|
|
|
|
অবনতি হচ্ছে রোগীর অবস্থার |
পুরুষ না নারী, বিভ্রান্তির গেরোয় থমকে অস্ত্রোপচার |
পারিজাত বন্দ্যোপাধ্যায় • কলকাতা |
তিনি পুরুষ না নারী, এই প্রশ্নের মীমাংসা হয়নি বলে সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসাই পাচ্ছেন না বছর বত্রিশের বিনি রায় (নাম পরিবর্তিত)। তাঁর পেটের ক্ষত বিষিয়ে পুঁজ জমে গিয়েছে। হাঁটাচলার ক্ষমতা হারিয়েছেন। ঠিক ভাবে মূত্র নির্গত হচ্ছে না। পেট অস্বাভাবিক ফুলে গিয়েছে। গত ১০-১২ দিন ধরে কলকাতার এক সরকারি হাসপাতাল থেকে অন্য হাসপাতালে ধাক্কা খাচ্ছেন বিনি। আর একটু একটু করে তাঁর শারীরিক অবস্থার অবনতি হচ্ছে।
বিহারের বালিয়ায় এক হাতুড়ে চিকিৎসকের কাছে সম্প্রতি লিঙ্গচ্ছেদ করিয়ে হিজড়ায় পরিণত হয়েছিলেন বিনি। মাসখানেক আগে ক্ষত বিষিয়ে যায়। মূত্র নিঃসরণ আটকে যায়, সঙ্গে যন্ত্রণা। ডায়াগনস্টিক ক্লিনিকে কয়েকটি পরীক্ষা করান। সেখানকার রিপোর্টে তাঁকে ‘পুরুষ’ বলে লেখা হয়। সেই রিপোর্ট নিয়ে তিনি যান এসএসকেএম হাসপাতালের আউটডোরে। হাসপাতালের টিকিটে লেখা হয় ‘মহিলা’। আর সেখান থেকেই বিপত্তি শুরু।
আউটডোরের চিকিৎসক ওষুধ দিয়েছিলেন। তাতে ঘা সারেনি। মূত্র আটকে যাওয়ায় ৮ জুলাই এসএসকেএমের ইমার্জেন্সিতে নিয়ে যাওয়া হয় বিনিকে। সেখানে বিশেষ পদ্ধতিতে তলপেটে ফুটো করে একটি নল ঢোকানো হয় হয়।
বিনির অভিযোগ, বারবার করে ভর্তির আবেদন করলেও চিকিৎসকেরা জানিয়ে দেন,
ভর্তির মতো অবস্থা নয়। কিন্তু বাড়ি ফিরে যন্ত্রণা আরও তীব্র হয়। তাঁর কথায়, “যেখানে নল লাগানো তার নীচ দিয়ে ফোঁটা ফোঁটা মূত্র আর রক্ত বেরিয়ে যাচ্ছিল। ফলে সেদিন রাতে বন্ধুরা আবার নিয়ে গেল এসএসকেএমের ইমার্জেন্সিতে। তখন ডাক্তারেরা বললেন, ডায়াগনস্টিক ক্লিনিকের রিপোর্টে ‘পুরুষ’ বলে লেখা
আছে, আর হাসপাতালের কার্ডে ‘মহিলা’। ভর্তিতে সমস্যা হবে। আমি বারবার মহিলাদের ওয়ার্ডে ভর্তির অনুরোধ করলেও তাঁরা বাড়ি পাঠিয়ে দেন।”
এসএসকেএমের সুপার ও ভবানীপুর থানায় লিখিত অভিযোগ জমা দিয়েছেন বিনি। তিনি লিখেছেন ভারতীয় পাসপোর্টে তাঁরা লিঙ্গের জায়গায় ‘আদার্স’ লেখার স্বীকৃতি পেয়েছেন। ২০১১ জনগণনা রিপোর্টেও ‘আদার্স’রা আলাদা ভাবে তালিকাভুক্ত হয়েছেন। তা হলে সরকারি হাসপাতাল কেন হিজড়াদের জন্য আলাদা শয্যা রাখবে না, প্রশ্ন তুলেছেন বিনি। তাঁর আরও প্রশ্ন, তাঁদের কি তাহলে বিনা চিকিৎসায় মরতে হবে? এ ব্যাপারে এসএসকেএমের ইউরোলজির বিভাগীয় প্রধান অনুপ কুণ্ডুর বক্তব্য, “ওই রোগীকে পুরুষ ওয়ার্ড না মহিলা ওয়ার্ডে ভর্তি করানো হবে, সেটা স্থির করা যাচ্ছে না। কিন্তু ঘা শুকোলেই ওঁর অস্ত্রোপচার জরুরি।”
বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা করানোর সামর্থ বিনির নেই। এসএসকেএম ভর্তি না নেওয়ায় দিন তিনেক বিনা চিকিৎসায় বাড়িতেই থাকেন তিনি। অবস্থা আরও খারাপ হওয়ায় বন্ধুরা তার পর ভর্তি করান স্কুল অফ ট্রপিক্যাল মেডিসিনে। সেখানেও বিভ্রান্তি। প্রথমে তাঁকে ভর্তি করা হয় মহিলা ওয়ার্ডে, তার পর পুরুষ ওয়ার্ডে, তার পর কেবিনে। কিন্তু ওই হাসপাতাল জানিয়ে দেয়, এই ধরনের ইউরোলজিক্যাল অস্ত্রোপচার তাদের এখানে হয় না। অস্ত্রোপচারের জন্য এসএসকেএমেই যেতে হবে। শনিবারের মধ্যে হাসপাতাল থেকে তাঁকে ছেড়ে দেওয়া
হবে বলেও জানানো হয়েছে। বিনির আর্তি, “মূত্র, পুঁজ, রক্ত বেরিয়ে বিছানা ভিজিয়ে দিচ্ছে। প্রচণ্ড যন্ত্রণা। তা-ও কেউ অস্ত্রোপচার করতে চাইছে না। হিজড়া বলেই বোধ হয় আমার এই শাস্তি।”
হিজড়া ও রূপান্তরকামীদের নিয়ে কাজ করা একটি সংগঠনের তরফে রঞ্জিত সিংহ বলেন, “সরকারি হাসপাতালকে এই সব কারণেই হিজড়ারা এড়িয়ে চলেন। পয়সা থাকলে বেসরকারি হাসপাতালে যান। না থাকলে বাড়িতে হাতুড়ে চিকিৎসক বা পাড়ার চিকিৎসককে দেখান।” স্বাস্থ্য দফতরের কি এ ব্যাপারে কিছু করার নেই? রাজ্য এড্স প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণ সংস্থার যুগ্ম অধিকর্তা (কেয়ার অ্যান্ড সাপোর্ট) দীপ্তেন্দ্রনারায়ণ গোস্বামী বলেন, “চিকিৎসার অধিকার সকলের আছে। দরকার হলে এঁদের জন্য আলাদা শয্যা তৈরি করে চিকিৎসা করতে হবে। আমরা স্যাক্সের তরফে স্বাস্থ্য দফতরের সঙ্গে কথা বলব।”
বিনির বন্ধু ও আত্মীয়দের ভয়, ওই কথা শুরু পর্যন্ত রোগী বেঁচে থাকবেন তো? |
|
|
|
|
|