্ধু এল, সে খানিক ঝগড়া করে তার সঙ্গেই হাসতে হাসতে চলে গেল। আর, এই তিন মিনিটে আমার দিনটা ঝলমলে হয়ে গেল। সারা দিনে এক বারও মন বিষণ্ণ হল না।
এটাই তো উৎসব। বেঁচে থাকার উৎসব। সেই মেয়েকে চিনি না, হয়তো চিনবও না, কিন্তু তাকে দেখেই একটা গোটা দিনের মন ভাল হয়ে যাওয়া এই টুকরোগুলো কুড়িয়ে নিতে পারলেই জীবনটা দারুণ। ভাল্লাগছে না
বলার কোনও মওকাই পাওয়া যায় না। এটা আসলে একটা খেলা। নিজের সঙ্গে। দুনিয়াটা তো ভাল জায়গা নয়, মনখারাপেরা ইতিউতি বসেই থাকে অন্যমনস্ক পেলেই ঘাড়ে ঝাঁপিয়ে পড়বে। তাদের চোখ ফাঁকি দিয়ে নিজের জন্য একটু আনন্দ কুড়িয়ে নিয়ে বাড়ি ফেরা। নিজেকে আনন্দে রাখতে পারাকেই তো উৎসব বলে, না কি?
এই খেলাটা সবাই কম-বেশি খেলি। হঠাৎ যে দিন সকালবেলায় জানালা খোলার সঙ্গে সঙ্গে একরাশ রোদ্দুর বিছানায় ঝাঁপিয়ে পড়ে বলে দেয়, পুজো এসে গেছে, সে দিনের মনখারাপ করতে পারে, কার সাধ্য। কিন্তু, সকালবেলার সেই রোদ্দুরটাকে কুড়িয়ে নিতে পারলে তবেই। খেলতে খেলতে মেয়ে যখন নিজেই ঘুমিয়ে পড়ে, তার মাথাটা একটু কাত হয়ে থাকে বালিশের ওপর, তখন তার মুখের দিকে তাকালে বুকের মধ্যে উথালপাথাল সুখ দমবন্ধ করে দেয় না? পুরনো বইয়ের পাতার ফাঁক থেকে যদি বেরিয়ে আসে একটা পালক, সুদূর বালক বয়সে কুড়িয়ে পাওয়া, তার পর বোনের হাত থেকে বাঁচাতে লুকিয়ে রাখা, ফের নিজেই ভুলে যাওয়া তার কথা সেই পালকটা ছোটবেলাকে চোখের সামনে ডাকবেই। তার পর মোবাইলে বোনের নম্বর টিপবেন ক্যালিফোর্নিয়ায় হয়তো তখন মাঝরাত। তবু সেই মাঝরাতেই দু’জনে বলবেন নারকোলের মালায় আমমাখা নিয়ে মারামারি করার কথা এক মুহূর্তের উৎসব। পৃথিবীর দু’প্রান্তে দু’জন মানুষ খুব ভাল থাকবেন কিছু ক্ষণ।
উৎসবের জন্য কি আর বছরভর অপেক্ষা করতে হয়!
|
|
শরীর যাপনের উৎসব
স্বাতী ভট্টাচার্য |
রবীন্দ্রনাথের ওই যে গানটা, ‘ওহে সুন্দর মম গৃহে আজি পরমোৎসব রাতি’, যত শুনি তত সেনসুয়াস বলে মনে হয়। দু’জনের উৎসবের এমন বর্ণনা আর কোথায় আছে? আত্মার গৃহ তো দেহটাই, পরমোৎসবের দিন সেই পরম আবাস ছেড়ে অন্য কোথায় ঘরবাড়ি খুঁজতে বেরোবে মানুষ? যে মমতায় মানুষ বলতে পারে ‘মম গৃহ’, সে কি ইট-কাঠ-মার্বেলের জিনিস হতে পারে?
দেহকে নিয়ে আমাদের নিত্য-উৎসব। যে উৎসব সবচেয়ে তীব্র-মধুর, হৃদয়ের মানুষটিকে সাদরে-সানন্দে অভ্যর্থনা, সে তো রয়েইছে। কিন্তু একার উৎসবই বা কম কী? ছেলেবেলায় বন্ধুরা মিলে ‘বর্ষবরণ’ ধরনের যে উৎসব করা হত, আমার কাছে তার প্রধান আকর্ষণ ছিল সাজগোজ। যে দিন মায়ের শাড়ি তিন পাক করে জড়িয়ে, মাথায় গাঁদার মালা ক্লিপ দিয়ে এঁটে নাচের দিন, সে দিন ঠোঁটে লিপস্টিক, গালে রুজ লাগালেও মা বকবে না। দিদিরা ধমক দিয়ে নট-নড়নচড়ন করে বসিয়ে মেক-আপ করে দিত। যেই চোখ খুলে নিজেকে আয়নায় দেখা গেল ফাউন্ডেশনে সাদা মুখ, কাজলে ভাসা চোখ, ঠোঁট-গাল লাল টুকটুকে অমনি ‘ফাংশান’ শুরু। স্টেজের পর্দা ওঠা তো স্রেফ নিয়মরক্ষার ব্যাপার। বয়ঃসন্ধিতে সেই মুগ্ধতা যেন ঘোর ধরিয়ে দেয়। প্রতি দিন যেন একটা একটা করে পাপড়ি খুলে নিজেকে চিনে নেওয়া যন্ত্রণার উৎসব, সার্থকতার উৎসব। মধ্যবয়সের কোমল মেদ, প্রৌঢ়ত্বের রুপোলি চুল, সব আবিষ্কারে তার রেশ চলতেই থাকে।
তার পর এক দিন মনে হয়, পায়ে পায়ে আজ এ ঘর থেকে ও ঘরে যে যেতে পারছি, আজ যে হাঁটুর ব্যথাটা অত ভোগায়নি, অম্বল-গ্যাস-প্রেশার ষড়যন্ত্র করে পেড়ে ফেলেনি বিছানায়, তার চেয়ে বড় সেলিব্রেশন আর আছে কী? যিনি গেয়েছিলেন ‘তোমার ঘরে বসত করে কয়জনা, মন জানো না’, তিনি হয়তো হার্ট, লিভার, কিডনি, কোলোন বোঝাননি। কিন্তু এ সব যন্ত্রপাতির সকলেরই যে নিজের নিজের মর্জি আছে, তা তারা বেশ জানান দেয়। যে দিন তারা সবাই খোশমেজাজে থাকে, সে দিনের মতো উৎসব আর হয় না। সে দিন গোটা বিশ্বের নেমন্তন্ন। এসো কিন্তু, আমি ঘরেই আছি। আমার ঘরে।
|
রসনার উৎসব
সেমন্তী ঘোষ |
দু’জনেই কবি। বয়োজ্যেষ্ঠ যিনি, তাঁকে সস্ত্রীক নেমন্তন্ন করে এলেন কনিষ্ঠ জন। কোনও বিশেষ দিন নয়। কোনও বড় আয়োজন নয়। নিমন্ত্রিত দু’জন, নিমন্ত্রণকারীরা দু’জন। খাওয়াটা অবশ্য এলাহি। লম্বা তালিকা ধরে ধরে প্রতিটি পদ রান্না। তালিকাটা দুই কবিরই ভারী পছন্দের! সরস আড্ডায় কত বার তারিয়ে তারিয়ে তাঁরা বলেছেন সে কথা। সেই যে, বুদ্ধদেব বসু-র ‘তিথিডোর’ উপন্যাসে বিয়ের খাওয়ার সেই অসামান্য তালিকাটি.. মটরশুঁটির কচুরি, ছোলার ডালের ছেঁচকি, পেস্তাবাদাম দেওয়া পোলাও, মুগের ডাল, বেসন দিয়ে ভাজা বেগুন, ভেটকি ফ্রাই, মাছের মুড়ো দেওয়া বাঁধাকপির ডালনা, ফুলকপি দেওয়া রুইমাছ, ভাপানো চিংড়ি, মাংস, জলপাই টক, টমেটোর চাটনি, সন্দেশ, রসগোল্লা, খুরিভরা রসমালাই! আদরের কন্যার বিয়ে, এলাহি তালিকা, ঘরোয়া আপ্যায়ন, কখনও মনে হয় না বাড়াবাড়ি, বরং পড়তে পড়তে হিংসেয় সিক্ত হতে হয়, আহা এমন যদি..! তাই কনিষ্ঠ কবির নিমন্ত্রণ জ্যেষ্ঠকে: আজ তিথিডোর-এর খাওয়া! কথা নেই, বার্তা নেই, হেতু নেই, অজুহাতও নেই, এমনিই খাওয়া, এমনিই উৎসব।
আহা, এমন যদি..!
উৎসব মানে যে খাওয়া, প্রধানত এবং বস্তুত খাওয়া, এ বিষয়ে যাদের মনে সন্দেহের লেশমাত্র নেই, তাদের জন্য এই গল্পটা খুব জরুরি। কেননা, উৎসব অর্থাৎ উৎসব-ভোজের জন্য তখন আর বাইরের দিকে তাকাতে হয় না, মনের দিকে তাকালেই চলে। পুজো, বিয়ে, জন্মদিন, এগুলোর জন্য, দুর্ভাগ্যবশত, বাইরের জগতের উপরই নির্ভর করতে হয়: কবে শুনিব তোমার বাণী বলে বসে থাকতে হয়। বেশির ভাগ সময়ে সে সব
খাওয়া মনোমতও হয় না তেমন। তাই অন্যরা যা-ই বলুক, নিজের কাছে অনেক সময়েই মোটেও ‘উৎসব’ হয়ে ওঠে না সে সব দিনগুলো, কেমন যেন ‘আড়ম্বর’ হয়ে যায়। দরকার কী অতশত’র। শেষ অবধি তো কয়েক জন, কিংবা অনেক জন মিলে খাওয়াটার জন্যই উৎসব? এই গোটা গোটা বছর পাড়ি দেওয়া? তা হলে বাইরের উপর নির্ভর না করলেই হয়? মন থেকে বার করে আনলেই হয়? কত খাওয়া এবং খাওয়ানোর ছোট বড় ছবি মনের কোণে জমা, কোনওটা শোনা, কোনওটা জানা, কোনওটা কল্পনা, কোনওটা জল্পনা। বাইরের উপলক্ষের উপর নির্ভর না করে সেই সব মন-ছবি দিয়েই যদি বানিয়ে ফেলি এক-একটা উপলক্ষ? উৎসব জিনিসটা একেবারে নিজের হয়ে যায় না তখন? যখন খুশি? যেমন খুশি? যার সঙ্গে খুশি?
এমনকী, একা-ই খুশি, একা-ও খুশি। একা একাই তিথিডোরের তালিকাটা বার করে লেগে পড়ব ঠিক করেছি। একাই তখন আস্ত একটা উৎসব হয়ে যাব! |
|
|
|
|
|